ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্বকাপকথন-১১ ॥ নবম বিশ্বকাপ মেক্সিকো : ১৯৭০

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ২৮ মার্চ ২০১৮

বিশ্বকাপকথন-১১ ॥ নবম বিশ্বকাপ মেক্সিকো : ১৯৭০

এটি ছিল জুলেরিমে ট্রফির শেষ আসর। এ আসর বসে উ. আমেরিকায়। আমেরিকা-ইউরোপের বাইরে যেতেই পারছে না জুলেরিমে ট্রফি। ফিফা যদিও বিশ্বকাপকে বিশ্বায়নের কথা মুখে বলছে তবে সেটা কাজে বাস্তবায়ন করতে পারছে না। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে না দিলে বিশ্বায়ন হবে কী করে? আগের বিশ্বকাপ ইউরোপে হয়েছে, এবার যথারীতি আমেরিকায়। তাছাড়া অষ্টম বিশ্বকাপ আয়োজনে ইংল্যান্ড একঝুড়ি বদনাম কামানোয় ইউরোপে বিশ্বকাপ আয়োজন মানতে রাজি হয়নি অনেক দেশ। ফলে মহাদেশ না বদলিয়ে উপায় ছিল না ফিফার। এবারের আয়োজক মেক্সিকো। যদিও ইউরোপ থেকে সাত হাজার ফুট উচ্চতায় মেক্সিকোকে মেনে নিতে রাজি হচ্ছিল না ইউরোপের দেশগুলো। তবে তাদের সে আপত্তি ধোপে টেকেনি। তারপরও আমেরিকা-ইউরোপের গ-ি ছেড়ে বিশ্বকাপ বেরিয়ে আসতে পারল না ফিফা। কনকাকাফের দেশ মেক্সিকো আয়োজক নির্বাচিত হলো ফিফার ১৩৮টি সদস্য দেশের ভোটে। এবারও নবম বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলল আগের মতোই ১৬টি দেশ। এই ১৬টি দেশ নির্বাচন করা হয় বাছাইপর্বের ৭০টি দেশের মধ্যে থেকে। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ থেকে এবারও কোন দেশ অভিষিক্ত হলো না। অঞ্চল ভিত্তিক দলগুলো হলো- ইউরোপ : ইংল্যান্ড, ইতালি, প. জার্মানি, চেকোশ্লাভাকিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বেলজিয়াম, সুইডেন, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া; কনমোবল : ব্রাজিল, উরুগুয়ে, পেরু; কনকাকাফ : মেক্সিকো; মধ্য আমেরিকা : এল সালভাদর; আফ্রিকা : মরক্কো; এশিয়া : ইসরাইল নবম বিশ্বকাপে অংশ নেয়। বাছাই পর্বে অনুষ্ঠিত হয় ১৭২টি ম্যাচ। আর মূল পর্বে ১৬টি দল খেলল ৩২টি ম্যাচ। মেক্সিকোর ৫টি স্টেডিয়ামে এই ৩২টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। অষ্টম বিশ্বকাপের মতো এবারও আবার গ্রুপিং করা হয়। গ্রুপ পর্বে ১৬টি দলকে ৪টি গ্রুপে ভাগ করা হয়। প্রত্যেক গ্রুপে ৪টি করে দল অংশ নেয়। ১৬টি দলকে ৪ গ্রুপে ভাগ করা হয় এভাবে : ক গ্রুপ : মেক্সিকো, রাশিয়া, বেলজিয়াম ও এল সালভাদর; খ গ্রুপ : উরুগুয়ে, ইতালি, সুইডেন ও ইসরাইল; গ গ্রুপ : ব্রাজিল, ইংল্যান্ড, চেকোশ্লাভাকিয়া ও রুমানিয়া; ঘ গ্রুপ : প. জার্মানি, বুলগেরিয়া, মরক্কো ও পেরু অংশ নেয়। এরপর চার গ্রুপের গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল, ইতালি, প. জার্মানি ও রাশিয়া এবং রানার্স আপ উরুগুয়ে, ইংল্যান্ড, স্বাগতিক মেক্সিকো ও পেরুকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় কোয়ার্টার ফাইনাল। কোয়ার্টার ফাইনাল বিজয়ী ব্রাজিল, ইতালি, প. জার্মানি ও উরুগুয়ে খেলে সেমি-ফাইনাল। সেমি বিজয়ী দুই চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল ও ইতালি মোক্সিকো সিটির ফাইনাল খেলে। আগের বিশ্বকাপে জার্মানরা ফেবারিট থাকলেও এবার টপ ফেবারিট ছিল ব্রাজিল। যদিও সব বিশ্বকাপের আগেই ব্রাজিল ফেবারিট হিসেবেই খেলা শুরু করে। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। কাপ শুরুর অনেক আগেই ব্রাজিল নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়। এ কারণে বিশ্বকাপ শুরুর আগেই অনেক বাজিকর ব্রাজিলের পক্ষে বাজি ধরতে রাজি ছিল। এবার আগেভাগেই সবাই বুঝে গিয়েছিল, তৃতীয়বারের মতো কাপ জিতবে ব্রাজিল। পেলে ছিলেন পিক-ফর্মে। ইউরোপের দলগুলো এবারও ব্রাজিলকে তথা পেলেকে আটকানোর উপায় খুঁজতে থাকে। তবে বিধি বাম! এবার খেলা ইউরোপে হচ্ছে না। ঘরের মধ্যে বাঘ ইউরোপ মহাদেশের বাইরে একবারও কাপ জিততে পারেনি। অপরদিকে ব্রাজিল স্বাগতিক হিসেবে কাপ জিততে না পারলেও নিজ মহাদেশ ছাড়াও ইউরোপ থেকে কাপ জিতে বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা ঘরের বীর নয়। নবম বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে রাশিয়ার বিপক্ষে অংশ নেয় স্বাগতিক মেক্সিকো। খেলাটি গোলশূন্যভাবে শেষ হয়। ব্রাজিল, ইতালি, প. জার্মানি ও রাশিয়া গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন ও ইংল্যান্ড, উরুগুয়ে, স্বাগতিক মেক্সিকো ও নবাগত পেরু রানার্স আপ দল হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে। ব্রাজিল, ইতালি, উরুগুয়ে ও প. জার্মানি কোয়ার্টার ফাইনালে জয়ী হয়। কোয়ার্টার ফাইনালে প. জার্মানি ৩-২ গোলের কষ্টসাধ্য জয় পায় ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। বাদ পড়ে ইংরেজরা। অপর কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিল অনেকটা এক তরফা ম্যাচে ৪-২ গোলে হারায় পেরুকে। কোয়ার্টার ফাইনালের বাকি দুই ম্যাচে স্বাগতিক মেক্সিকোর বিপক্ষে ইতালি ৪-১ গোলের সহজ জয় পেলেও রাশিয়ার বিপক্ষে ১-০ গোলের কষ্টসাধ্য জয় পায় ইরুগুয়ে। প্রথম সেমি-ফাইনালে শিরোপা প্রত্যাশি ব্রাজিল ৩-১ গোলে হারায় নিজ মহাদেশের উরুগুয়েকে। উরুগুয়ের কুবিল্লাস গোল করে দলকে এগিয়ে নিয়ে গেলেও বিরতির আগেই ব্রাজিলের ক্লোভেয়ান্ডো গোল করে খেলায় সমতা আনেন। বিরতির পর আর উরুগুয়ে ম্যাচে ঘুরে দাঁড়াতেই পারেনি। ব্রাজিলের জোয়ারজিনো ও রিভোলিনো গোল করে জয় নিশ্চিত করেন। অপর সেমি-ফাইনালে ইতালি জয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে শক্তিশালী প. জার্মানিকে ৪-৩ গোলে হারিয়ে ফাইনাল নিশ্চিত করে। এ ম্যাচটিকে বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসের সেরা ম্যাচ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। খেলার শেষ মুহূর্তেও বোঝা যায়নি কোন দল জিতবে। খেলার প্রতিটি মুহূর্ত ছিল টানটান উত্তেজনায় ঠাসা। পুরো ৯০ মিনিটে গোল হয় মাত্র ১টি। খেলা অতিরিক্ত সময়ে গড়ায়। এ ম্যাচে জার্মান তারকা ফ্রঞ্জ বেকেনবাওয়ারকে রেফারি লাল কার্ড দেখালে খেলা ইতালির দিকে ঝুঁকে পড়ে। বেকেনবাওয়ার মাঠে থাকলে ফলাফল হয়তো জার্মানদের অনুকূলে যেত বলে অনেকে মনে করেন। আর এ কারণে অতিরিক্ত সময়ের খেলায় জয় পায় ইতালি। গ্রুপ পর্বের ফলাফল- গ্রুপ-এ : মেক্সিকো-০ সো. ইউনিয়ন-০; বেলজিয়াম-৩ এল সালভাদর-০; সো. ইউনিয়ন-৪ বেলজিয়াম-১; মেক্সিকো-৪ এল সালভাদর-০; সো. ইউনিয়ন-২ এল সালভাদর-০; মেক্সিকো-০ বেলজিয়াম-৩ গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : সো. ইউনিয়ন গ্রুপ রানার্স আপ : মেক্সিকো। গ্রুপ-বি : উরুগুয়ে-২ ইসরাইল-০; ইতালি-১ সুইডেন-০; উরুগুয়ে-০ ইতালি-০; সুইডেন-১ ইসরাইল-১; সুইডেন-১ উরুগুয়ে-০; ইসরাইল-০ ইতালি-০; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : ইতালি গ্রুপ রানার্স আপ : উরুগুয়ে। গ্রুপ-সি : ইংল্যান্ড-১ রুমানিয়া-০; ব্রাজিল-৪ চেকোশ্লাভাকিয়া-১; রুমানিয়া-২ চেকোশ্লাভাকিয়া-১; ব্রাজিল-১ ইংল্যান্ড-০; ব্রাজিল-৩ রুমানিয়া-২; ইংল্যান্ড-১ চেকোশ্লাভাকিয়া-০; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : ব্রাজিল গ্রুপ রানার্স আপ : ইংল্যান্ড। গ্রুপ-ডি : পেরু-৩ বুলগেরিয়া-২; প. জার্মানি-২ মরক্কো-১; পেরু-৩ মরক্কো-০; প. জার্মানি-৫ বুলগেরিয়া-২; বুলগেরিয়া-১ মরক্কো-১; প. জার্মানি-৩ পেরু-১; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : প. জার্মানি গ্রুপ রানার্স আপ : পেরু। কোয়ার্টার ফাইনাল : প. জার্মানি-৩ ইংল্যান্ড-২; ব্রাজিল-৪ পেরু-২; ইতালি-৪ মেক্সিকো-১; উরুগুয়ে-১ সো. ইউনিয়ন-০; সেমি-ফাইনাল: ইতালি-৪ প. জার্মানি-৩; ব্রাজিল-৩ উরুগুয়ে-১ তৃতীয় স্থান : প. জার্মানি-১ উরুগুয়ে-০; ফাইনাল : ব্রাজিল-৪ ইতালি-১ (পেলে, আলবার্তো, গার্সন, জোয়ারজিনহো) (বনিনসেগনা) চ্যাম্পিয়ন : ব্রাজিল রানার্স আপ : ইতালি তৃতীয় স্থান : প. জার্মানি। আবারও অনুষ্ঠিত হয় অরো একটি ল্যাটিন-ইউরোপ ফাইনাল। এ ম্যাচটি দু’দলের জন্য ছিল সমান গুরুত্বপূর্ণ। কেননা দুই দলই দুইবার করে জুলেরিমে ট্রফি জিতেছে। জুলেরিমে ট্রফি চিরতরে নিজেদের করে নেবার হাতছানি দু’দলের সামনে। জুলেরিমে ট্রফি চিরতরে পাবার জন্যে মরিয়া দু’দলই। তবে ফাইনালে সুবিধে করতে পারেনি ইতালি। ব্রাজিলিয়ান নৈপুণ্যের কাছে দাঁড়াতেই পারেনি ইতালিয়ানরা। ফাইনালটা হয়ে যায় এক তরফা। আর সেই এক তরফা পানসে ফাইনালে ল্যাটিন ব্রাজিল ৪-১ গোলে ইউরোপের দল আরেক চ্যাম্পিয়নকে হারিয়ে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ ছোঁয়ার গৌরব অর্জন করে। ব্রাজিলের পেলে, জোয়াজিনো, কার্লোস আলবার্তো, গার্সন গোল করে দলকে জিতিয়ে দেন। ইতালির পক্ষে একমাত্র গোলটি করেন বনিনসেগনা। আর এরই সঙ্গে সমাপ্তি ঘটে জুলেরিমে ট্রফি অধ্যায়ের। কেননা জুলেরিমে ট্রফি শুরুর সময়ে বলা হয়েছিল, যে দল তিনবার জুলেরিমে ট্রফি জিততে পারবে তারা কাপটি চিরতরে নিয়ে যাবে। আর তাই ১৯৫৮, ’৬২ ও’ ৭০ সালে জুলেরিমে ট্রফি জেতার সুবাদে কাপ ব্রাজিলের হয়ে যায়। তৃতীয়স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ঘটে আরেক চমক। ফ্রান্স ৬-৩ গোলে চ্যাম্পিয়ন প. জার্মানিকে হারিয়ে চমক দেখায়। নবম বিশ্বকাপে ব্রাজিলের নেতৃত্ব দেন কার্লোস আলবার্তো আর ইতালির ফ্যাসের্টি। প. জার্মানি পায় তৃতীয় স্থান আর উরুগুয়ে চতুর্থ। চতুর্থ বিশ্বকাপে মোট ৯৫টি গোল হয়। নবম বিশ্বকাপে সর্বাধিক গোল করেন প. জার্মানির গার্ড মুলার। তিনি এ বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিকসহ ১০টি গোল করে ‘টপ স্কোরার’ হন। নবম বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ পরিচালনা করেন পূর্ব জার্মানির রেফারি গ্লকনার। (চলবে) লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ লেখক পরিষদ e-mail : [email protected]
×