ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প

প্রিয় বই -মো. রহমত উল্লাহ্

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ৩১ মার্চ ২০১৮

প্রিয় বই -মো. রহমত উল্লাহ্

ফুফুর বাসায় বেড়াতে এসেছে মাহির। রাতে খাওয়ার পর বসল আড্ডায়। তিন ভাই বোনকে সে উপহার দিল তিনটি বই। প্রিয় লেখকদের বই পেয়ে অনেক খুশি তারা। প্রতিটি বই খুলেই দেখে লেখকের অটোগ্রাফ। জানতে চায়, তুমি কীভাবে পেলে এই অটোগ্রাফ? মাহির বলে, বই মেলায় দেখা হয়েছিল ওনাদের সঙ্গে। ও! তাই নাকি? তুমি বই মেলায় গিয়েছিলে? নিজে দেখেছ ওনাদের? কথা বলেছ ওনার সঙ্গে? কী বললেন তোমাকে? আর কে কে গিয়েছিল বই মেলায়? এমন অনেক প্রশ্ন করে তিনজন। মাহির বলে, সে তো অনেক কথা। অনেক সময় লাগবে বলতে। মাইমুনা বলে, তুমি বলো, আমি শুনতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে আবদার করে নাসিফ ও নায়িম। হ্যাঁ হ্যাঁ, বলো মাহির ভাইয়া। আমরাও শোনতে চাই সব। মাহির বলে, আচ্ছা, শোন তাহলে। সেদিন ছিল শুক্রবার। সকালে যেন উৎসবে পরিণত হলো স্কুলের মাঠ। আগের ঘোষণা অনুযায়ী সবাই হাজির সকাল সাতটায়। সবার পরনে স্কুল ড্রেস। তিথিমণির হাতে হাত ঠেকিয়ে তালি বাজাল মায়িশা। বলল, ‘হাহ্ হা হুরে।’ তিথিমণি বলল, ‘বইমেলায় যাব রে।’ একই কাজ করতে লাগল ছোট-বড় সবাই। করতে লাগল হাসাহাসি আর ছোটাছুটি। যেন বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দ! মুখে মুখে একই সেøাগান। ‘হাহ্ হা হুরে, বইমেলায় যাব রে।’ স্কুলের নাম লেখা ক্যাপ পরলেন হেডস্যার, অন্যান্য স্যার ও ম্যাডাম। আমাদেরও পরিয়ে দিলেন একই রকম ক্যাপ। বুকে ঝুলিয়ে দিলেন বিভিন্ন সেøাগান লেখা প্লেকার্ড। ‘ভাল বই পড়ব, ভাল জীবন গড়ব।’ ‘বই পড়া ছাড়ব না, ভাল কাজে হারব না।’ ‘যা-ই হোক দাম তার, বই সেরা উপহার।’ সকাল আটটায় ছাড়ল আমাদের বাস। অনেক মজা হলো বাসে। গান, সেøাগান, হৈচৈ, হাততালি। স্বপ্নের মতো চলে গেল সময়। পৌঁছে গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে। দেখে নিলাম অপরাজেয় বাংলা। হেড স্যার বললেন, এটি হচ্ছে অপরাভব বাঙালীর প্রতীক। এরপর এলাম বাংলা একাডেমির সামনে। টিফিন সেরে নিতে বললেন স্যার। গাছের ছায়ায় বসে গেলাম আমরা। খেতে শুরু করলাম সঙ্গে রাখা টিফিন। যেন পিকনিক। স্যারও মুখে তুলে নিলেন আমাদের খাবার। এগারোটায় ঢুকে গেলাম বইমেলায়। ওয়াও, কী সুন্দর! বই আর বই। হরেক রকম বই। অনেক বইয়ের দোকান। শিশু চত্বরে গিয়ে দেখি রঙের মেলা। রঙিন সব বইয়ের দোকান। রঙিন সব মজার মজার বই। যেন স্বপ্নপুরী! বইয়ের মাঝে হারিয়ে গেলাম আমরা। যেটি পড়ি সেটিই ভাল লাগে। একটা থেকে আরেকটা ভাল। কোন্টা রেখে কোন্টা কিনি! কয়েকটা বই কিনতেই টাকা শেষ! আমাদের দেখে জড়ো হলেন অনেকেই। কবি, লেখক, সাংবাদিক...। কয়েক জনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন হেড স্যার। অনেক বড় বড় লেখক। বিভিন্ন দিবসে স্কুলে পুরস্কার পেয়েছি তাঁদের বই। তোমাদের এসব বইয়ের লেখকও ছিলেন সেখানে। সময় কাটিয়েছেন আমাদের সঙ্গে। আদর করেছেন, গল্প করেছেন, অটোগ্রাফ দিয়েছেন। অনেক বই পড়তে বলেছেন। মাইমুনা বলল, হ্যাঁ, খুব মজা হয়েছে। নায়িম বলল, ইস! আমাদের হেড স্যার যদি...। নাসিফ বলল, আমাদের স্যারও ভাল। আমরা বলব, আগামী বইমেলায় আমাদের নিয়ে যেতে। মাহির বলল, আচ্ছা, এখন শোন, পরে কী ঘটল। আমাদের ফেরার সময় হলো। আগের কথা মতো জমা হলাম বটতলায়। সবার মুখে মুখে হাসি, হাতে হাতে বই। যেন বই দিবস। আমাদের সাক্ষাতকার নিলেন বিভিন্ন টিভির সাংবাদিক। এবার ফেরার পালা। এমন সময় জানা গেল, হাফসা আসেনি। হাফসার গ্রুপ টিচার বললেন, তাকে পাওয়া যাচ্ছেনা। সবার মুখ মলিন! হেড স্যার বললেন, সবাই এখানে দাঁড়াও চুপচাপ। কেউ ছোটাছুটি করবে না। যারা গ্রুপ টিচার, তারা খেয়াল রাখুন। যারা গ্রুপ টিচার নন, তারা খুঁজতে যান। ফোনে যোগাযোগ রাখবেন। ফিরে আসবেন পনেরো মিনিটের মধ্যে। আমরা প্রার্থনা করছি আর ভাবছি। কী হবে এখন! কী হবে এখন! পনেরো মিনিট যেন পনেরো দিন! ফোন আসে, সুখবর আসে না। একে একে ফিরে এলেন সব স্যার। কেউ খুঁজে পেলেন না হাফসাকে। কান্না শুরু করল হাফসার কয়েকজন ক্লাসমেট। কপাল মুছতে লাগলেন হেড স্যার। মেলার ঘোষণা মঞ্চে নিখোঁজ সংবাদ জানালেন বাংলা ম্যাডাম। মাইকে বার বার ভেসে আসছে ঘোষণা। ... হাফসা তুমি বটতলায় ফিরে এসো। কিন্তু ফিরে আসছে না হাফসা। সবাই ভাবছে, কী করা যায় এখন। হাফসার ক্লাসমেটদের সঙ্গে কান্না শুরু করল আরও অনেকেই। হেড স্যার বললেন, এবার আমি খোঁজতে যাই। তিথিমণি, দুর্জয়, তোমরা তো বই মেলায় এসেছ অনেকবার। তোমরা এসো আমার সঙ্গে। মাহির, মায়িশা, তোমরাও এসো। গেলাম শিশু চত্বরে। পেলাম না। গেলাম অন্য সবখানে। খোঁজলাম সব বইয়ের দোকানে। গেটের বাইরেও গেলাম। কোত্থাও পেলাম না! দুর্জয়ের কথায় আবার এলাম শিশু চত্বরে। সিসিমপুর মঞ্চে চলছে টুকটুকি, হালুম ও ইকরিদের খেলা। ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল দুর্জয়। তাকাল এদিক সেদিক, সবদিক। সামনে বসে এক মনে খেলা দেখছে হাফসা। কয়েকবার হাফসা, হাফসা... বলে ডাকল দুর্জয়। খেয়ালই করল না হাফসা। কাছে গিয়ে টোকা দিল মাথায়। হাফসা বলল, দুর্জয় ভাইয়া, দেখো কী মজার খেলা! দুর্জয় বলল, সবাই তোমাকে খোঁজছে। বাসায় যাবে না? এখন চলো। হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে এলো হাফসাকে। মায়ের মতো জড়িয়ে ধরলেন স্যার। আমরা ফিরে এলাম বটতলায়। তাকে পেয়ে নিশ্চিন্ত হলো সবাই। জানতে চাইল, কোথায় ছিল, কিভাবে ছিল...। দুর্জয় বলল, ইকরিদের খেলা দেখছিল মাছরাঙার মতো। ভিড়ের মাঝে বসেছিল এক মনে। মাথায় ক্যাপ নেই বলেই পাওয়া যাচ্ছিল না তাকে। স্যার বললেন, দেখলে তো, দলছুট হলে কী হয়? তাই দলছুট হতে মানা করেছিলাম তোমাদের। নিজের ভুল বুঝতে পেরে নীরব হাফসা। মায়িশা বলল, তোমার ক্যাপ কোথায়? বই কিননি তুমি? এবার কান্না জুড়ে দিল হাফসা। খেয়াল করল, হারিয়ে গেছে বই ও ক্যাপ। তাকে আদর করল সবাই। একটা বই দিল তিথিমণি। খুব খুশি হলো হাফসা। হাসি ফুটল সবার মুখে। স্যার বললেন, চলো, এখন ফিরে যাই। আজ আর সময় নেই। যাওয়া যাবে না সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে। দেখা হবে না স্বাধীনতা স্তম্ভ। পরে আসব একদিন। অনেক আনন্দ করে ফিরে এলাম বইমেলা থেকে। স্বাধীনতা স্তম্ভ কী? জানতে চাইল নায়িম। মাহির বলল, সেখানে তো যাইনি। স্যারের কাছে শুনেছি, সেখানেই আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তানী সেনারা। সেখানেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এখন শোন, কী হলো পরদিন। সকাল সাতটা। ক্লাস শুরু হয়নি তখনও। স্কুলের মাঠে পা রাখলেন হেড স্যার। ছুটে এলো ইউশা, শোয়াইব ও তাদের বন্ধুরা। বলল, স্যার, টিভিতে দেখেছি আপনাদের। সবাইকে নিয়ে গেলেন বই মেলায়। আমাদের তো নিলেন না। তাদের মাথায় হাত ভুলালেন স্যার। আদর করে নিয়ে গেলেন নিজের রুমে। বরাবরের মতো চকোলেট দিলেন হাতে হাতে। বললেন, এতজনের সঙ্গে কি যেতে পারতে তোমরা? হারিয়ে যেতে যদি বইমেলায়? ইউশা বলল, হারাব কেন স্যার? আমরা তো বড় হয়েছি। এখন ক্লাস টুতে পড়ি। স্যার বললেন, ঠিক আছে, তোমাদেরও নিয়ে যাব আগামীতে। হৈ হৈ করে উঠল তারা। ‘হাহ্ হা হুরে, বইমেলায় যাব রে’ ...। ফুফু এসে বললেন, খুব তো গল্প হলো। এখন সবাই ঘুমাতে যাও। নায়িম বলল, তোমাদের স্কুলে অনেক মজা, মাহির ভাইয়া। অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
×