ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আরএম দেবনাথ

বিশ্বের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা স্ব-স্ব দেশ ছেড়ে পছন্দের দেশে চলে যাচ্ছেন

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ৩০ মার্চ ২০১৮

বিশ্বের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা স্ব-স্ব দেশ ছেড়ে পছন্দের দেশে চলে যাচ্ছেন

প্রতিবেশী দেশ ভারতের একটি খবর দিয়ে আজকের কলামটি শুরু করছি, যার মধ্যে চীনের খবরও আছে। খরবটি ধনাঢ্য ব্যক্তিদের দেশ ত্যাগের ওপর। ‘অর্গান স্টেইনলি’ নামীয় বিখ্যাত একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ‘বাজারপ্রধান’ এই তথ্যটি ভারতবাসীকে দিয়েছেন। তার তথ্য মতে ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ভারত ছেড়েছেন ২৩ হাজার ধনাঢ্য ব্যক্তি। ধনাঢ্য ব্যক্তি কারা? যাদের প্রত্যেকের কমপক্ষে ১০ লাখ ডলার সমমূল্যের সম্পদ আছে। এদের বলা হয়েছে ‘মিলনিয়র’ ভারতবাসী। তথ্যে দেখা যাচ্ছে ২০১৭ সালেই ভারত ছেড়ে পালিয়েছেন ৭ হাজার ধনাঢ্য ব্যক্তি। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২০১৪ সাল থেকে ‘ডলার মিলিনিয়র’ স্ব-স্ব দেশ ত্যাগ করে নিরাপদ দেশে বসতি গেড়েছেন। এদের যদি ‘অভিবাসী’ বলা হয় তাহলে এই মুহূর্তে এ ধরনের ধনাঢ্য অভিবাসীর সংখ্যা বিশ্বে সর্বমোট দেড় লাখের মতো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ‘অভিবাসী’ হচ্ছে চীনের। আছে প্রচুরসংখ্যক ভারতীয় ধনাঢ্য ব্যক্তি, এমনকি আছে ফ্রান্সেরও। ভারত থেকে পালিয়ে যাওয়া এ ধরনের অভিবাসীর সংখ্যা ইদানীং বাড়ছে। কারণ সেদেশে দুর্নীতির বিচার জোরদার করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ এককালের ডাকসাইটে বিহারী নেতা লালু প্রসাদ যাদব দুর্নীতির দায়ে এখন জেলে। প্রাক্তন কংগ্রেস সভানেত্রী ও বর্তমান সভাপতির বিচার হচ্ছে ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’ মামলায়। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী চিদামবরমের পুত্র কার্তিক চিদামবরমের বিচার হচ্ছে একটি দুর্র্র্র্নীতি মামলায়। এ ছাড়া আর্থিক লেনদেনে ভারতে ক্রমেই নানা ধরনের কঠোরতা অবলম্বন করা হচ্ছে। সেখানকার ‘মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন’ আইনটি জবরদস্ত একটা আইন। তার কঠোরতম প্রয়োগ হচ্ছে। সম্প্রতি খবর হয়েছে একজন বিখ্যাত ডায়মন্ড ব্যবসায়ী ব্যাংকের প্রায় ১২ হাজার কোটি ভারতীয় রুপী মেরে দিয়ে লন্ডন চলে গেছেন। এর আগে গেছেন ‘লিকর ব্যারন’ বিজয় মালব্য। তাদের বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরি হয়েছে। এসব খবর প্রতিদিন ভারতীয় ‘মিডিয়ায়’ প্রকাশিত হচ্ছে। কেউ কেউ মনে করেন এই প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেই এক শ্রেণীর ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও ভারতীয় নাগরিক তাদের সহায়সম্পদ নিয়ে পালাচ্ছেন। কোথায় যাচ্ছেন তারা? সংশ্লিষ্ট খরবটিতে বলা হয়েছে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের পছন্দের জায়গা হচ্ছে অকল্যান্ড, দুবাই, মন্ট্রিল, তেল আবিব, টরেন্টো, যুক্তরাজ্য এবং সিঙ্গাপুর। উল্লেখ্য, এসব জায়গায় চীনা ধনাঢ্যরাও যাচ্ছেন। আমি প্রতিবেশী ও চীনের এই খরবটি উল্লেখ করেছি একটা কারণে। দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশেও এ ধরনের একটা ঘটনা ঘটছে। আমার সামনে চট্টগ্রামের একটা খবর আছে। বিশাল বড় এক ব্যবসায়ী প্রায় ৭০ কোটি টাকা বকেয়া রেখে অর্থাৎ ব্যাংকের পাওনা অপরোধিত রেখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। তার বিরুদ্ধে আদালতে ব্যাংকের মামলা আছে। যেহেতু প্রধান আসামি পলাতক তাই মামলার গতি অত্যন্ত শ্লথ। খবরে প্রকাশ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী বর্তমানে মালয়েশিয়ায় আছেন এবং আছেন সপরিবারে। এই খবরটি কাগজে প্রকাশিত হয়েছে মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। শুধু এই খবর নয়, কয়েকদিন পরপরই পালানোর খবর বিভিন্ন কাগজে ছাপা হচ্ছে। ঘটনাক্রমে এসব খবরের উৎপত্তিস্থল চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম ব্যবসার জায়গা। দেশের আমদানি-রফতানির ৭০-৮০ শতাংশ সংঘটিত হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এই সূত্রেই চট্টগ্রাম ও ব্যবসার স্থল। বৃহত্তর কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর বসতিস্থল চট্টগ্রাম। এই চট্টগ্রাম থেকে যখন এসব পালানোর খবর আসে তখন স্বাভাবিকভাবেই হৃদকম্প শুরু হয়। চার-পাঁচ বছর আগে কক্সবাজারে হোটেল করা হবে এই প্রতিশ্রুতি জনৈক ব্যবসায়ী অনেকের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা নেন নানা ধরনের লোভ দেখিয়ে। সেই ব্যবসায়ী ব্যাংকের কাছ থেকেও ‘লোন’ নেন। তিনিও এখন মালয়েশিয়া প্রবাসী বা ওই দেশের অভিবাসী। দেখা যাচ্ছেÑ ঋণখেলাপীদের একটা অংশ দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন। নিশ্চয়ই হিসাব করলে তারাও ‘ডলার মিলনিয়ার’। নানা সূত্রের খবর বিবেচনা করে দেখা যাচ্ছে শুধু ঋণখেলাপী নয় অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিও এখন টাকা-পয়সা নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ভারতীয় এবং চীনা মিলনিয়ারদের (দশ লাখ ডলার) মতোই আমাদের ‘মিলনিয়াররা’ও দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। দৃশ্যত এই সমস্যার কয়েকটি দিক আছে। প্রথমত তারা দেশেই টাকা বানাচ্ছে, না হয় রোজগার করছে। রোজগার করছে অথচ কর ফাঁকি দিচ্ছে নতুবা নানা অবৈধ পন্থায় টাকা বানাচ্ছে। টাকা বানাতে তাদের কোন অসুবিধা হচ্ছে না। এই হচ্ছে একটি দিক। দ্বিতীয় দিক হচ্ছে টাকা বানানোর ব্যবস্থা আছে, কিন্তু টাকা রাখার বা বিনিয়োগ করার কোন ব্যবস্থা নেই। ব্যাংকে রাখা যায় না, শিল্প করতে গেলে আইটি-১০ নামীয় ঘোষণাপত্র চাওয়া হয়। তৃতীয় দিক হচ্ছে টাকা বিদেশে নিরাপদে রাখা যায়, কেউ প্রশ্ন করে না। টাকার বিনিময়ে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়, স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি পাওয়া যায়। এই তিনটি দিকের মধ্যে তৃতীয় বিষয়টি সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেন তা বুঝিয়ে বলছি। ধরা যাক বিশ্বের কোন দেশে, কোন স্থানে, কোন ব্যাংকে অবৈধ কোন টাকা রাখা যায় না। সেসব দেশে শিল্প-ব্যবসা করা যায় না। করা যায় বৈধভাবে প্রেরিত টাকা দিয়ে। অবৈধ টাকায় নয়। অর্থাৎ যেসব টাকার উৎস জানা এবং যেসব টাকা অনুমোদিত পথে বিদেশে যায় তা দিয়েই ব্যবসা করা যায়, অন্যথায় নয়। যদি এমন একটা ব্যবস্থা থাকত তাহলে কেমন হতো? ধরা যাক কোন দেশ নাগরিকত্ব দেয় না, টাকার বিনিময়ে নাগরিকত্ব দেয় না, স্থায়ীভাবে থাকতে দেয় না তাহলে কী হতো? এমন একটা অবস্থা যদি পৃথিবীর সব দেশে থাকত তাহলে কী আমাদের দেশের ঋণখেলাপীরা বিদেশে পালিয়ে যেতে পারত? নিশ্চয়ই না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশসহ পৃথিবীর বহু দেশের প্রভাবশালী লোকেরা কিছু উন্নত দেশে যেতে পারছে, নাগরিকত্ব পাচ্ছে, স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারছে। এমতাবস্থায় অনেকেরই অভিমত এই যে, এমন একটা বিশ্ব অর্থ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় টাকা পাচার রোধ করা কঠিন এক বিষয়। কাগজেই দেখেছি একজন রাজনৈতিক নেতা সিঙ্গাপুরে অবলীলাক্রমে ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খুলতে পেরেছেন। ওই এ্যাকাউন্টে টাকা জমা হয়েছে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ‘হ্যাক’ করা টাকা ফিলিপিন্সের একটি ব্যাংকে অবলীলাক্রমে জমা দেয়া হয়েছে এবং মুহূর্তের মধ্যে তা তোলাও হয়েছে। কয়েকদিন পরপরই নানা দ্বীপ রাষ্ট্রের নাম কাগজে ছাপা হয়। ছাপা হয় নানা ‘শেল কোম্পানির’ নাম। ওইসব কোম্পানিতে টাকা রাখা ‘জলবৎ তরলং’ কাজ। আন্তর্জাতিক ‘এ্যাসেটম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলো ওইসব টাকা বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করে। সেই থেকে পাচারকৃত টাকার ওপর লভ্যাংশ ও সুদ দেয়া হয়। এর সুবিধাভোগী বিশ্বের সেরা সেরা লোক। কিছুদিন আগেই খবর ছাপা হয়েছে এ ধরনের টাকার মালিক ইংল্যান্ডের রাজ পরিবারও। আমাদের দেশের অনেকেই আছেন। তাদের নামও ছাপা হয়েছে। আমার প্রশ্নটি যারা ওইসব পন্থায় টাকা রেখেছেন বিদেশে তাদের সম্পর্কে নয়, কারণ এ কথা সবারই জানা। আমি যে প্রশ্নটি তুলছি সেটি ভিন্ন এবং এটি বোঝার জন্য সকলকে অনুরোধ করছি। আমি বলতে চাইছি যতদিন বিদেশে টাকা রাখার নিরাপদ মাধ্যম থাকবে, ব্যাংক থাকবে, কোম্পানি থাকবে ততদিন আমাদের দেশ থেকে টাকা পাচার বন্ধ করা কঠিন একটা কাজ হবে। শত হোক যদি কোন ব্যক্তি দেখত অবৈধ টাকা ব্যাংকেও রাখা যায় না, বিনিয়োগও করা যায় না এবং পৃথিবীর কোন দেশেও রাখা যায় না, ওইসব দেশে নাগরিকত্বও পাওয়া যায় না তাহলে আমার ধারণা দেশের ভেতরে অবৈধভাবে টাকা বানানোর প্রবণতা কমত। কমত কারণ টাকা বানিয়ে ওই ব্যক্তি কী করত। বড় জোর ভোগে ব্যয় করত। ভোগে মানুষ আর কত টাকা খরচ করতে পারবে? বড় জোর একটা বাড়ি এক কোটি টাকা দিয়ে বানাত। এক কোটি ধরেছি, কারণ ধরে নিয়েছি ওই ব্যক্তির সরকারী জায়গা আছে। আর না হয় দান-দক্ষিণা করত। কিন্তু এসব করলেও শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে সৃষ্টি হতো না। অবৈধ টাকা বানানোর কোন উৎসাহই থাকত না লোকের মধ্যে। আমার কাছে অন্তত এটাই মনে হয়। অতএব আমি মনে করি ‘যুদ্ধটা’ করা দরকার আন্তর্জাতিভাবে, যাতে কেউ ভিন দেশে অবৈধবাবে জমানো টাকা রাখতে না পারে, যাতে বৈধ টাকা অবৈধভাবে নিয়ে বিদেশে রাখতে না পারে। ‘টিআইবি’ এই দায়িত্বটা পালন করুক। তাদের বিভিন্ন দেশে অফিস আছে। যেসব দ্বীপরাষ্ট্রে অথবা দেশে মানি লন্ডারিং আইন নেই সেখানে তা করা হোক। আইনটা পরিপালন করা হোক। এই আন্দোলনটা ‘টিআইবি’ করে না কেন বুঝি না। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×