ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রং বেরঙের চুড়ি তবু বর্ণহীন জীবন

প্রকাশিত: ০৭:১৭, ৩০ মার্চ ২০১৮

রং বেরঙের চুড়ি তবু বর্ণহীন জীবন

বাহারি রঙের চুড়িতে সাজছে নারীর হাত। রঙের ঝলকানি আর বাতাসে চুড়ির ঝনঝনানি সহসাই দৃষ্টি কারে সৌন্দর্যপ্রিয় প্রতিটি নারীর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ডাস চত্বর। ছোট-বড়, ছাত্র-শিক্ষক নির্বিশেষে সকলের তিনি ‘খালা’। নাম কৈতোরী বেগম। জন্ম ঢাকাতেই। মায়ের বাড়ি ফরিদপুর। শ্বশুরবাড়ি বিক্রমপুর। স্বামী আর দুই কন্যা সন্তান নিয়ে বর্তমান অবস্থান ঢাকার কামরাঙ্গীরচর। থাকেন ভাড়া বাসায়। পেশায় একজন কাঁচের চুড়ি বিক্রেতা। চকবাজার থেকে পাইকারি দরে চুড়ি কিনে বিক্রি করেন টিএসসি মোড়ে। ১০টি বছর ধরে কাঁচের চুড়ির ভাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন ওতপ্রোতভাবে। হাতে চুড়ি পরিয়ে দেওয়ার পর তরুণীর মুখের হাস্যোজ্জ্বল খুশিতেই তিনি খুঁজে ফেরেন তার সংসারের সুখ। সকল বাধা বিপত্তি মাড়িয়ে এ কাজের মধ্য দিয়েই তিনি শক্ত হাতে ধরে রেখেছেন তার সংসারের হাল। একটু সচ্ছলতা আর দুই সন্তানের মুখে দুবেলা খাবারের নিশ্চয়তা যোগাতে আটটি বছর মাথায় চুড়ির ঝুড়ি নিয়ে ফেরি করে বেরিয়েছেন ঢাকা শহরের প্রতিটি গলি। ঝড়, বৃষ্টি, উত্তপ্ত দিন কিংবা রাত আটকে রাখতে পারেনি তার নিত্যদিনের বেচাকিনি থেকে। প্রয়োজনের কাছে হার মেনেছে শারীরিক অসুস্থতাও। কৈতোরী বেগমের স্বামী চুড়ির কারখানায় একজন দিনমজুর। চুড়ি প্যাকিং তার কাজ। স্বামীর একার উপার্জনে বর্তমান সময়ে চার জনের উদর পূর্তি নিতান্তই কষ্টের। ক্ষুধা আর দারিদ্র্য ভোর না হতেই কড়া নাড়ে ঘুনে খাওয়া দরজায়। যথসামান্য এ অর্থে নড়বড়ে জীবনের চাকা যেন আর সামনে এগোয় না। তাই টিকে থাকার প্রয়োজনে আর সংসারটিকে অসময়ে অন্ধকারের অতলে না হারানোর জন্য বিয়ের ১৫ বছর পর বেছে নিলেন কাঁচের চুড়ির ব্যবসা। যদিও এটা তাদের বংশগত পেশা, তার ভাষায়, ‘জাতি পেশা’। তার মা নৌকায় করে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কাঁচের চুড়ি ফেরি করতেন। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি ও তার এক বোন এ পেশাকে জীবিকা হিসেবে বেছে নিলেও বর্তমানে তিনি একাই এ পেশার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তিনি নির্দ্বিধায় চালিয়ে যাচ্ছেন তার ব্যবসা। তিনি বলেন, ছাত্রছাত্রীরা সকলেই তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে। শত কষ্টের মাঝেও চুড়ির রং, ডিজাইন আর শব্দ থেকে জোগান দেওয়ার চেষ্টা করেন অন্ন, বস্ত্রের। সংসারের অভাবকে চুড়ির রঙে ঢেকে সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখে রাঙিয়ে তুলছেন রমণীর হাত। নিক্কনে চাপা পড়েছে দরিদ্রতার কান্না। উদ্দেশ্য একটাই মেয়ে দুটো ভালভাবে বাঁচুক। ওরা পড়ালেখা শিখুক। মানুষ হোক। তার যতই কষ্ট হোক না কেন নিজের সাধ্যের মধ্যে থেকে মেয়ে দুটিকে কিছুটা হলেও স্বাচ্ছ্যন্দ্যে রাখার চেষ্টা করেন সর্বদা। তার বড় মেয়েটির বয়স একুশ বছর আর ছোট মেয়ে সতের। এই কষ্টার্জিত অর্থেই বড় মেয়েকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছেন। ধর্মীয় শিক্ষায় করেছেন শিক্ষিত। ছোট মেয়ে নবম শ্রেণীতে পড়ে, একই সঙ্গে কোরআন শিক্ষা নিচ্ছে। নিজে চুড়ির ব্যবসা করলেও তিনি বলেন, তাদের পরবর্তী বংশধর এ কাজ করবে না। বড় মেয়েকে বিয়ে দিলেও ছোট মেয়েকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। মেয়েটিকে পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করতে চায় সে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্রছাত্রীদের ভিরে সে স্বপ্ন দেখে তার ছোট মেয়েটিও হয়তো একদিন এখানে পড়বে। স্বামী-স্ত্রী দু’জনের আয়ে বিলাসিতার জীবন না হলেও বর্তমানে স্বাচ্ছন্দ্যে অতিবাহিত হচ্ছে তাদের সংসার। নিজের কোন বাড়ি এখনও না হলেও কামরাঙ্গীরচরের খোলামোড়য় কিনেছেন এক কাঠা জমি। প্রিয় হাত বর্ণিল কাঁচের চুড়িতে রাঙিয়ে হেঁটে যায় প্রিয়দর্শিনী- পিছনে পরে থাকে কৈতোরী বেগমদের বর্ণহীন জীবন। যে জীবন লড়াইয়ের, সংগ্রামের।
×