ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

বীর মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবির চলে যাওয়া

প্রকাশিত: ০৭:১৭, ৩০ মার্চ ২০১৮

বীর মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবির চলে যাওয়া

স্বাধীনতার মাস মার্চ আসলেই দুঃসহ স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় হাজারো মুক্তিযোদ্ধার আত্মোৎস্বর্গ, অগণিত মা-বোনের লাঞ্ছনা এবং দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অকাতরে প্রাণহরণ। মুক্তির লড়াইয়ের নয় মাস ছিল অদম্য সাহস আর দৃপ্ত মনোবলে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সম্মুখ সমরে জীবনবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়া। সেই রক্তাক্ত অধ্যায় ছিল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সার্বিক অংশগ্রহণে যুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতি শুধু মোকাবেলাই নয়, ধীরস্থির মননে বিপরীত ঘটনাপ্রবাহকে সামলানোও। মার্চের অগ্নিঝরা দিনগুলো থেকে শুরু হওয়া এই ক্ষত-বিক্ষত পথপরিক্রমায় বিজয় নিশান ছিনিয়ে আনতে জাতিকে যা দিতে হয়েছিল তা শুধু মর্মান্তিকই নয় এক অবর্ণনীয় অভিঘাতের করুণ আখ্যানও বটে। যুদ্ধ শুধু লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধার প্রাণ সংহারই করেনি ২ লাখ মা-বোনকেও দিতে হয়েছিল তাদের অমূল্য সম্পদ। এমনই এক মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবি যিনি সম্ভ্রম হারিয়েই নিঃস্ব হননি তার চেয়ে বেশি মুখোমুখি সংঘর্ষে অংশ নিয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর তথ্য উপাত্ত পৌঁছে দিতেন। স্বাধীনতার এই গৌরব আর বিজয়ী মাস মার্চের ২২ তারিখ এই লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা না ফেরার দেশে প্রস্থান করলেন। মুক্তিযুদ্ধ করলেন, সম্ভ্রম হারালেন, অনেক বেদনায় স্বীকৃতিও মিলল কিন্তু জীবদ্দশায় তার কোন সুফল দেখে যেতে পারলেন না। কাঁকন বিবি যার পৈত্রিক নাম কাঁকাত হেনিন চিন্তা। নামই জানিয়ে দেয় তিনি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বংশোদ্ভূত। খাসিয়া উপজাতি পরিবারে জন্ম নেয়া এই কাঁকাতের পূর্ব পুরুষের আদি নিবাস ছিল ভারতের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে এক প্রত্যন্ত গ্রামে। পরবর্তীতে তারা সিলেটের সুনামগঞ্জে নিজেদের নিবাস গড়ে তোলে। ১৯৭০ সালের বৈবাহিক বন্ধন এই কাঁকাতের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি না হওয়ার মূল্য দিতে গিয়ে জাতি, ধর্ম সবই হারাতে হয়েছে। পছন্দের মানুষ দিরাই উপজেলার শহীদ আলীকে বিয়ে করে ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে নামটাও পাল্টে ফেলেন। কাঁকাত থেকে হয়ে যান কাঁকন বিবি। ধর্মীয় বন্ধনের কারণে নূরজাহান বেগম নামটিও ধারণ করতে হয়। বিয়ের এক বছরের মাথায় স্বাধীনতা যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ একমাত্র কন্যা সখিনার জন্ম হয়। এখানেও দুর্ভাগ্য তাকে তাড়া করে। কন্যা সন্তানের কারণে স্বামীর সঙ্গে তার শুধু দূরত্বই তৈরি হয়নি এক সময় শহীদ আলী স্ত্রী ও কন্যাকে ফেলে রেখে কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তার খোঁজ আর কখনও পায়নি কাঁকন বিবি। অল্প কিছু দিনের মধ্যে আবারও এক নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। যুদ্ধের অনেকটা শুরুর দিকে এপ্রিল মাসে ইপিআর সৈনিক মজিদ খানের সঙ্গে পুনরায় বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্বামী কর্মসূত্রে সিলেটে ইপিআর ক্যাম্পে থাকতেন। দুই মাস পর কন্যা সখিনাকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে ছুটে যান। তবে ফিরে আসার পর দেখেন তার দ্বিতীয় স্বামীটিও নিখোঁজ। বিভিন্ন খবরে জানতে পারে স্বামী বদলি হয়ে সীমান্ত এলাকায় কোন এক ক্যাম্পে চলে যান। জীবনের এমন সব টানাপোড়েনে আরও এক মহাসঙ্কট এসে পুরো জীবনটাই তছনছ করে দেয়। ১৯৭১-এর জুন মাসে তিনি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। নিজেদের ক্যাম্পে নিয়ে উপর্যুপরি নির্যাতন চালিয়ে পাকসেনারা এক সময় তাকে বাইরে ফেলেও দেয়। রাগে, দুঃখে, অপমানে আর প্রতিহিংসায় সরল, শান্ত কাঁকন ক্ষিপ্ত হয়ে স্বামীর আশা ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। এমন বিপন্ন আর অসহায় অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়াকেই সে সময় তার কাছে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছিল। যেমন ভাবা সেভাবে সম্পৃক্ত হওয়া কাঁকন আর পেছনের দিকে ফিরে থাকাননি। বীরদর্পে মুক্তিযুদ্ধের সামনাসামনি লড়াইয়ে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। সেই উদ্যোমে যুদ্ধের পরবর্তী সময়গুলোতে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে উজাড়ও করে দিলেন। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন হলে তিনি গুপ্তচরের ভূমিকায় নিজেকে শামিল করান। পাকিস্তানী ক্যাম্পে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করতেন। কাঁকনের এই তথ্য প্রদান মুক্তি সৈনিকদের শুধু সম্মুখ সঙ্কট থেকে রক্ষাই করেনি, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকেও হরেক রকম সংঘর্ষের আবর্তে পড়তে হয়েছিল। যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক লড়াকু সংযোজন। গুপ্তচরবৃত্তি করার সময় আবারও পাকবাহিনীর হাতে ধৃত হয়ে অসহনীয় নিপীড়নের শিকার হন। এক নাগারে সাতদিন নির্মম অত্যাচার চালানোর পর অজ্ঞান অবস্থায় কাঁকনকে ফেলে দেয়া হয়। এক সময় সুস্থ হলে আবারও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছাকাছি চলে আসেন তিনি। এবার আর শুধু সংবাদ সরবরাহ নয় একেবারে রক্তাক্ত লড়াইয়ে নিজেকে পুরোপুরি জড়িয়ে নেয়া। সেই লক্ষ্যে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে পাকিস্তানীদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে শামিল হয়েছেন। কথিত আছে প্রায়ই ২০টি সশস্ত্র সংগ্রামে কাঁকন বিবি অংশ নিয়েছিলেন। গুলির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন। সেই ক্ষতচিহ্ন জীবনের শেষ দিন অবধি ছিল। তবে এই লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা তার নিঃস্বার্থ অবদান নিয়েও দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন। স্বাধীনতার প্রায়ই ২৫ বছর পর ১৯৯৬ সালে সিলেটের এক স্থানীয় সাংবাদিকের নজরে পড়ায় এই বীর মুক্তিযোদ্ধার লোমহর্ষক কাহিনী সবাই জানতে পারে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাঁকন বিবির যুদ্ধে বীরোচিত অধ্যায়কে যথাযথ সম্মান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিও দেন। শুধু তাই নয়, খাস জমি বণ্টন করে ছোট্ট একটি আবাসস্থলও তৈরি করে দেয়া হয়। এর পরও কাঁকনের আর্থিক দুরবস্থার অবসান হয়নি। অর্থের অভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাটুকু করাতেও ব্যর্থ হয়েছেন। অনাহারে, অর্ধাহারে জীবনপাতও করতে হয়েছে। প্রথম সারির এই রকম একজন মুক্তিযোদ্ধার দুঃসহ জীবন স্বাধীন ভূমিতে সত্যিই দুঃখজনক। তার একমাত্র কন্যা সখিনা সন্তানদের নিয়েও অসহায়ভাবে জীবনযাপন করছেন। মায়ের প্রাপ্য মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দকৃত ভাতা যেন তার একমাত্র উত্তরসূরিকে দেয়া হয় এই দায় দেশের সব মানুষের।
×