ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাংস্কৃতিক আঙ্গিনায় পথচলা জুলী

প্রকাশিত: ০৭:১৯, ৩০ মার্চ ২০১৮

 সাংস্কৃতিক আঙ্গিনায়  পথচলা জুলী

চট্টগ্রামের কাট্টলী মুন্সীপাড়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ইসমত আরা জুলীর জন্ম। মাতামহ মরহুম ওসমান গনি চৌধুরী ছিলেন ১৯২০ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএসসি বিএড করা। ভারত উপমহাদেশে তখন হাতেগোনা যেত কতজন মুসলমান ডিগ্রী পদবিধারী। পিতাও ছিলেন দক্ষ ব্যাংক কর্মকর্তা। মা আনজুমান আরা ছিলেন শিক্ষক পিতার আদর্শে বড় হওয়া তৎকালীন সময়ের একজন স্বশিক্ষিতা নারী। পারিবারিক এমন স্নিগ্ধ আবহে গড়ে ওঠা জুলীও ছিলেন বাল্যকাল থেকে শিক্ষায় সংস্কৃতি আর চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে নিজেকে তৈরি করার এক অদম্য প্রত্যয়ী নারী। সঙ্গত কারণে শিক্ষা জীবনের সুবর্ণ সময়গুলো কেটেছে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে। অর্পণা চরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজে ভর্তি হয়। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করে ভর্তি হন উচ্চতর ডিগ্রী নিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী সাহিত্যে। এরপর শুধু এগিয়ে যাওয়া। ইংরেজী সাহিত্যে পড়াশোনা চালিয়ে গেলেও মাতৃভাষাকে অন্যতম মর্যাদায় জীবনের অনুষঙ্গ করে নিতে দ্বিধা করেননি। ফলে বিদেশী ভাষায় নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেও সৃজন আর কর্মদ্যোতনাকে নিয়তই চালিত করেন মায়ের ভাষায়। এই এক অপরিমেয় দেশের প্রতি মমত্ববোধ যা বিশ্বজনীনতার বিস্তৃত বলয়ে ও মাতৃভাষাকে সমমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। জুলী সেই মানেরই একজন বাঙালী নারী যিনি পরবর্তীতে North South university থেকে ইংরেজী ভাষাতত্ত্বে স্নাতকোত্তর সম্মান অর্জন করেও তার পুরো কর্ম আর যাপিতজীবন বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। ছোট বয়স থেকেই লেখার প্রতি ঝোঁক ছিল। লেখাপড়া আর নিজেকে তৈরি করার পথপরিক্রমায় সেই বোধ আর দক্ষতা আরও জোরালো হয়েছে। চট্টগ্রামে দৈনিক আজাদীর আগামীদের আসরে নিয়মিত গল্প, ছড়া, কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতেন। এমন শৈল্পিক ক্ষমতায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়ে নিজের কৃতিত্বকে প্রমাণ করেছেন। কলেজ জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তগুলো ভরিয়ে তুলেছেন বিভিন্ন কর্মযজ্ঞে নিজেকে সম্পৃক্ত করে। বাংলাদেশ বেতারে সংবাদ পাঠ, অনুষ্ঠান সঞ্চালনাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আঙ্গিনায়ও সদর্পে বিচরণ করেছেন। নীলাম্বরী খেলাঘর আসরের সদস্য জুলী সংশ্লিষ্ট সংগঠনের শৈল্পিক বোধকে লালন করে তার জীবনের প্রয়োজনীয় সময়গুলো পার করে। দুটি বেসরকারী ব্যাংকে কর্মজীবন শুরু করে বেশ কয়েক বছর এই পেশার সঙ্গে জড়িতও ছিলেন। কিন্তু সৃজনচেতনায় যার মন-প্রাণ নিমগ্নতাকে তো সেই দিকেই গন্তব্য স্থির করতে হবে। এ ছাড়া আর কোন গত্যন্তরও থাকে না। জুলীর বেলায়ও তাই হয়েছে। কর্মজীবনের সমস্ত সম্ভাবনাকে পেছনে ফেলে অনিশ্চিত সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে সাহসের সঙ্গে পা রাখলেন। যে নান্দনিক বোধ তাকে প্রতিনিয়ত তাড়িত করে সেই ঋদ্ধ চেতনায় নিজেকে সমর্পণ করেন কবিতার স্বাপ্নিক অনুভবে। জীবন ও সমাজের সচিত্র প্রতিবেদন কবিতা। জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা যেমন বর্বরতার অনুষঙ্গ হয় একইভাবে কঠিন সমাজের নির্মম অনুশাসন ও সৃজনচেতনায় ঝঙ্কার তোলে। সেই বোধে প্রাত্যহিক যাপিতজীবন এবং বিধিবদ্ধ সামাজিক ব্যবস্থায় কবিতা কখনও রঙিন আবীর ছড়ায় নতুবা জীবনযুদ্ধে সামাজিক অব্যবস্থার কাছে বলী হয়। জুলীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘হতে চাইনি ডক্টর ফস্টাস’ বইটি প্রথম প্রকাশ পায় ২০১৭ সালের ভাষার মাসে। মানুষ, প্রকৃতি, শাশ্বত প্রেম আর বহমান সামাজিক আলোয় একাত্ম হয়ে কবিতার গতি নির্ণয় করে। নির্দিষ্ট গন্তব্যে এগিয়ে যায় শেষ অবধি পরিণতিও লাভ করে। জুলীর অপর কাব্যগ্রন্থ ‘নাফ নদীর তীরে’ বের হয়ে প্রায়ই এক বছর পর অর্থাৎ ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। বইটি মূলত বাস্তুচ্যুত বিতাড়িত, নিগৃহীত রোহিঙ্গাদের নিয়ে এক দুঃসহ শৈল্পিক তাড়না। কাব্যগ্রন্থটির প্রথম কবিতাটি শুরু করা হয় শান্তিতে নোবেলজয়ী মিয়ানমারের জাতীয় নেতা আউং সান সুচিকে নিয়েই। অশান্ত রাখাইন অঞ্চল আজ জ্বলছে প্রচ- দাবানলে। যে দেশে শান্তি নামক মহান শব্দটি নির্বাসিত সেখানে নোবেল জয়ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। পুরো বইটিতে আছে নাফ নদীতে রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত রোহিঙ্গাদের ভাসমান জীবনের করুণ, নির্মম পঙ্ক্তিমালা। সমাজসচেতন জুলী এই নিরেট বাস্তবতাকে তার কবিতার উপজীব্য করে অসহায় রোহিঙ্গাদের যাপিত জীবনকে যে মাত্রায় শৈল্পিক শৈলীতে নির্মাণ করেছেন সেখানে তার সৃজনদ্যোতনা সাবলীল মনন চৈতন্যের এক সুষ্ঠু সমন্বিত নান্দনিক সৌধ। যে ইমারত গড়তে গিয়ে তার কাব্যিক মহিমা যেমন তাড়িত হয়েছে একইভাবে মানবিক বোধও তাকে বিতাড়িত অভিবাসীদের অনুগামী করেছে। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×