ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কথা বলার অপরাধে সালিশে বাধ্যতামূলক তালাক

গ্রাম প্রধানের দম্ভোক্তি-যে রায় দিয়েছি সেটাই চূড়ান্ত

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ২৮ মার্চ ২০১৮

গ্রাম প্রধানের দম্ভোক্তি-যে রায় দিয়েছি সেটাই চূড়ান্ত

নিজস্ব সংবাদদাতা, নাটোর, ২৭ মার্চ ॥ বড়াইগ্রাম উপজেলার জোয়াড়ী ইউনিয়নের নওপাড়া গ্রামে শুধু প্রতিবেশী এক যুবকের সঙ্গে কথা বলার অপরাধে পরকীয়ার অপবাদ দিয়ে গ্রাম্য সালিশে একতরফাভাবে স্বামী-স্ত্রীকে খোলাতালাকে বাধ্য করেছেন গ্রাম্য প্রধানেরা। এর আগে শুক্রবার রাত দুইটায় গৃহবধূ রুনা খাতুনকে কথিত প্রেমিকের বাড়িতে তুলে দিয়ে আসেন তারা। এ ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে, তালাকপ্রাপ্তা গৃহবধূ এ ঘটনায় সাংবাদিকদের কাছে সাক্ষাতকার দিলে বা মামলা করতে গেলে একঘরে করে দেয়াসহ প্রয়োজনে গ্রাম ছাড়া করার হুমকি দিচ্ছে ঐসব প্রধানেরা। প্রধানদের হুমকির মুখে বর্তমানে বাড়িতে এক প্রকার অবরুদ্ধ জীবনযাপন করছে তারা। মঙ্গলবার সরেজমিনে নওপাড়া গ্রামে গিয়ে গৃহবধূ রুনা খাতুন ও তার বাবা আব্দুর রহমানসহ স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। এ সময় গ্রাম প্রধান ইউনুস আলী লোকজন নিয়ে রুনার বাবার বাড়িতে এসে সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করাসহ তাদের সামনেই হুমকির মুখে রুনা ও তার বাবাকে বাড়ির ভেতরে যেতে বাধ্য করেন। এছাড়া সাংবাদিকসহ কারো সঙ্গে এ ব্যাপারে কোন কথা বললে তাদের একঘরে করারও হুমকি দেন তারা। এ সময় গ্রাম প্রধান ইউনুস আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি দম্ভভরে বলেন, গ্রামে আমরাই কোর্ট, আমরাই আদালত। আমরা যে রায় দিয়েছি সেটাই চূড়ান্ত। এ ব্যাপারে কোন সাংবাদিক কোন সাক্ষাতকার নিতে পারবে না। এ সময় রুনা ও আলমগীরের পরকীয়া সম্পর্কের প্রমাণ চাইলে তিনি কোন প্রমাণ দেখাতে পারেননি। সেখানে উপস্থিত আকরাম হোসেন গ্রামে ঢোকার আগে গ্রাম প্রধানদের অনুমতি না নিয়ে সেখানে কেন যাওয়া হয়েছে জানতে চেয়ে সাংবাদিকদের বলেন, গ্রাম প্রধানদের অনুমতি ছাড়া এ গ্রামের কোন বিষয়ে মাথা ঘামানো যাবে না। এলাকাবাসী জানান, গত শুক্রবার সকালে নওপাড়া গ্রামের আলমের স্ত্রী রুনা খাতুন তার চাচা শ^শুরের বাড়িতে মোবাইলে চার্জ দিতে যায়। এ সময় প্রতিবেশী কলেজ ছাত্র আলমগীরের সঙ্গে দেখা হলে তিনি সৌজন্যমূলক কথা বলে চলে আসেন। পরে প্রতিবেশী কয়েকজন সেখানে তারা অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিল মর্মে দাবি করে সন্ধ্যায় সালিশ বসান। সালিশে এক তরফাভাবে রুনা খাতুনকে দায়ী করে কলেজ ছাত্র আলমগীরের সঙ্গে তার বিয়ে দেয়া হবে বলে জানানো হয়। সালিশ শেষে শুক্রবার রাত দুইটার দিকে গ্রাম্য প্রধানেরা চাপের মুখে রুনাকে আলমগীরের বাড়িতে তুলে দিয়ে আসেন। শনিবার সন্ধ্যায় গ্রাম্য প্রধানেরা আলমগীরের বাড়ি থেকে রুনাকে মীমাংসা করা হবে বলে ডেকে এনে দ্বিতীয় দফা সালিশ বসান। সালিশে স্থানীয় ওয়ার্ড সদস্য আব্দুল ওয়াহাব ও আব্দুল গফুর, গ্রাম প্রধান ইউনুস আলী, চাঁদ মিয়া, আবু সাঈদ উপস্থিত ছিলেন। সালিশে রুনার বাবা দরিদ্র ভ্যানচালক আব্দুর রহমানকে একা ডেকে নিয়ে যান তারা। পরে কাজী ডেকে এনে হুমকির মুখে স্বামী আলম ও স্ত্রী রুনা খাতুনকে খোলা তালাকে বাধ্য করেন। একই সঙ্গে কলেজ ছাত্র আলমগীরের সঙ্গে আগামী সাতদিনের মধ্যে রুনার বিয়ে দেয়া হবে মর্মে আলমগীরের বাবা আব্দুল আজিজকে দিয়ে জোরপূর্বক লিখিত আদায় করে নেন। সালিশ শেষে রুনাকে এক কাপড়ে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ বিষয়ে রুনার বাবা আব্দুর রহমান কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, সমাধানের মিথ্যা আশ^াসে ডেকে নিয়ে আমাকে বা আমার মেয়েকে কোন কথা বলতে না দিয়ে খোলা তালাকের কাগজ ধরিয়ে দিয়েছে। আমাদের কোন অনুনয়-বিনয় তারা শোনেননি। গ্রাম প্রধানদের চাপের মুখে আমি এ ব্যাপারে কারো কাছে বিচারও চাইতে পারছি না। সালিশে উপস্থিত ওয়ার্ড সদস্য আব্দুল ওয়াহাব মোবাইলে জানান, সালিশে গ্রামের প্রধানেরা ছিলেন। তারা পরামর্শ করে রায় দিয়েছেন।
×