ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শপিং মলে আগুন

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২৯ মার্চ ২০১৮

শপিং মলে আগুন

রবীন্দ্রনাথ যতই গেয়ে উঠুন ‘আগুন আমার ভাই’ কিংবা ‘অগ্নিস্থানে শুচি হোক ধরা’ ততই আগুনের লেলিহান শিখা লক লক করে ওঠে। ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ বলে রবীন্দ্রনাথ কী আকুতিই না প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বাস্তব আগুনের কর্ণকুহর থাকলেও তাতে ওই আকুতি ঠাঁই পেত না। সুরের আগুন প্রাণে ছড়ানো যায়। আর সে আগুন ছড়িয়ে যায় সবখানে। কিন্তু সে তো প্রতীকী অর্থে। বাস্তবের আগুন দেহ-মন সবই পোড়ায়। পোড়াতে পোড়াতে নিশ্চিহ্ন করে গ্রামগঞ্জ, কল-কারখানা, ঘরবাড়ি এমনকি সউচ্চ ভবনও। অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা একালে প্রায় সব ভবনেই থাকে। কিন্তু যথাসময়ে তার ব্যবহার করা না গেলে বিপর্যয় ঠেকানো দুষ্কর হয়ে পড়ে। যেমনটা ঘটেছে গত রবিবার বিকেলে রাশিয়ার সাইবেরীয় শহর কেমেরোভোয়। একটি বিপণি বিতান তথা শপিং মলে আগুন লেগে ৬৪ জন মারা গেছে। যাদের অধিকাংশই শিশু তথা অপ্রাপ্তবয়স্ক। আরও অন্তত দশজন নিখোঁজ রয়েছে। রাজধানী মস্কো থেকে তিন হাজার ৬০০ কিলোমিটার দূরে রাশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কয়লা উৎপাদন কেন্দ্র অঞ্চলের উইন্টার চেরি কমপ্লেক্স নামক বিপণি বিতানের বহির্গমন পথ বন্ধ থাকা ও অন্যান্য নিয়মে গুরুতর লঙ্ঘন থাকায় অগ্নিকা-ে মৃতের সংখ্যা বেড়েছে। রবিবার ছুটির দিন বিকেল ৫টায় যখন বিপণি বিতানের ওপর তলায় আগুন লাগে তখন মার্কেটের দোকানগুলো, সিনেমা হল ছিল লোকজনে পরিপূর্ণ। অনেক লোকজন বিপণি বিতানের জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে বাঁচার চেষ্টা করে। বিস্ময়কর যে, আগুন লাগার সংবাদ পেয়ে একজন অগ্নিনিরাপত্তা টেকনিশিয়ান ‘এ্যালার্ম সিস্টেমের সুইচ’ বন্ধ করে দেয়। ফলে আগুনের বার্তা সর্বত্র পৌঁছেনি। আগুন লাগার পর পরই একটি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র নিভিয়ে ফেলতে পারত আগুন। কিন্তু যন্ত্রটি বিকল। জরুরী বহির্গমন পথ বন্ধ থাকায় বিতানটি একটি ফাঁদে পরিণত হয়েছিল। সংগঠিতভাবে কাউকে সরিয়ে নেয়া যায়নি। ১৫০০ বর্গমিটারের বিতানটিতে রয়েছে ছটি সিনেমা হল, রেস্তরাঁ, শিশুদের ট্রামপোলিন কক্ষ, শিশুদের জন্য চিড়িয়াখানা রয়েছে। আগুন পুরো বিভাগে ছড়িয়ে পড়ে, ধসে পড়ে দুটি সিনেমা হলের ছাদ। ৬২টি দমকল ইউনিট নিয়ে অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর ৬৬০ জন কর্মীর পাশাপাশি আকাশ থেকে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে ১৭ ঘণ্টার বেশি সময়ের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। দমকল বাহিনী শতাধিক লোককে বের করে আনে। ধারণা করা হচ্ছে, একটি শিশুর কাছে থাকা গ্যাস লাইটার থেকে কোন রাবারে আগুন ধরে যায় এবং তা গানপাউডারের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তবে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত টিভি বলেছে, যথাসম্ভব বৈদ্যুতিক ত্রুটি থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ায় এর চেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড আর কখনও হয়নি। এর আগে উড়ালস অঞ্চলে এক নাইট ক্লাবে অগ্নিকা-ে ১৫৬ জন মারা যায়। ২০০৭ সালে সিগারেটের আগুন থেকে সূত্রপাত অগ্নিকা-ে ক্রাসনদর এলাকায় গ্রামের বাড়িঘরে আগুন লেগে ৬৩ জন মারা যায়। ২০০৬ সালে মস্কোর নারকোলজিক্যাল হাসপাতালে অগ্নিকা-ে ৪৬ জন, ২০০৩ সালে পিপলস ফ্রেন্ডশিপ বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে অগ্নিকা-ে ৪৫ জন এবং ১৯৯৯ সালে সামারা শহরে পুলিশ সদর দফতরে অগ্নিকা-ে ৫৭ জন মারা গেছে। ১৮১২ সালে স¤্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট রাশিয়ায় আগ্রাসন চালিয়ে মস্কো দখল করতে গিয়ে দেখেন, পুরো শহর আগুনে দাউদাউ করে জ্বলছে। ওই অগ্নিকা-ে প্রায় ১২ হাজার মানুষ মারা যায়। নেপোলিয়ানকে ঠেকাতে ও তার সেনাদের পুড়িয়ে মারার জন্য শহরে বাসিন্দাদের একাংশ এই আগুন লাগায়। রাশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। বিশ্বের একদা পরাশক্তি রাশিয়ার শপিং মলে অগ্নিকা- পরবর্তী যেসব দুরবস্থার চিত্র উঠে এসেছে, তা শঙ্কিত করে উন্নয়নশীল দেশের পথে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশকে। পান্থপথে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম শপিং মলটিতে আগুন লাগার পর তা নির্বাপণে বেশ সময় লেগেছিল। অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রও এখানে কাজ করেনি। বাংলাদেশের বর্তমান ঋতুতে আগুনের প্রকোপ বাড়ে। বাতাসে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাগুলো নির্মম ও হৃদয়বিদারক। তাই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন জরুরী বিশ্বের সব দেশের জন্যই। রাশিয়ার ঘটনা বাংলাদেশবাসীকেও সতর্ক করবে বলে আশা করা যায়। আগুন নিয়ন্ত্রণ ও নির্বাপণের প্রস্তুতি থাকা উচিত সব ভবনেই।
×