ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তিলের তেল তৈরি ঐতিহ্যবাহী আফগান পেশা

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ২৮ মার্চ ২০১৮

তিলের তেল তৈরি ঐতিহ্যবাহী আফগান পেশা

একজন বয়োবৃদ্ধ আফগান কিছুক্ষণ পরপরই ঘানিতে পিষতে থাকা এক চিমটি ভাঙ্গানো তিল নিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলেন তেল বের করার জন্য এটি ঠিকভাবে পিষানো হয়েছে কিনা। একটি উট জোয়ালের মতো এক টুকরো কাঠ কাঁধে ঘানির চারপাশে ঘুরে চলেছে। তিলের তেল বের করার প্রক্রিয়াটি আফগানিস্তানের দৈনন্দিন খ-চিত্র মাত্র। যেখানে হাতে নয়, উট দিয়ে তিল থেকে তেল বের করা হয়। এএফপি। চারি আমিনি নামে একজন আফগান তার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এ দোকানের মালিকানা পেয়েছেন। তার ১২ বছরের ছেলে এ কাজে তাকে সাহায্য করছে এবং আগামীতে এ ব্যবসার হাল ধরার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে। স্থানীয় বাজার থেকে আমিনি তিল কিনে আনেন। এসব তিল উৎপাদিত হয় গম, হাশিশ বা পপি ক্ষেতের মাঝে যা বালখ প্রদেশের উর্বর মাটিতে চাষ হয়। এছাড়া প্রতিবেশি দেশ তুর্কমেনিস্তান বা উজবেকিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে উৎপাদিত কিছু তিলও বাজারে পাওয়া যায়। যদি তিলের মান ভাল হয়, তবে এক কেজি তিল পিষলে তা থেকে অন্তত আধা লিটার তেল পাওয়া যায়। উত্তর আফগানিস্তানের মাজার ই শরীফ এলাকায় ৩৫টি তিলের তেলের ঘানি আছে। আমিনি বলেন, আমরা সবাই সৎ, এই সততাই এই ব্যবসার মূল। বহু বছর ধরে দেশটিতে যুদ্ধ চলছে, তারপরও আমরা কিন্তু তেল উৎপাদন বন্ধ করিনি। এ থেকে যে খৈল তৈরি হয়, তা বাড়িতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেসব কৃষক তিল চাষ করে, তাদেরও তেল বের করে দেন আমিনি, একাজে প্রতি ৭ কেজি তিলের তেল বের করতে আমিনি মজুরি নেন ১০০ আফগানি যা মার্কিন ডলারের হিসেবে দেড় ডলারের মতো। তেলের এই ঘানিটি থেকে প্রতি মাসে গড়ে আমিনির আয় হয় ২০ হাজার আফগানি। এ আয় যদিও পপি ফুল থেকে হেরোইন তৈরির মতো লোভনীয় নয়, তবুও একজন সৈন্যের চেয়ে এ আয় যথেষ্ট ভাল। এ অর্থ দিয়ে ৫ সন্তানসহ আমিনির সংসারের খরচ ভালভাবেই মিটে যায়। মাজারই শরীফের সড়কের ধারেই আমিনির দোকান, যার সামনের অংশ গ্রাহকদের জন্য সব সময়ই খোলা থাকে। তার দোকানে একজন কর্মী আছেন, নাম আলোকোজাই। তার ঘানিতে প্রতি দুই ঘণ্টায় গড়ে ১১ কেজি তিল পিষানো হয়। আলোকোজাই ঘানিতে তেল বের করা ছাড়া পেশা হিসেবে আর অন্য কোন কাজই করতে চায়না। এ নিয়েই সে আজীবন ব্যস্ত থাকতে চায়। ঘানিতে যে দুটি উট আছে, তারা প্রত্যেকেই গড়ে ১০ ঘণ্টা করে কাজ করে। দেড় থেকে দু’বছর উটগুলো নিজের কাছে রেখে একটু মোটা তাজা হলে মুনাফার জন্য আমিনি তাদের বেচে দেয়। আফগানিস্তানের বাল্ক প্রদেশের প্রাদেশিক কৃষি বিভাগের পরিচালক জাবিউল্লাহ জুবিন জানালেন, অঞ্চলটিতে ঐতিহ্যবাহী রীতিতে ৫০টি ঘানিতে প্রতি বছর গড়ে তিন লাখ লিটার তিলের তেল উৎপাদিত হয়। প্রদেশটিতে ৩ শতাধিক কৃষক তিলের চাষ করে থাকেন। তবে বেশি অর্থের আশায় মাজার ই শরীফের আঞ্চলিক বাজারে তারা এ তিল বিক্রি করেন। গড়ে প্রতি কেজি তিল বিক্রি হয় ৯০ থেকে ১২০ আফগানিতে। জুবিন বলেন, আফগানিস্তানে খুব ভাল জাতের তিল উৎপাদিত হয়। তবে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে তিলের তেলের যে শিল্প এ অঞ্চলে গড়ে ওঠেছে তা থেকে উৎপাদিত পণ্য যদি বিদেশে পাঠাতে হয় তাহলে এখানে বিনিয়োগ করতে হবে এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা লাগবে। যোশেফ নিজাম নামে একজন আফগান ফ্রেঞ্চ ব্যবসায়ী ইউ এস এইডের সহায়তায় এ অঞ্চলে উৎপাদিত তিলের তেল বিদেশে রফতানির চেষ্টা করছেন। আমিনির একজন ক্রেতা বললেন, যন্ত্রে পিষে যে তিলের তেল তৈরি হয় তার তুলনায় উটে ভাঙ্গানো তিলের তেল আফগানিস্তানের ঐতিহ্যবাহী কাবুলি পোলাউকে আরও সুগন্ধি ও মিষ্টি করে, যা পুরোপুরি প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর। হাজি আবদুল ঘানি রাহমানি নামে একজন স্থানীয় চিকিৎসক যিনি তার ক্লিনিকে আমিনির দোকানের তেল ব্যবহার করেন তিনি বললেন, এ তেল অন্য যে কোন ট্যাবলেট বা ওষুধ থেকে আরও বেশি উপকারী। আপনি এটি শরীরে মাখুন এবং খানিকবাদেই ভাল বোধ করবেন।
×