ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ কাদির

পৃথিবীর পাঠশালায় পাঠ নেয়া এক চিত্রশিল্পী

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ৩০ মার্চ ২০১৮

পৃথিবীর পাঠশালায়  পাঠ নেয়া  এক  চিত্রশিল্পী

এই সময়ের এক তরুণ প্রশ্রুতিশীল চিত্রশিল্পী হারুণ ফকির। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় দেশের বিখ্যাত ভাস্কর এবং চিত্রশিল্পী হামিদুজ্জামান খানের মাধ্যমে। প্রথম সাক্ষাতে তাঁর শ্মশ্রুমন্ডিত বেশভুষায় মনে হয়েছিল হয়ত হামিদ স্যারের চারুকলার কোন ছাত্র হবেন তিনি। প্রথম পরিচয়ে জিজ্ঞাসাও করেছিলাম, ‘আপনি কী স্যারের ছাত্র?’ উত্তরে জেনেছিলাম তিনি স্যারের সরাসরি ছাত্র নন। এমনকি চারুকলায় কখনও প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখাও করেননি। ঢাকা কলেজ থেকে মনোবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন। এখন পেট্রলপাম্প, সিএনজি ফুয়েল স্টেশন, গাড়ির পার্টস, গাড়ি সার্ভিসিং ইত্যাদি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছেন। তবে স্যারের সঙ্গে থাকেন এবং ছবি আঁকেন। স্যারের সঙ্গে থেকে ছবি আঁকেন! আমি ভেবেছিলাম হয়ত স্যারের সঙ্গে থেকে সবেমাত্র ছবি আঁকার ক খ পাঠ নিচ্ছেন। কিন্তু অল্প ক’দিনের মধ্যেই আমার সেই ধারণা পাল্টে যায়। আমি জানতে পারি হারুণ ফকির একজন পুরোদস্তুর চিত্রশিল্পী। ইতিমধ্যে সহস্রাধিক ছবি এঁকেছেন এবং বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির গ্যালারি অফ ফাইন আর্টসে তাঁর একটি একক চিত্র প্রদর্শনীও অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিছুদিন পর একই স্থানে দ্বিতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এরপর অনেকদিন বিরতি। গত জানুয়ারি মাসের শুরুতে হামিদ স্যারের সঙ্গে আলাপে জানতে পারলাম বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির গ্যালারি অফ ফাইন আর্টসে হারুণ ফকিরের দ্বিতীয় একক চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ২৬ জানয়ারি থেকে। স্যারই চিত্রপ্রদর্শনীটর আয়োজক হিসেবে আমাকে আমন্ত্রণও জানালেন। এর মধ্যে একদিন হারুণ ফকিরের তেজগাঁওস্থ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লাগোয়া স্টুডিওতেও গেলাম। দেখলাম শিল্পীর আপন ভুবন। সেখানে গিয়ে যা দেখলাম সত্যিই অবাক এবং বিস্মিত হলাম। চারুকলার প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ না নিয়েও যে, শিল্পী হয়ে ওঠা যায় সেটি হারুণ ফকিরকে দেখে বুঝলাম। তাঁর কছে জানতেই চাইলাম কীভাবে শিল্পের ভুবনে আগমন ঘটল? যা জানলাম সেটি হচ্ছে-তাঁর পরিবারে শিল্প চর্চা জিনিসটি ছিল। এমনকি তার বড় ভাইয়ের একটি আর্ট গ্যালারিও ছিল। বছর পাঁচেক আগে তিনি নিজে কোন এক বিপদে পড়েন। যার কারণে মানসিকভাবে প্রচ- ভেঙ্গে পড়েন। এ রকম একটি বিদ্ধস্ত সময়েই সিদ্ধান্ত নেন যে, শিল্প কর্মের মাঝে তিনি শান্তি খোঁজার চেষ্টা করবেন এবং নিজেও একটি আর্ট গ্যালারি বানাবেন। এই লক্ষে বিভিন্ন বিখ্যাত শিল্পীর শিল্পকর্ম সংগ্রহ করতে শুরু করেন। এই সময়েই হামিদ স্যারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পরিচয়টি অল্প সময়েই গভীরতা লাভ করে। বেশিরভাগ সময় হামিদ স্যারের সঙ্গে কাটানোর চেষ্টা করেন; নিয়মিত স্যারের স্টুডিওতে যাতায়াত শুরু করেন। হামিদ স্যারের আঁকা দেখতে থাকেন। সেই সঙ্গে স্যারের স্ত্রী খ্যাতিমান ভাস্কর, চিত্রশিল্পী আইভি জামানেরও আঁকা দেখেন। এই দেখতে দেখতেই ভাবেন যে, নিজেও আঁকা শুরু করা যায় কীনা? সত্যি সত্যি একদিন একটি তৈলচিত্র এঁকেও ফেলেন। হামিদ স্যারকে দেখান। স্যার দারুণভাবে উৎসাহ দেন। এই উৎসাহই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। বিরামহীন আঁকা শুরু করেন। অল্পদিনের মধ্যেই এঁকে ফেলেন শতাধিক চিত্রকর্ম। এই সীমাহীন আগ্রহ দেখে হামিদ স্যার নিজেই উদ্যোগ নিয়ে তাঁর ৪০টি বাছাই করা চিত্রকর্ম নিয়ে প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। আরও বেশি অনুপ্রাণিত হন শিল্পী হারুণ ফকির। আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় অনেক। যার ফলশ্রুতিতে ব্যবসায়ী হারুণ ফকিরের বাইরেও তিনি হয়ে ওঠেন একজন চিত্রশিল্পী। এক্ষেত্রে বলব যে একজন আদর্শ গুরু বা শিক্ষক (হামিদুজ্জামান খান) একজন মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদহারণ একজন হারুণ ফকির। ২৬ জানুয়ারি হারুণ ফকিরের দ্বিতীয় একক চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাজির হলাম যথাসময়ে। হামিদ স্যারের সভাপতিত্বে চিত্রসমালোচক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। উপস্থিত ছিলেন জাতীয় বিশ্বদ্যিালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুণ অর রশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নেসার হোসেনসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। শিল্পের ভুবনে হারুণ ফকিরের আগমনটি সত্যিই এক ব্যতিক্রম। চিত্রকর্মের চর্চা করছেন মাত্র চার বছর। চার বছরের মধ্যে দ্বিতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী এটিও অনেকটা ব্যতিক্রম ঘটনা। হারুণ ফকিরের শিল্পকর্ম নিয়ে বলতে গেলে দেখা যায় প্রকৃতিই তাঁর শিল্পকর্মের প্রধান উপজীব্য বিষয়। প্রকৃতির নানা রং এবং রূপ তাঁর চিত্রকর্মে ফুটে উঠেছে। প্রকৃতি যে কতটা বর্ণিল হতে পারে সেটি তার চিত্রকর্মে খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর চিত্রকর্মে গোধূলি বেলার বর্ণিল পৃথিবীকে আমরা খুঁজে পাই। মেঘেদের খেলা দেখতে পাই। আবার তিনি বিষাদে ভরা আত্মপ্রকৃতিও এঁকেছেন সুনিপুণভাবে। আবার একটি চিত্রকর্মে আনন্দের উৎফুল্লতায় এক নারী চরিত্রকে নৃত্যরতও দেখা যায়। কোন কোন চিত্রকর্ম দেখে মনে হয় যেন পৃথিবীর সব রং এসে তাঁর হাতে সনিপুণভাবে ধরা দিয়েছে। রংধনুর যেমন সাত রং আছে; পৃথিবীতে যেমন হাসি, আনন্দ, দুঃখ, বেদনা সবই আছে তেমনি তাঁর চিত্রকর্মেও আমরা সব আবেগকেই খুঁজে পাই; রংধনুর সব রংকেও খুঁজে পাই। শিল্পী হারুণ ফকির এত অল্প সময়ে শিল্পের এত গভীরে যে পৌঁছে গেছেন এটিও যেন এক অপার বিস্ময়। তাঁর চিত্রকর্মে আর একটি বিষয় আমি বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছি সেটি হচ্ছে বিশালতা। তিনি বিশাল বিশাল ক্যানভাসে জীবনের নানা আবেগকে ধরতে পছন্দ করেন। হয়ত আমাদের এই বিরাট পৃথিবীটাকে তিনি বিশালকায়ভাবেই দেখতে পছন্দ করেন। যার কারণে তাঁর চিত্রকর্মে আমরা বিশালতা খুঁজে পাই। চিত্রশিল্পী হারুণ ফকিরের কাজ আমাদের ভাবনার গভীরতায় পৌঁছে দেয়। পৃথিবীতে যে নানা রং, রূপ, স্বাদ, বর্ণ আছে তাঁর কাজ আমাদের সেটিই উপলব্ধি করতে শেখায়। হারুণ ফকির চিত্রকর্ম বা শিল্পকর্মের উপর কোন প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ নেননি। কিন্তু তাঁর কাজ মনে করিয়ে দেয় যে আমাদের এই বিশাল পৃথিবীটাই তাঁর পাঠশালা। অনন্তকাল তাঁর চিত্রকর্ম জীবনের জয়গান গেয়ে যাবে আমরা সেটিই প্রত্যাশা করব।
×