ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রফতানিকৃত পাট পণ্যের ৬৭ শতাংশই পাটসুতা

পাটপণ্য রফতানি করে ৮ হাজার কোটি টাকা আয়

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ৩০ মার্চ ২০১৮

পাটপণ্য রফতানি করে ৮  হাজার কোটি টাকা আয়

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশ থেকে পাটপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে পাটসুতা প্রাধান্য বজায় রেখে চলছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ পাটপণ্য রফতানি হয় তার ৬৭ শতাংশই ছিল পাটসূতা। ওই অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মোট ৬ লাখ ৭১ হাজার ৮৪৭ টন পাটসুতা রফতানি হয়। বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স এ্যাসোসিয়েশনের ৩৯তম বার্ষিক সাধারণ সভায় এ তথ্য জানান এ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহ্জাহান। তিনি বলেন, পাট খাত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। গত অর্থবছরে দেশের পাটশিল্প মোট ৬৬ লাখ ৯ হাজার বেল কাঁচাপাট ব্যবহার করে ৯ লাখ ৯৬ হাজার টন পাটপণ্য উৎপাদন করেছে। এরমধ্যে কাঁচাপাট ও পাটপণ্য রফতানি করে মোট ৮ হাজার ১৩২ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে। বার্ষিক সাধারণ সভায় তিনি বলেন, বর্তমানে পাটসুতার আন্তর্জাতিক বাজারে কিছুটা মন্দাভাব বিরাজ করছে এবং সঙ্কটের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতি হতে উত্তরণে সকল সদস্য প্রতিষ্ঠানকে ধর্যের সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে। তিনি সদস্য মিলদের পণ্য বিক্রয়ে পণ্যের যথাযথ উৎপাদন ব্যয় নির্ধারণে বিশেষ মনোযোগী হওয়ার জন্য আহ্বান জানান এবং আশা করেন বর্তমান পরিস্থিতি অচিরেই পরিবর্তন আসবে। বর্তমানে বাংলাদেশে পাটকলের সংখ্যা বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) আওতাভুক্ত ৯৪টি। এরমধ্যে চালু ৮২টি এবং ১২টি মিল বন্ধ আছে। বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) অধীনে ২৬টি জুট মিল রয়েছে। বাংলাদেশ জুট এ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) সদস্যভুক্ত ছোটবড় মিলের সংখ্যা ১৬৫টি। এরমধ্যে বন্ধ আছে ৪২টি। সব মিলিয়ে দেশে মোট ২৮৫টি পাটকল রয়েছে এবং এর মধ্যে মোট বন্ধ মিলের সংখ্যা ৫৪টি। পাটপণ্য রফতানির পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিজেএসএর আওতাভুক্ত মিলে পাটসুতা রফতানির পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৫৮ হাজার ৭০৫ মেট্রিক টন এবং আয় হয়েছে ৪ হাজার ৩৮১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। পূর্ববর্তী বছরে এই রফতানির পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৫১ হাজার ৩৩৪ মেট্রিক টন এবং আয় ছিল ৪ হাজার ২৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা, যা পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে ১.৩৪ শতাংশ এবং আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৮.৭২ শতাংশ। গত অর্থবছরে মোট পাটসুতা উৎপাদিত হয় ৫ লাখ ৬৩ হাজার ৮৩২ টন এবং মজুদ ছিল প্রায় ৩৪ হাজার ৭৫০ টন। এ বছর বিজেএমসির মিলসমূহে মোট পাটপণ্য রফতানির পরিমাণ ছিল ৮৭ হাজার ৭৯২ টন এবং আয়ের পরিমাণ ছিল ৭৮৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে রফতানির পরিমাণ ছিল ৮৫ হাজার ২১৭ টন এবং আয় হয়েছিল ৬৫৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা। গত অর্থবছরে বিজেএমসির রফতানি পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে ৩.০২ শতাংশ এবং আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ১৯.৬৬ শতাংশ। উল্লেখ্য, ওই অর্থবছরে মোট পাটপণ্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার টন এবং স্থানীয় বিক্রি ছিল ২৯ হাজার ১৪ টন। ৩০ জুন ২০১৭ পর্যন্ত বিজেএমসির উৎপাদিত পাটপণ্যের মজুদ ছিল ৫০ হাজর ৯২৪ টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিজেএমএর মিলসমূহের পাটপণ্য রফতানির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯৯ হাজার ৫৭ টন এবং আয় হয়েছিল ১ হাজার ৬২২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর পূর্বের বছরে রফতানির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮৯ হাজার ২৪০ মেট্রিক টন এবং আয় হয়েছিল ১ হাজার ৪৫১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এবছর রফতানি পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে ৫.১৯ শতাংশ এবং আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ১১.৭৭ শতাংশ। বিজেএমএ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যে পরিমাণ পাটপণ্য রফতানি করেছে তার মধ্যে পাটসুতা রফতানির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ১৮৯ টন এবং আয়ের পরিমাণ ৮২৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা । গত অর্থবছরে বিজেএমএ মোট পাটপণ্য উৎপাদন করেছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ২২০ টন এবং স্থানীয় বিক্রয় ছিল ৬৯ হাজার ৯২৫ টন। উল্লেখ্য, ওই অর্থবছরে তাদের উৎপাদিত পণ্যের মজুদ ছিল ৮৮ হাজার ৯৮৭ টন। গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) বিজেএসএ (৫,৫৮,৭০৫ টন), বিজেএমসি (৯৫৩ টন) এবং বিজেএমএ (১,১২,১৮৯ টন) মিলিয়ে বাংলাদেশ হতে মোট পাটসুতা রফতানির পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৭১ হাজার ৮৪৭ টন। অন্যদিকে ওই অর্থবছরে ভারত হতে পাটসুতা রফতানির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৪ হাজার ৩০০ টন। বিজেএ সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ২০১৬-১৭ অর্থবছরের কাঁচাপাট রফতানির পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৩৯ হাজার বেল। আয়ের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৪২ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কাঁচাপাট রফতানির পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৭৮ হাজার বেল। আয়ের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। কাঁচাপাট রফতানি পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৯.১৩ শতাংশ এবং আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ২৭.৩৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ কাঁচাপাট ও পাটপণ্য রফতানি করে মোট ৮১৩২ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে পাটসুতা শিল্প খাত তথা বিজেএসএর মিলসমূহ ৪০ লাখ ১০ হাজার বেল কাঁচাপাট ক্রয় করে। এরমধ্যে মিলগুলো ব্যবহার করে ৪১ লাখ ৬৫ হাজার বেল এবং মজুদের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ১২ হাজার বেল। বিজেএমএর আওতাভুক্ত মিলসমূহের পাট ক্রয়ের পরিমাণ ছিল ১৯ লাখ ৪৮ হাজার বেল। ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ১০ হাজার বেল এবং মজুদের পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৭৮ হাজার বেল। বিজেএমসির আওতাভুক্ত মিলে পাট ক্রয়ের পরিমাণ ৯ লাখ ৫০ হাজার বেল। এর মধ্যে ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৩৪ হাজার বেল এবং মজুদের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার বেল। সবমিলিয়ে গত অর্থবছরে দেশের পাটশিল্প মোট ৬৬ লাখ ৯ হাজার বেল কাঁচাপাট ব্যবহার করে ৯ লাখ ৯৬ হাজার টন পাটপণ্য উৎপাদন করে। দেশভিত্তিক পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সর্বাধিক পাটসুতা রফতানি হয় তুরস্কে। রফতানির পরিমাণ ছিল ২ লাখ ২ হাজার ৯৫ টন, যা মোট রফতানির ৩৬.১৭ শতাংশ। এছাড়া মোট পাটপণ্য রফতানির মধ্যে চীনে ১৫.০৭ শতাংশ এবং ভারতে ১৩.৫০ শতাংশ রফতানি হয়। তবে ভারত বাংলাদেশ হতে পাটপণ্য আমদানির ওপর ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি হতে ‘এন্টি ডাম্পিং ডিউটি’ আরোপের ফলে পাটসুতা রফতানির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে এবং এ কারণে ভারতে পাটসুতা রফতানি হ্রাস পেয়ে চলেছে। এছাড়া, ইরানে রফতানির হয়েছে ৫.৮৫ শতাংশ, মিসরে ৫.৫২ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়াতে ৩.২৮ শতাংশ। তিনি কাঁচাপাট রফতানির ওপর সরকার কর্তৃক গত ১৮ জানুয়ারি জারিকৃত প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা জারির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে কাঁচাপাট রফতানিতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। এতে রিজেকশনের নামে উন্নতমানের কাঁচাপাট রফতানি বন্ধ হবে। কাঁচাপাটের মৌসুম শুরু হওয়ার সময়েই সরকার যদি সিদ্ধান্ত নিত তা হলে ভাল হতো। তিনি সরকারের প্রতি এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতেও বলবৎ রাখার আহ্বান জানান। এছাড়া তিনি ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে এ্যাসোসিয়েশন সরকার কর্তৃক প্রদেয় নগদ সুবিধা ওপর ৩ শতাংশ হারে উৎসে আয়কর কর্তনের বিধান সংশোধন করে এই আয়কে সম্পূর্ণভাবে আয়কর মুক্ত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
×