ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

ফিরে দেখা ॥ ইতিহাস ও তেলিয়াপাড়া চা বাগান ম্যানেজারস বাংলো

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ৩১ মার্চ ২০১৮

ফিরে দেখা ॥ ইতিহাস ও তেলিয়াপাড়া চা বাগান ম্যানেজারস বাংলো

(শেষাংশ) সেই তিনটি ফোর্স হলো জেড ফোর্স (মেজর জিয়াউর রহমানের নামে), এস ফোর্স (মেজর শফিউল্লাহর নামে) এবং কে ফোর্স (মেজর খালেদ মোশারফের নামে)। সেদিনই এই তিনটি ফোর্সকে বিভিন্ন জায়গায় দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমি এস ফোর্সের সঙ্গে ছিলাম। আমার দায়িত্ব ছিল রসদ সরবরাহ ও ট্রেনিংয়ের স্থান নির্বাচন করা ও তথ্য সরবারহ করা। আমি এস ফোর্সের সঙ্গে মাধবপুরেই ছিলাম। এস ফোর্সের হেডকোয়ার্টার ছিল তেলিয়াপাড়ার সেই ডাক বাংলোটি। এটিকে বাঁশবাড়ী ক্যাম্পও বলত।’ সাক্ষী কাজী কবির উদ্দিনের মতোই এই মামলার অপর একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী মোহাম্মদ আলী পাঠান [সাক্ষী নং-৪] ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যদানকালে বলেন যে, ‘...৩ এপ্রিল, ১৯৭১ মেজর খালেদ মোশাররফ আমাদের এলাকায় আসেন। তিনি আমাকে এবং আমাদের এলাকার কাজী কবির উদ্দিনকে তার জীপে উঠিয়ে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে নিয়ে যান। চা বাগানের ম্যানেজারস বাংলোয় পৌঁছে তিনি জায়গাটি ভাল করে দেখেন এবং আমাদের বলেন তোমরা এই জায়গাটি দেখভাল কর। আগামীকাল এখানে একটি মিটিং হবে। এই বাংলোটি ত্রিপুরা সীমান্তে একটি ছোট্ট শহর সিমনার ঠিক উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। খালেদ মোশাররফ আমাদের সেখানে নির্দেশ দিয়ে চলে আসার পর রাতের মধ্যেই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু অফিসার ও সৈনিক সেখানে চলে আসেন এবং রাতের বেলায় তারাও এলাকাটি পাহারা দেয়। পরদিন সকাল ১০টার দিকে ডাকবাংলোয় বেশ কিছু বাঙালী সেনা কর্মকর্তা, অনেক রাজনৈতিক নেতারা এসে জড়ো হন। ভারতীয় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তৎকালীন কর্নেল এমএজি ওসমানী (এমএনএ) এবং তাঁর সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনী ব্রিঃ ভিসি পান্ডে ও বিএসএফের অনেক কর্মকর্তা বাংলোয় আসেন এবং তঁাঁরা একটি সভায় মিলিত হন। সেই সময় বাঙালী সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মেজর শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশারফ, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, লে. কর্নেল রেজা, ক্যাপ্টেন নাসিম, ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভুঁইয়া, লে. ইব্রাহিম, লে. হেলাল মোর্শেদ খান, লে. নাসির উদ্দিনসহ অনেকে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে এ্যাডভোকেট মোস্তফা আলী (এমএনএ), কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী এমএনএ, মোস্তফা শহিদ এমপিএ, গোপাল কৃষ্ণ মহারতœ এমপিএ, মৌলানা আসাদ আলী এমপিএ, মাহবুবুল হুদা ভুইয়া ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত মাহাবুব উদ্দিন চৌধুরীসহ অনেক রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতা উপস্থিত ছিলেন। মাহাবুব উদ্দিন চৌধুরী সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। এই সভায় মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিতভাবে পরিচালনা করার জন্য উল্লেখিত তিনটি ফোর্স গঠন করা হয়। মেজর শফিউল্লাহ সাহেব আমাকে তেলিয়াপাড়া থেকে ত্রিপুরার সীমানা পর্যন্ত একটি চলাচল উপযোগী রাস্তা তৈরি করার জন্য ও সীমানায় বসবাস করা মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিতে পারে এ রকম একটি অবস্থান তৈরি করার জন্য নির্দেশ দেন। তার নির্দেশে আমি চা বাগানের শ্রমিকদের নিয়ে এ কাজটি সম্পন্ন করি। আমি ‘এস ফোর্স’-এর অধীনে ছিলাম।” মামলা চলাকালে উল্লিখিত সাক্ষীগণের সাক্ষ্য থেকে এটা পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের সামরিক নেতৃবৃন্দ এই ম্যানেজারস বাংলোতে বসেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পরিকল্পনাটি সম্পন্ন করেছিলেন। ৩ নম্বর সেক্টরের সেক্টর জমান্ডার এস ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ বীর উত্তমের লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ’ (ভাষান্তর : ছিদ্দিকুর রহমান)-এ ওপরে উল্লিখিত সাক্ষীদের প্রদত্ত সাক্ষ্য অনুসমর্থিত হয়েছে। তিনি তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন “সিলেট এবং কুমিল্লায় যৌথ তৎপরতার পরিকল্পনা গৃহীত হওয়ার ফলে এবং পূর্ব-পশ্চিমে সিলেট থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া-ঢাকায় আমার কমান্ড এলাকা সম্প্রসারিত হওয়ায় আমার সদর দফতর কিশোরগঞ্জ থেকে মেঘনার পূর্ব দিকে তেলিয়াপাড়ায় স্থানান্তর করতে হয়। এ স্থানটি হচ্ছে আধা পাহাড়ী এলাকা। চা বাগানের শ্যামলী মায়ায় বিভূষিত। তেলিয়াপাড়া আমাদের জন্য এক নিরাপদ এলাকা। সেখান থেকে আমরা নিরাপদে অভিযান চালিয়ে যেতে এবং লোকদের প্রশিক্ষণ দিতে সক্ষম। তেলিয়াপাড়ায় আমাদের বসবাসের জন্য প্রচুর আবাসিক সুবিধা রয়েছে। কিন্তু সেখানে যাওয়া খুব সহজ নয়। মালবাহী বগিও সংখ্যায় কম। আমাদের যানবাহন পরিবহনের জন্য কতক আবৃত রেল ওয়াগনকে পরিবর্তন করতে হয়। কয়েকটি ওয়াগন ওয়েলডিং মেশিন দিয়ে কেটে আমাদের যানবাহন পরিবহন করার জন্য উপযোগী করা হয়। ৩ এপ্রিলের মধ্যে আমাদের যাত্রা শুরুর কাজ অনেক কষ্টে সম্পন্ন হয়। আমার অস্ত্রাগারে ইতোমধ্যে যে সব অস্ত্র যুক্ত হয়েছে সে সবের তালিকায় রয়েছে ১৫০০টি রাইফেল, ২০টি লাইট মেশিনগান, ১২টি স্টেনগান, ৩ লাখ ৩০৩ রাইফেলের গুলি। এগুলো আমি ময়মনসিংহ পুলিশ অস্ত্রাগার থেকে নিয়ে এসেছি।’ জনাব শফিউল্লাহ এই বইতে আরও উল্লেখ করেন ‘যখন আমরা সৈন্যদের যার যার এলাকায় সমাবেশ করার পদ্ধতি নির্ধারণে ব্যস্ত তখন চট্টগ্রাম থেকে মেজর জিয়া ৩ এপ্রিল আমার সঙ্গে এবং মেজর খালেদের সঙ্গে তেলিয়াপাড়ায় এসে সাক্ষাত করেন। তার এলাকা আরও সুদৃঢ় করার জন্য তিনি কিছুসংখ্যক নিয়মিত সৈনিকের জন্য অনুরোধ করেন। যদিও নিয়মিত সৈনিক ছেড়ে দেয়ার মতো অবস্থায় নই, তবু আমি এবং মেজর খালেদ উভয়ই প্রত্যেকের এক কোম্পানি সৈনিক মেজর জিয়াকে দিই। এ দুটি কোম্পানি এপ্রিলের ৫ তারিখে চট্টগ্রাম রওনা হয়।’ তিনি তাঁর বইতে আরও উল্লেখ করেন ‘৪ এপ্রিল হচ্ছে একটি স্মরণীয় দিন। তেলিয়াপাড়ায় বহু উচ্চপদস্থ অফিসারের আগমন ঘটে। কর্নেল এমএ জি ওসমানী, লে. কর্নেল আবদুর রব, লে. কর্নেল সালেহ উদ্দিন মোঃ রেজা, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর সাফায়েত জামিল, মেজর মাইনুল হোসেন চৌধুরী এবং অন্যরা আগমনের ফলে আমার ক্ষুদ্র সদর দফতর আনন্দ উত্তেজনায় ভরে ওঠে। আমি সবাইকে সাদর সম্ভাষণ জানাই। কর্নেল ওসমানীকে আমরা বৃহৎ গোঁফসহ দেখতে অভ্যস্ত। সেদিন তাঁর সেই বিখ্যাত গোঁফ ছিল না বলে তাঁকে চেনা মুশকিল হয়েছিল। পাকিস্তানের কাছ থেকে আত্মগোপনের জন্য তাঁর সেই গোঁফ জোড়া বিসর্জন দিতে হয়েছিল। গোঁফবিহীন ওসমানীকে চেনার জন্য আরেকবার তাকিয়ে দেখি তিনিই কি আমাদের ‘আঙ্কেল ওসমানী’ না আর কেউ। গোঁফ না থাকলেও গলার আওয়াজ ছিল সুপরিচিত।’ জেনারেল শফিউল্লাহ ৪ এপ্রিলে সামরিক কর্মকর্তাদের এই সমাবেশটিকে তাঁর বইতে মহিমান্বিত সমাবেশ বলে উল্লেখ করেছেন। মাধবপুর ডাইরেক্টরি নামে একটি বই সম্প্রতি প্রকাশিত হয়। সে বইটিতে তেলিয়াপাড়া চাবাগান বাংলোয় সমাবেশের বিষয়টি উত্থাপন করতে গিয়ে জনৈক লেখক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী উল্লেখ করেন যে, ‘এপ্রিলের প্রথম দিকেই তৎকালীন মেজর শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী, মেজর নুরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এজাজ, ক্যাপ্টেন নাসিম, ক্যাপ্টেন হায়দার, লে. ইব্রাহিম, লে. হেলাল মোর্শেদ ও লে. কবিরসহ অনেক সামরিক কর্মকর্তা মাধবপুর ডাকবাংলোয় ঘাঁটি তৈরি করেন এবং পাক বাহিনীকে প্রতিরোধ করেন। ৪ এপ্রিল ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। জেনারেল শফিউল্লাহর ভাষায় ‘একটি মহিমান্বিত সমাবেশ’। এ দিন তেলিয়াপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বহু উচ্চপদস্থ বাঙালী সামরিক অফিসারের আগমন ঘটে। কর্নেল এমএ জি ওসমানী ও পূর্বে উল্লিখিত অন্যান্য বাঙালী সামরিক অফিসাররা ছাড়া সেখানে আসেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার ব্রিঃ ভিসি পান্ডে ও আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. সায়গল। বেসামরিক রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী এমপিএ উপস্থিত হন। দফতর প্রধান মেজর শফিউল্লাহ তাদের স্বাগত জানান এবং কর্নেল ওসমানীর সভাপতিত্বে এক গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, মুক্তিযুদ্ধ একটি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পরিচালিত হবে এবং এর দায়িত্ব দেয়া হবে একজন প্রবীণ অফিসারকে। তাছাড়া রাজনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় যে, তারা রাজনীতিবিদদের একটি প্রবাসী সরকার গঠনের প্রস্তাব দেবেন। সে মোতাবেক এমএনএ ও এমপিএ এদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ শুরু করেন। ৪ এপ্রিলের সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয় যে, হানাদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ করার জন্য যে আনুষ্ঠানিক বাহিনী গঠন করা হবে, তার নাম হবে ‘মুক্তিবাহিনী’। জেনারেল ওসমানীকে মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এদিন চারজন আঞ্চলিক সামরিক কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। এরা হলেন মেজর শফিউল্লাহ, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের সামরিক নেতৃবৃন্দ একটি বেসামরিক সরকার গঠনের লক্ষ্যে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের (নির্বাচিত প্রতিনিধিদের) সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ অথবা তার পূর্বের কোন একদিন আগরতলায় মুজিবনগর সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলার আম্রকাননে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি বেসামরিক সরকার গঠিত হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সেই সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলামই ছিলেন প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই আমাদের মুক্তিবাহিনী ভারতের মিত্র বাহিনীর সহায়তায় সারা বাংলাদেশের পাক সেনাদের সঙ্গে কখনও সম্মুখ সমরে বা কখনও গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তাদের পরাস্ত করে। ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া ম্যানেজারস বাংলোয় তিনটি ফোর্স গঠন করার যে সিদ্ধান্ত আমাদের সামরিক কর্মকর্তরা গ্রহণ করেছিলেন তাঁর সমর্থন মেলে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ১১ এপ্রিলের বেতারের ভাষণ থেকে। তাঁর এই ভাষণের কিছু অংশ তুলে ধরা হলো। ‘Today a mighty army is being formed around the nucleus of professional soldiers from the Bengal Regiment and EPR who have rallied to the cause of the liberation struggle. These have been joined by the Police, Ansars and Mujahids and nwo by thousands of Awami League and other volunteers.... In the Sylhet/Comilla region, we have, commissioned Major Khaled Musharraf of the Bengal Regiment to take command of military operations in the region.... In Chittagong and Noakhali we have commissioned Major Zia Rahman of the Bengal Regiment to take full command of operations.... In the ¸mensingh/Tangail area, we have commissioned Major Safiullah of the Bengal regiment to take command of operations in the region.... The three commanders have already met and prepared a joint plan of battle designed to mop up surviving pockets of resistance in their respective areas preparatory to a combined onslaught on Dacca ... (মূল ভাষণটির ইংরেজী অনুবাদ, সূত্র : বাংলাদেশ ডকুমেন্টস ভলিউম-২) তেলিয়াপাড়ার চা বাগানের এই ডাক বাংলোটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি অন্যতম স্থান দখল করে আছে। এই ডাক বাংলোটিকে ‘মুক্তিযোদ্ধাদের’ জন্মস্থান হিসেবে আখ্যায়িত করলে ইতিহাসের সত্যতাই প্রমাণিত হবে। বর্তমানে এই দ্বিতল বাংলোটি ম্যানেজার বাংলো হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পৃথিবীর বহু দেশে এই ধরনের স্মৃতি সংবলিত কোন স্থাপনা অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে সে রকম কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। বাংলোর পাশে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলোটিকে একটি দেয়াল দিয়ে স্মৃতিসৌধ থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। তিনটি বাহিনী গঠন করে মুক্তিযুদ্ধ সুসংগঠিত করার বিরোচিত অম্লান স্মৃতি বিজরিত চা-বাগানের এই ‘বাংলো’কে চা-বাগানের ম্যানেজারের বাংলো হিসেবে ব্যবহার করা কি অপিরহার্য ছিল? বাগানের অন্য কোন স্থানে আরেকটি বাংলো নির্মাণ করে তা ম্যানেজারের বসবাসের জন্য রাখাটা কি একেবারেই অসম্ভব ছিল? জাতির অনন্য অর্জনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এমন কোন স্মৃতি হারিয়ে গেলে কষ্ট হয়। আমার বিশ্বাস এটি স্বাধীনতাকামী সকলেরই কষ্ট। ১৯৭১ এর সেদিনের সেই স্মৃতিকে সংরক্ষণের জন্য বাংলোর এই স্থানটিকে একটি ‘জাদুঘরে’ রূপান্তর করলে বিশেষ করে দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিরোচিত০ পাতায় নিবিষ্ট হতে পারবে। ইতিহাস জানতে পারবে। সত্যটি সামনে উদ্ভাসিত হবে। আমাদের দায়িত্ব এই প্রিয় স্বদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সত্য ও ইতিহাস কার্যকরভাবে সংরক্ষণ করা। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের সচেতন প্রয়াসে এগিয়ে আসতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ম্যানেজারস ডাক বাংলোটির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকালীন যে অনন্য এক স্মৃতি ও সত্য মিশে আছে সেটিকে ‘ঐতিহাসিক স্মৃতি’ বিবেচনায় যথাযথ মর্যাদায় চা-বাগানের এই বাংলোটির সংরক্ষণের আশু উদ্যোগ নিবেন। লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২
×