ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মহামূল্যবান যে ধাঁধাটি রেখে গেছেন...

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ৩০ মার্চ ২০১৮

মহামূল্যবান যে ধাঁধাটি  রেখে গেছেন...

স্টিফেন হকিং আর নেই। তবে তিনি রেখে গেছেন অবিশ্বাস রকমের মূল্যবান এক ধাঁধা। সেই ধাঁধা এতই জটিল, এতই ভয়াবহ বিহ্বল করে দেয়ার মতো যে এর সমাধান বের করতে গিয়ে বিজ্ঞানীদের আগামী বহু বছর ধরে রীতিমতো মল্লযুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হবে। ড. হকিংয়ের সেই ধাঁধাটি হলো আজকের পদার্থবিজ্ঞানের সম্ভবত সবচেয়ে বড় প্রশ্নটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেটা হচ্ছে মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান কি করে করা সম্ভব? বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বিজ্ঞানের জগতে দুটি অবিস্মরণীয় বিপ্লব ঘটতে দেখা গেছে। এর একটা ছিল আপেক্ষিক তত্ত্ব। এলবার্ট আইনস্টাইনের নেতৃত্বে পদার্থবিজ্ঞানীরা আইজাক নিউটনের পরম (absolnte) স্থান-কাল ধারণাটি বাতিল করে দিয়ে সে জায়গায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সমন্বিত (nified) চতুর্মাত্রিক স্থান-কাল তত্ত্ব। আইনস্টাইন উপলব্ধি করেছিলেন যে এই তত্ত্বের মধ্যেই রয়েছে স্থান-কালের যত রহস্যের সুতা এবং আমি ও আপনি মাধ্যাকর্ষণ শক্তি হিসেবে যা অনুভব করি তা এ থেকেই উদ্ভূত। অপর বিপ্লবটি আপেক্ষিক তত্ত্বের চাইতে আরও বেশি সুগভীর। সেটা হলো কোয়ান্টাম মেকানিক্স। আমরা অতি পারমাণবিক (Subatomic) কণার আচরণ পরীক্ষা করতে গিয়ে লক্ষ্য করেছি যে সেগুলোকে চিরায়ত (classical) পদার্থবিজ্ঞানের ঘড়ির কাঁটার ভাষায় বর্ণনা বা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। বরং সেগুলো সম্ভাবনার তরঙ্গের আকারে হাজির হয়। আর তা থেকে বড়জোর যে কাজটুকু আমরা করতে পারি তা হলো কোন নির্দিষ্ট পরিমিতি থেকে এই ফল বা ওই ফল পাওয়া যাবে সেই সম্ভাবনাটা হিসাব করে দেখা। ভৌত জগত সম্পর্কে আমরা যা কিছুই জানি ক্রমান্বয়ে তার সবকিছুই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আওতায় স্থাপন করা হয়েছে। পদার্থ, বিদ্যুত ও চৌম্বক ক্রিয়ার আচরণ এবং এটম বা অণুর কেন্দ্রভাগের ভেতরে ক্রিয়াশীল অতি পারমাণবিক শক্তিগুলো-সবকিছুই কোয়ান্টাম তত্ত্ব দিয়ে দারুণ সূচারুভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। একটি মাত্র ব্যতিক্রম হলো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি। আইনস্টাইন স্থান ও কালকে যেরূপ বক্ররূপে দেখেছেন টেকনিক্যাল ও ধারণাগত উভয় কারণে তিনি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূত্রগুলোর সঙ্গে তার সেই ধারণার সমন্বয় সাধনকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করেছিলেন। এই দুই ব্যাখ্যা বা ধারণাকে একীভূত বা সমন্বিত করবে এমন এক তত্ত্বের ‘কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি’ তত্ত্বের অন্বেষাই আধুনিক তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের সম্ভবত এককভাবে সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী প্রকল্প। ‘তাত্ত্বিক’ এই শব্দটা এখানে এক গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব। কারণ কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়কে সরাসরি উন্মোচিত বা প্রকাশ করতে পারবে এমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিজেকে অতি পারমাণবিক পরিসরে আত্মপ্রকাশ করে যেখানে আমরা স্রেফ গুটিকয়েক মৌলিক বস্তুকণা নিয়ে কারবার করে থাকি। অন্যদিকে গ্র্যাভিটি বা মাধ্যাকর্ষণ তখনই মাত্র লক্ষণীয় বা দৃশ্যমান হয় যখন আমরা জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় বিচারে বিশাল বিশাল ভর সংগ্রহ করি। এমন কোন সহজগম্য পরিস্থিতি নেই যেখানে গ্র্যাভিটি ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স দুটোই একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এখানেই এগিয়ে এসেছিলেন ড. হকিং। বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষা যখন অধরা থেকে যায় তখন আশ্রয় নিতে হয় চিন্তামূলক পরীক্ষা- নিরীক্ষার। আর ১৯৭০-এর দশকে ড. হকিং সব চিন্তামূলক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সেবা পরীক্ষাটির ব্যাখ্যা দেন। সেটি এমন এক পরীক্ষা যা আজও পদার্থবিজ্ঞানীদের রাতের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে। পরীক্ষাটি শুরু হয়েছে একটা ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণ গহ্বরকে দিয়ে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী ব্ল্যাকহোল হচ্ছে স্থান-কালের এমন এক অঞ্চল যেখানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এক প্রচন্ড আকার ধারণ করে যে কোন কিছুই এর হাত থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। কিন্তু ড. হকিং নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করেছেন এমন এক বস্তুর কাছাকাছি জায়গায় কোয়ান্টাম কণাগুলো কেমন আচরণ করতে পারে? সর্বোপরি কোয়ান্টাম মেকানিক্স হলো সম্ভাবনার তত্ত্ব হতে পারে আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী যা সম্ভব কোয়ান্টামের জগতে সেটাই আবার সম্ভব। এবং বস্তুতপক্ষেই ব্যাপারটা তাই। ড. হকিংয়ের সমীকরণে যা প্রকাশ পেয়েছে সেটাকে তিনি স্বভাবসুলভ দুষ্টুমি ভরা উপায়ে ব্যক্ত করেছেন এভাবে যে ‘কৃষ্ণ গহ্বর অতটা কৃষ্ণ নয়।’ ওগুলো প্রকৃতক্ষে বস্তুকণার এক নিরন্তর নিষ্প্রভ প্রবাহ বিকীরণ করে চলেÑ যা এখন ‘হকিং বিকীরণ’ নামে পরিচিত। এই বস্তুকণাগুলো ব্ল্যাকহোলের ভরের কিছু কিছু অংশও বয়ে নিয়ে আসে যার কারণে সেগুলো শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপেই অদৃশ্য হয়ে যাবে। এই ব্যাপারটা ‘হকিং বাষ্পীভবন’ নামে পরিচিত। কাজেই এখানেই আসে চিন্তামূলক পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রশ্ন। একটা বই ব্ল্যাক হোলের ভেতর ছুড়ে দিন। বইটিতে তথ্য রয়েছে। হয়তবা সেই তথ্য পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কিত, হয়তবা সেই তথ্য হচ্ছে একটা প্রেমের উপন্যাসের প্লট। অর্থাৎ ওটা যে কোন ধরনের তথ্য হতে পারে। তবে যতদূর মানুষের জানা তা হলো ব্ল্যাকহোল থেকে বেরিয়ে আসা হকিং বিকীরণ সেই একই জিনিস- ব্ল্যাক হোলের ভেতরে কি চলে গিয়েছিল তাতে কিছুই যায় আসে না। তথ্যটি বাহ্যত হারিয়ে গেছে। কিন্তু সেটা কোথায় গেছে? এভাবেই আমরা পেলাম ব্ল্যাক হোলের তথ্য হারিয়ে যাওয়ার বাঁধা। সম্ভবত এটাই হলো পদার্থবিজ্ঞানে ডাঃ হকিংয়ের সবচেয়ে প্রগাঢ় ও অন্য সাধারণ অবদান। এখানে বিবেচ্য বিষয়টি হলো তথ্য সংরক্ষণ সূত্রের নিয়তি। সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব ব্যতিরেকে কোয়ান্টাম মেকানিক্স ধারণা করে যে তথ্য সংবলিত অবস্থায় আছে; অনুরূপভাবে কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে ছাড়াই সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুমান করে যে তথ্য সংরক্ষিত আছে যদিও এর কিছু অংশ একটা ব্ল্যাকহোলের ভেতরে লুক্কায়িত। কাজে কাজেই ব্যাপারটা বেশ বিব্রত হয়ার মতো যে এই দুটি তত্ত্বকে একীভূত বা একত্রিত করলে যা দাঁড়াবে তাতে মনে হয় তথ্য স্রেফ অদৃশ্য বা উধাও হয়ে যাবে। দীর্ঘদিন ধরে ড. হকিং অপরাপর অধিকাংশ শীর্ষস্থানীয় পদার্থবিজ্ঞানীর অনুমানের বিপরীতে যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে তথ্য মহাবিশ্ব থেকে স্রেফ মুছে গেছে এবং আমাদের এতে অভ্যস্ত হওয়া শিখতে হবে। কিন্তু পরিশেষে তিনি তার মত পরিবর্তন করেন (মত বা ধারণা পরিবর্তন করতে তিনি সর্বদাই প্রশংসনীয়রূপে আগ্রহী ছিলেন) এবং ২০০৪ সালে স্বীকার করেন যে, তথ্য সম্ভবত ব্ল্যাক হোল থেকে বহির্গামী বিকীরণের মধ্যে কোনভাবে রয়ে গেছে। বিষয়টি অবশ্য নিষ্পত্তি হওয়া থেকে আজও বহু দূরে। কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি কিভাবে কাজ করতে পারে তা জানার বা বোঝার জন্য আমাদের হাতে একক বৃহত্তম সূত্রটি হলো ড. হকিংয়ের তথ্য হারিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত চিন্তানির্ভর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আমরা এখনও পর্যন্ত একটা পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব না পেলেও কোয়ান্টাম মেকানিক্স সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি এবং মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কেও অনেক কিছুই জানি। সমষ্টিতগতভাবে এই জ্ঞান আমাদের মধ্যে এই প্রত্যয় উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট যে হকিং বিকীরণ বাস্তব সত্য যদিও তা কখনই প্রত্যক্ষভাবে দেখা যায়নি। তা থেকে এই বোঝায় যে কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি সম্পর্কিত শেষ পর্যন্ত যে তত্ত্বেরই উদ্ভব হোক না তাতে কিভাবে কৃষ্ণ গহ্বর থেকে কোনভাবে তথ্য বেরিয়ে যায় কিংবা কিভাবে ৩১ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় তার ব্যাখ্যা থাকতে হবে। ব্ল্যাকহোলের বিকীরণ এবং তথ্য হারিয়ে যাওয়ার বাঁধাটি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে ড. হকিংয়ের নিশ্চয়ই একমাত্র অবদান নয়। চিরায়ত আপেক্ষিক তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে তিনি ব্ল্যাকহোলের আচরণ এবং মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ সম্পর্কিত বেশ কিছু মৌলিক তত্ত্ব প্রমাণিত করেছেন। অধিকতর দূর কল্পনানির্ভর যেসব বিষয় আছে সেসব ক্ষেত্রে ড. হকিং ও জেমস্্ হার্টল ‘মহাবিশ্বের তরঙ্গ ক্রিয়ার’ ধারণা ব্যক্ত করেছেন যা হলো সকল বাস্তবতাকে বর্ণনা করার কোয়ান্টাম অবস্থা। এর মাঝামাঝি ড. হকিং মহাবিশ্বের কাঠামোর উৎপত্তি এবং টাইম মেশিন তৈরি করা সম্ভব (তার বক্তব্য হলো সেটা সম্ভব নয়) কিনা এই ধরনের সুগভীর প্রশ্নগুলোর ক্ষেত্রেও অবদান রাখার মতো সময় খুঁজে পেয়েছেন। এসব কিছুই তিনি অবশ্য করেছিলেন তার এক ব্যাপক জনপ্রিয় লীর কাছে নিজেকে উপস্থিত করা এবং পদার্থবিজ্ঞান ও মহাবিশ্বের অপার রহস্যের প্রতি তার সুতীব্র আবেগমথিত কৌতূহলকে তাদের কাছে তুলে ধরার পাশাপাশি। ড. হকিং ছিলেন এক অনন্য সাধারণ প্রভাবশালী বিজ্ঞানী এবং সেই সঙ্গে এক সাহসী ও সঙ্কল্প দৃঢ় মানুষ। তিনি আমাদের চিন্তা করে দেখার মতো অনেক কিছুই রেখে গেছেন। মূল : শ্যন ক্যারল ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী এবং ‘দি বিগ পিকচার : অন দি অরিজিন অফ লাইফ মিনিং এ্যান্ড দি ইউনিভার্স ইটসেলফ’ গ্রন্থের রচয়িতা] সূত্র : দি নিউইয়র্ক টাইমস
×