ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অতনু রায়

থিয়েটার ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৭:১১, ২৯ মার্চ ২০১৮

থিয়েটার ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ

আমাদের মঞ্চ নাটক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা দুটোই যেন খুব বেশি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কেননা স্বাধীন বাংলাদেশেই প্রথম নাট্যচর্চার বিকাশ লাভ করে, মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী মানুষগুলোর হাত ধরে। স্বাধীন বাংলায় শিল্পচর্চায় যুক্ত হয় নতুন মাধ্যম, যার নাম মঞ্চ বা থিয়েটার। যদিও পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক আমলে বাণিজ্যিক থিয়েটার চর্চার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তার কোনটিই সফলতার মুখ দেখেনি। স্বাধীন বাংলাদেশেই প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে প্রথম নাট্যচর্চার সূচনা হয় যা কালক্রমে আজ দর্শকপ্রিয় শিল্প মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। কবির আনোয়ার এর নাটক ‘জনে জনে জনতা’ বাংলাদেশের প্রথম মঞ্চস্থ নাটক। ‘পারাপার নাট্যগোষ্ঠী’র এ নাটকটি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের মিলনায়তনে দর্শনীর বিনিময়ে মঞ্চস্থ হয় ১৯৭ সালে। নাটকটির মূল উপজীব্যই ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা। স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের কণ্ঠশিল্পীরা যেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন সেই সঙ্গে বলা হয়ে থাকে, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আমাদের মঞ্চ নাটক এবং নাট্যশিল্পীরা নতুন বাংলাদেশে যুদ্ধবিষয়ক বিভ্রান্তি প্রতিরোধে ও জাতীয়তাবাদ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সীমিত পরিসরে কিছু কিছু নাটকের দল গড়ে উঠতে থাকে। তৎকালীন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আর্থ-সামাজিক নানা বিষয় মঞ্চ নাটকে ফুটিয়ে তুলতে দেখা যায়। সত্তরের দশকে হাতেগোনা নাটকের দল থাকলেও আজ তার সংখ্যা দু’শ’রও অধিক। আমাদের মৌলিক নাট্যকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মমতাজউদ্দীন আহমেদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ, সেলিম আল-দীন প্রমুখ গুণী নাট্যকারদের শিল্পে পদচারণা মূলত এই সময়টাতেই, অর্থাৎ স্বাধীনতা পরবর্তী সত্তরের দশকে। এদের রচিত একাধিক প্রতিবাদী নাটকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাই যেন প্রতিভাত হয়েছে বারংবার। শুধু মৌলিক নাটকই নয়, অনুবাদ ও রূপান্তরিত নাটকেও আমাদের সংগ্রামমুখর জীবনের ছাপ স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। তার মধ্যে সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৬), ‘যুদ্ধ এবং যুদ্ধ (১৯৮৬) মামুনুর রশীদ রচিত ‘জয়জয়ন্তী (১৯৯৫), আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘এখনও ক্রীতদাস’, এবং আহসান উল্লাহ রচিত মঞ্চ নাটক ‘কিংসুক যে মেরুতে’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; ‘সারথী’ নাট্যগোষ্ঠীর এই নাটকটিকে মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রথম সফল মঞ্চ নাটক হিসেবে ধরা হয়। যদিও প্রতিটি নাটকে মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা, স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধপরবর্তী ইত্যাদি বিষয়ই স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা ও পরবর্তীতে সামরিক শাসনের সময়কালে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীদের মধ্যে মঞ্চ নাটক চর্চা যেন প্রতিবাদের অন্যতম অস্ত্র হিসেবে ধরা দেয়। এ সময় বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীদের ভেতর মঞ্চ নাটক চর্চা ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিবাদের অন্যতম অস্ত্র ব্যবহার করেন ‘সৈয়দ শামসুল হক’ তার ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকটি রচনার মাধ্যমে। প্রতিবাদের দ্বার উন্মোচনের ফলে, অন্য নাট্যগোষ্ঠীরাও একে একে মঞ্চায়ন করে এই ভূতপূর্ব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবাদী নাটক নির্মাণ।’ রূপান্তর ও অনুবাদকৃত নাটকগুলোতেও স্পষ্টভাবে প্রতিবাদের ভাষা সমুজ্জ্বল ছিল। তার মধ্যে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের রূপান্তরিত নাটক ‘মহানগরী’ উল্লেখযোগ্য। প্রতিবাদী মঞ্চ নাটকের মাধ্যমে আমাদের যে থিয়েটার চর্চার শুরু হয়েছিল আজ সেই নাট্যচর্চা বিশ্বমানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের ‘ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট’ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের কেন্দ্রটি অনেক বেশি সক্রিয়, নাট্যক্রিয়া ও প্রকাশনা ইত্যাদি দিক দিয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশে যে নাট্যক্রিয়ার সূচনা হয়েছিল সেই নাট্যচর্চার কল্যাণে বাংলাদেশের মঞ্চ নাটক আজ বিশ্ব সমাদৃত। স্বাধীনতার এত বছর পরও আমাদের শিল্প সংস্কৃতি, মঞ্চ ও নাটক সবকিছুতেই যেন মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন। কোথায় যেন এক প্রতিবাদের ভাষা এখনও বিরাজমান আমাদের মঞ্চ নাটকগুলোতে। স্বাধীনতার তাৎপর্য এখনও ফুরিয়ে যায়নি তা সহজেই অনুমেয় হয় যখন দেখি ‘আমিই তুমি’র মতো নাটক, যা কিনা তরুণ লেখক ও গবেষক এহসান হাফিজের উপন্যাস এও সেও এর কিছু অংশ থেকে গ্রন্থিত ও মঞ্চায়িত হয় এ যুগেরই তরুণ নাট্যকর্মী ও নির্দেশকের হাত ধরে এবং যা কিনা এখনও চলমান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কিন্তু বিতর্কের জবাব কিংবা প্রতিবাদের ভাষারূপে। মুক্তিযুদ্ধের ফসল এবং আমাদের মঞ্চ নাটকের অর্জন তা যেন সত্যিই একে অপরের পরিপূরক।
×