ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অস্তিত্ব সঙ্কটে ৩৭ নদী

বরিশালে বন্ধ ২৮ নৌরুট

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ২৮ মার্চ ২০১৮

বরিশালে বন্ধ ২৮ নৌরুট

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ “আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে। বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে। পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি। দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি”। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিতা স্কুলজীবনে পা দিয়েই পড়েননি এমন মানুষ খুবই কম আছে। যদিও এখন প্লে, প্রি ক্লাসে গিয়ে পড়তে হয় টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার কিংবা হামটি ডামটি.......। তাই বর্তমান প্রজন্ম ভুলে যাচ্ছে নদীমাতৃক বাংলাদেশের কথা। মানচিত্রেও এখন আর অনেক নদীর নাম দেখা যায় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৈশাখ মাসে নাগর নদী দেখে কবিতাটি লিখেছিলেন। এখন আর ছোট নদী নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাত হ্রাস ও দখলের কারণে বৈশাখ মাসে দেশের অন্যতম প্রমত্তা নদীগুলোতেও পানি থাকে না। পানি প্রবাহের প্রধান উৎস পদ্মা ও মেঘনায় ¯্রােত কমে শাখা নদীগুলোতে পলি জমায় ¯্রােতহীন হয়ে প্রতিবছর অসংখ্য ছোট-বড় চর জেগে নদী নাব্য হারাচ্ছে। যে কারণে পানিশূন্য হয়ে দক্ষিণাঞ্চলের তিন হাজার কিলোমিটার নৌ-পথ এখন মরণফাঁদে রূপ নিয়েছে। এরমধ্যে ১৪’শ কিলোমিটার নৌ-পথ ইতোমধ্যে নাব্য হারিয়ে নৌ-যান চলাচলের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। নাব্য সঙ্কটের ফলে বন্ধ হয়ে গেছে এ অঞ্চলের ২৮টি নৌ-রুট। আরও তিনটি রুট বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতের সহজ যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে নৌ-পথ। বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলা ও ৪০টি উপজেলার কয়েক লাখ মানুষকে নৌ-পথ কিংবা ৮৮টি নৌ-রুটের ওপর ভরসা করেই যাতায়াত করতে হয়। বিআইডব্লিউটিএ’র হিসেবে প্রতিদিন গড়ে লক্ষাধিক লোক এসব নৌ-রুটে যাতায়াত করে থাকেন। প্রতিবছর চৈত্র ও বৈশাখ মাসে এ অঞ্চলের ১৪’শ কিলোমিটার নৌ-পথ থাকে চলাচলের অনুপযোগী। নাব্যতা সঙ্কটের কারণে পাঁচটি নদীর প্রায় ৩৫ কিলোমিটার এলাকায় নৌ-চলাচল বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি এসব অঞ্চলের ব্যবসায়িক বন্দরগুলোও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাব্যতা সঙ্কটে নদীর বিভিন্ন অংশে অসংখ্য চর ও ডুবোচর জেগে উঠেছে। জেগে ওঠা চরে স্থানীয়রা ধানসহ অন্যান্য চাষাবাদ করছেন। এছাড়াও নাব্যতা সংকটে জীবনানন্দ দাশের ধানসিঁড়ি নদীটিও এখন মড়া খালে রূপ নিয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চৈত্রের শুরু থেকে বৈশাখের খরতাপে এবং মরণবাঁধ ফারাক্কা ব্যারাজের কারণে দেশের শ’খানেক নদ-নদীর পানি শুকিয়ে যায়। ফলে শুধু নদী নয়, খাল-বিল, পুকুর-দীঘির সর্বত্র পানির জন্য হাহাকার পড়ে। নদী শুকিয়ে যাওয়ার বিরূপ প্রভাব ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে এ মৌসুমে সাধারণ হস্তচালিত নলকূপ পরিত্যক্ত হয়ে যায়। নগরায়ণ ও অবৈধ দখলের কারণে বরিশাল নগরীর বড় বড় দীঘি-পুকুর ও খালের বিশাল অংশ ভরাট হয়ে গেছে। ফলে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জায়গা নেই। জানা গেছে, জেলার মুলাদী উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রমত্তা জয়ন্তী নদীর পানি কমে গেছে। ওই নদীর বালুচরের একটু শক্তস্থানে পিচ বানিয়ে দামাল ছেলেরা মেতে ওঠে ক্রিকেট খেলায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআইডব্লিউটিএ’র এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, শুধু দক্ষিণাঞ্চলের ১৪’শ কিলোমিটার নয়; সারাদেশে ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌ-পথ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এসব নৌ-রুটগুলোকে সচল রাখতে নৌ-মন্ত্রণালয় থেকে বছরের বারো মাসই ড্রেজিং অব্যাহত থাকলেও নৌ-পথকে সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। জানা গেছে, বরিশালের শহরতলী এলাকায় তালতলী নামে একটি নদী ছিল। একসময় এই তালতলী নদী দিয়ে স্টিমার, বড় মালবাহী নৌযান রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করতো। বর্ষা মৌসুম ছাড়াও নদীতে থৈ থৈ করত পানি। ঢেউয়ে ছিল বাঘের গর্জন। কিন্তু আজ নাব্য হারিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে তালতলী নদী। এখন সেই নদী শুধু কল্পকাহিনী। শুধু তালতলী নদীই নয়, কালসুরী, জয়শ্রী, চন্দ্রমোহন, কালিজিরা, তুষখালী, খয়রাবাদ, সন্ধ্যা, সুগন্ধা, আড়িয়ালখাঁ, পালরদী নদী, পটুয়াখালীর পাঙ্গাশিয়া, আলগী, আলকি নদীর মতো এমন নাম না জানা নদী এখন বয়োবৃদ্ধদের মুখে গল্পকথায় পরিণত হয়েছে। নদী কমিশনের হিসেবে দক্ষিণাঞ্চলের ৬৪ নদীর মধ্যে ৩৭টি নদী এখন অস্তিত্বহীন। বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, কালাবদর, লতা, কীর্তনখোলা, বিষখালী, বরগুনা, রাঙ্গামাটিয়া, নয়াভাংগনী, আমতলী, সন্ধ্যা, কালীগঙ্গা, কচা, বলেশ্বর, সাতলা, আগরপুর, আড়িয়ালখাঁ, গণেশপুরা, তেঁতুলিয়া, আগুনমুখ, রাবনাবাদ, কারখানা, লোহালিয়া, বিঘা, বুড়িশ্বর, আন্ধারমানিক, খয়রাবাদ, ইলিশা ও গাবখান নদীর নাম লিপিবদ্ধ থাকলেও ৩৭টির কোন হদিস নেই। এর মধ্যে বরগুনা, নয়াভাংগনী, সাতলা, গণেশপুরা, তেঁতুলিয়া, লোহালিয়া ও ইলিশা নদীর নাব্য হারিয়ে গেছে। অপরদিকে পদ্মা ও মেঘনা নদীর মোহনা থেকে উৎপত্তি তেঁতুলিয়া নদী এখন শুধুই একটি খাল। সাহেবের নদী ও চন্দ্রমোহন নদীরও একই অবস্থা। সন্ধ্যা ও সুগন্ধা নদীও এখন মরার পথে। কালসুরী নদী দিয়ে ছিল খুলনাগামী নদীপথ। আজ আর কালসুরীর দেখা মেলে না। ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের নন্দীবাজার এলাকার জয়শ্রী নদী এখন মরা খাল। মেঘনা নদীর শাখা এমন ৭-৮টি নদী মরে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ নৌযান দুই ঘণ্টা পথ ঘুরে যেতে হয়। বাংলাদেশ নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, ঋতু পরিবর্তন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের পর পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় ছোট নদীগুলোতে আগাছা, কচুরিপানা ও পলি জমে ভরাট হতে থাকে। নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩০টি নদীর পানি প্রবাহের প্রধান উৎস পদ্মা ও মেঘনায় ¯্রােত কমে যাওয়ায় এসব শাখা নদীতে এর প্রভাব পরেছে। এ শাখা নদীগুলো ¯্রােতহীন হয়ে পড়ায় বর্ষায় নদীবক্ষে জমা হওয়া পলি অপসারিত হচ্ছে না। ফলে প্রতি বছর জেগে উঠছে অসংখ্য ছোট-বড় চর। নদীগুলো হারাচ্ছে নাব্য। পলি জমে নদ-নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ায় এ অঞ্চলে মৎস্য সম্পদও উজাড় হতে চলেছে। মিঠা পানির কমপক্ষে ৫০ প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে।
×