ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সংগঠন ছাড়া রাজনৈতিক আধিপত্য টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয় -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৯ মার্চ ২০১৮

সংগঠন ছাড়া রাজনৈতিক আধিপত্য টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয় -স্বদেশ রায়

কোন দেশে রাজনৈতিক শক্তি তখনই শক্তিশালী হয়, সমাজের ওপর, রাষ্ট্রের ওপর তার আধিপত্য না হোক তার আলোর ছটা ফেলতে পারে সর্বত্রÑ যখন নেতা ও রাজনৈতিক সংগঠন সমান তালে চলে। রাজনৈতিক সংগঠন কেন, সব সংগঠনই কম-বেশি নেতা নির্ভর। যখন কোন বড় নেতা আসেন সংগঠনে তখন স্বাভাবিক পথেই সংগঠনের কলেবর শুধু বড় নয়, একটি দৃঢ় কাঠামোর ওপর দাঁড়ায়Ñ যা ভেঙ্গে ফেলা সহজ হয় না। যেমন ধরা যাক, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে নভেম্বর অবধি বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিব, শেখ ফজলুল হক মনিকে যেমনি হত্যা করা হয় তেমনি হত্যা করা হয় আওয়ামী লীগের প্রথম সারির জাতীয় চার নেতাকে। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, ইতিহাসের এই প্রান্তে এসে নানা তথ্য-উপাত্ত থেকে এটা প্রমাণিত যে, বেগম মুজিব আওয়ামী লীগের অনেক দুঃসময়ে অনেক নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্তে বঙ্গবন্ধুকে সহায়তা করেছেন। তাই তাকে বাদ দিয়ে কোন দিনই আওয়ামী লীগের সংগঠনকে কল্পনা করা যাবে না। শুধু নীতি নির্ধারণী বিষয় নয়, আওয়ামী লীগের অনেক দুর্দিনের ত্যাগী কর্মীকেও তিনি সব ধরনের সহায়তা দিতেন, আশা-ভরসা দিতেন। যা হোক, ওই নেতাদেরকে হত্যা করার পরেও ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট এর পর ওই দুর্দিনে আওয়ামী লীগ কেন টিকে থাকল? এর একমাত্র কারণ, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হাতে গড়া সুদৃঢ় ভিত্তির সংগঠনের কিছু অবশিষ্ট থাকার কারণে। জিয়াউর রহমান ও এরশাদ আওয়ামী লীগ থেকে অনেক বড় বড় নেতাকে নিয়ে যান, তার পরেও নিঃশেষ করতে পারেননি আওয়ামী লীগকে। সেই দুর্দিনে অন্তত বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীতÑ এগুলো বাঁচিয়ে রেখেছিল আওয়ামী লীগ। তা না হলে ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে যেমন সংবিধানের মূল চেতনা পরিবর্তন হয়ে যায়, তেমনি এগুলোও হারিয়ে যেত বাংলাদেশ থেকে। পাক সার জমিনের আদলে নতুন কোন জাতীয় সঙ্গীত হতো। আর জয় বাংলা ও বঙ্গবন্ধু শব্দ তো সরকারীভাবেই নিষিদ্ধ ছিল। আওয়ামী লীগ কর্মীরা প্রাণের বিনিময়ে সমাজে সেটা বাঁচিয়ে রাখে। যা হোক, তার পরে অনেক পথ পরিক্রম করেছে আওয়ামী লীগ। এই পথ পরিক্রমার পরেও আজ আবার বিশ্বনন্দিত নেতাই আওয়ামী লীগ নেতা। বঙ্গবন্ধুর পরে আবার শেখ হাসিনা নিজেকে এমন একটা স্থানে নিয়ে গেছেন যে তাঁকে বঙ্গবন্ধুর সমান বলা যাবে না, তবে এ সত্য বলতে হবে, তিনি বিশ্বনন্দিত নেতা। এই বিশ্ব্নন্দিত নেতা হওয়ার পরেও শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে মিটিংয়ে বার বার স্বীকার করেন, দুর্দিনে আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মীরা সেদিন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ও বঙ্গবন্ধু শব্দটি বাঁচিয়ে রেখেছিল। এ ছাড়া ব্যক্তিগত আলোচনায়ও তিনি সব সময় বলেন, একজন সাধারণ কর্মীর মূল্য তাঁর কাছে একজন অনেক বড় ধনীর থেকে বেশি। শেখ হাসিনার এই আচরণটিই কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগের সংগঠন গড়ে তোলা ও বাঁচিয়ে রাখার মূলমন্ত্র। আওয়ামী লীগ এখন এমন একটা সময়ে অবস্থান করছে- এ সময়ে আওয়ামী লীগের সংগঠনকে শক্তিশালী করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। আর তেমনভাবে শক্তিশালী করতে হবে যাতে নেতা ও সংগঠন সমান্তরালে যায়। বর্তমানে নেতা ও সংগঠন সমান্তরালে নেই। নেতা অনেক বড় আকৃতি নিয়েছেন, কিন্তু সংগঠন সেইভাবে নিজের আকৃতি বাড়াতে পারেনি। নেতা নিজের অবস্থান দেশের মানুষের ভেতর অনেক বেশি সংহত করেছেন, তার সঙ্গে সঙ্গে সংগঠন ওইভাবে মানুষের ভেতর সংহত হয়নি। নেতা শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তার মতো অন্য সংসদ সদস্য বা নেতাদের জনপ্রিয়তা হবে না ঠিকই, তবে জনপ্রিয়তার চরিত্রটি একই থাকবে। এর বিপরীতে বর্তমান আওয়ামী লীগের অনেক সংসদ সদস্যর ওপর মানুষ ক্ষুব্ধ, তাদের নিজেদের কাজ, তাদের সন্তান ও আত্মীয়দের কাজে সাধারণ মানুষ তাঁদের ওপর বিরক্ত। তা ছাড়া অনেক সংসদ সদস্য আছেন, যারা মানুষের অন্তরে প্রবেশ করতে পারেন নি তাদের নেতার মতো। তেমনিভাবে শেখ হাসিনার পাশাপাশি না হোক, তার পিছে পিছে এক সারি নেতার জনপ্রিয়তা থাকার কথা ছিল। সেই ধরনের নেতার সংখ্যা কমে গেছে বললেই চলে। শেখ হাসিনা সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য গত কাউন্সিল অধিবেশনে বেশকিছু পরিবর্তন আনেন। তবে এই সত্য তাঁকে খোঁজ নিয়ে জানতে হবে, তাঁর ওই পরিবর্তনে কোন কাজ হয়নি। সংগঠন শক্তিশালী হয়নি, বরং অনেক ক্ষেত্রে অনেক স্থানে দায়িত্বহীন বা হাল্কা কথাবার্তার ফলে সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ গত নয় বছরের উন্নয়ন ও শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এখন এমন একটি স্থানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, বাংলাদেশে এ মুহূর্তে শেখ হাসিনার বিকল্প কোন সরকার প্রধানের নাম চিন্তা করার ক্ষমতা দেশের সচেতন মানুষ, অন্যদিকে বিশ্বের তাবত উন্নয়ন সহযোগীদের নেই। এখন প্রশ্ন হলো, যে শেখ হাসিনাকে উন্নয়নের জন্য ক্ষমতায় থাকতে হবে, বাংলাদেশকে বদলে দেবার জন্য ক্ষমতায় থাকতে হবে- সেই শেখ হাসিনাকে অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী একজন নেত্রী হিসেবেই ক্ষমতায় থাকতে হবে। রাজনৈতিক নেতা, তিনি যত বড় হোন না কেন, তিনি কখনই একা নন, তার সংগঠনও তাকে শক্তিশালী করে। যেমন- এখন অবধি শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সব থেকে শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতা কেন? তার একমাত্র কারণ, ওই যে তিনি নিজে বলেন, অনেক বড় ধনীর থেকেও তার কাছে একজন সাধারণ কর্মীর মূল্য অনেক বেশি। দেশ উন্নয়নের যে পর্যায়ে এসেছে, এ পর্যায়ে এসে বাজার অর্থনীতি বা ক্যাপিটালাইজমের চরিত্র অনুযায়ী এ মুহূর্তে দেশে শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন না থাকলে একটি বিপজ্জনক ঘটনা ঘটতে পারে। অর্থাৎ দেশের সম্পদের একটি বড় অংশ বা দেশের পুঁজির বড় অংশ হাতে গোনা কয়েকজন ব্যবসায়ীর হাতে বন্দী হয়ে পড়তে পারে। আর এই সম্পদের জোরে ওই সব ব্যবসায়ী সে সময়ে রাজনৈতিক শক্তিকে উপেক্ষা করা শুরু করতে পারে। তারা হয়ত মূল রাজনৈতিক নেতৃত্বকে উপেক্ষা করার সাহস পাবে না, তবে সামগ্রিক রাজনৈতিক শক্তিকে উপেক্ষা করবে। মুক্ত অর্থনীতিতেও পুঁজির একটা সুস্থির ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার। পুঁজির একটা ব্যালান্স দরকার। পুঁজি যদি কয়েকটি স্থানে বা সীমিত কয়েকজনের কাছে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, তাহলে ওই পুঁজি কোন এক সময়ে রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়াতে পারে- পুঁজিকে আরও বেশি কম স্থানের ভেতর সীমাবদ্ধ করার জন্য। কোন দেশের পুঁজি যদি এ ধরনের চরিত্রের দিকে এগিয়ে যায় তখন তা দেশের রাজনৈতিক চরিত্রের ওপরও আঘাত করে পুঁজির নিজস্ব স্বার্থে। বর্তমানে দৃশ্যত শেখ হাসিনার কোন প্রতিপক্ষ নেই। কারণ বেগম জিয়া ও বিএনপির দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ, বেগম জিয়ার জেল ও অনান্য মামলা মিলে বিএনপির রাজনীতি যেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে খুব শীঘ্রই তাদের নিজেদের ভেতর সংঘাত হবে। রাজনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর কোন সুযোগ বিএনপির নেই। অন্যদিকে দেশ যতই উন্নয়নের পথে যাবে বিএনপি ততই নিঃশেষিত হবে। তাই বিএনপি এখন আর কোনভাবেই শেখ হাসিনার কোন প্রতিপক্ষ নয়Ñ শেখ হাসিনার জন্য বিপদের কোন কারণও নয়। তাছাড়া বিএনপি কখনই রাজনৈতিক শক্তি ছিল না, ভবিষ্যতেও তাদের রাজনৈতিক শক্তি হওয়ার কোন সুযোগ নেই। বরং দেশে যদি রাজনৈতিক শক্তি কোনভাবে তার আধিপত্য হারায়, তাহলে বিএনপি না হোক নতুন কোন নামে এ ধরনের শক্তি লাভবান হয়। অন্যদিকে রাজনৈতিক শক্তি যত বেশি শক্তিশালী হবেÑ উন্নয়ন ও শেখ হাসিনার অগ্রযাত্রা তত বেশি ব্যাপক হবে। এই রাজনৈতিক শক্তিকে শক্তিশালী করতে হলে শেখ হাসিনাকে এখন তার সংগঠনকে শক্তিশালী করতেই হবে। আর সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হলে অবশ্যই তাকে নতুনভাবে কিছু ভাবতে হবে। যে দলীয় কাঠামো এবং নেতৃত্বের কাঠামো বর্তমানে আছে, এর মাধ্যমে কোন মতেই সংগঠন শক্তিশালী হবে না। আগেও এ কলামে লিখেছি, এখনও মনে করি, দেশকে কয়েকটি রাজনৈতিক সাংগঠনিক ভাগে ভাগ করে দলীয় কাঠামোর ভেতর আরেক স্তরের কাঠামো চিন্তা করতে হবে। পাশাপাশি প্রকৃত কর্মসংস্থান ও সংগঠন এই দুইকে একত্র করতে হবে। স্বাধীন দেশে এর বিকল্প কোন কিছু সম্ভব নয়। এখন আর সেই কমিউনিস্ট ধ্যান-ধারণায় সর্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মীবাহিনী গড়া সম্ভব নয়। বরং দলীয় কাঠামো ও দলের লোকের প্রকৃত কর্মসংস্থান ও শিল্প- ব্যবসা এমন স্তরে নিয়ে যেতে হবে, যাতে কোন মতেই পুঁজি মাত্র কয়েকটি স্থানে ঘনীভূত হতে না পারে। উন্নয়নের রাজনীতিতে এই দিকটি মাথায় না রাখলে আঘাত আসতে পারে। আর এ সত্যও স্বীকার করতে হবে, মাত্র কয়েকটি স্থানে পুঁজি ঘনীভূত হওয়ার একটা লক্ষ্মণ ইতোমধ্যে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আকাশে হাল্কা মেঘের মতো হলেও দেখা দিয়েছে। [email protected]
×