ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভূগর্ভের পানিও এখন আর নিরাপদ নয়, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৮ মার্চ ২০১৮

ভূগর্ভের পানিও এখন আর নিরাপদ নয়, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এক মেয়ে, এক ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে ফাতেমার সংসার। সাভারের বিরুলিয়া গ্রামে বসবাস তার। সব মিলিয়ে সংসারটা সুখেই কাটছিল। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় তখন যখন তার ছোট ছেলে মারাত্মক ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলো। সে সুস্থ হতে না হতেই বড় মেয়েও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। অসুস্থ দুই সন্তান নিয়ে খুবই অসহায় হয়ে পড়েন ফাতেমা। অনেক অর্থ খরচ করার পরও বাচ্চারা অনেকদিন অসুখে ভুগে সুস্থ হয়। ফাতেমার ধারণা বাড়ির খাবার পানি সঠিকভাবে বিশুদ্ধ না করতে পারায়ই এই অবস্থা। শুধু ফাতেমা বেগমের নয়, গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী অনেক মানুষই বর্তমান নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানির যোগান থেকে বঞ্চিত। দূষিত পানি পানের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। গ্রামাঞ্চলের ব্যবহৃত টিউবওয়েলের পানিও এখন নিরাপদ নয়। কল-কারখানার বর্জ্য, কৃষি কাজে ব্যবহৃত কীটনাশক ভূগর্ভস্থ পানিতে মিশে পানিকে দূষিত করছে। যা অনেক সময় টিউবওয়েলের পানির সঙ্গে উঠে আসে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাই এখন সব টিউবওয়েলের পানি নিরাপদ নাও হতে পারে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন-এর স্যানিটারি ইন্সপেকশন গাইডলাইন অনুসারে দেশের ৪০ উপজেলায় পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা প্রায় ৬২ ভাগ টিউবওয়েলের পানি ‘মধ্যম থেকে উচ্চতর’ বিপদসীমার মধ্যে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিক হারে ভূগর্ভ স্তরের পানি উত্তোলনে প্রতিবছর পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ভারি ধাতু ও সিসার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ভূগর্ভ স্তরের পানিও দূষিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পানি অধিক হারে উত্তোলনের কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টির আশঙ্কাও করছেন তারা। এছাড়াও বিভিন্ন দূষিত পদার্থের উপস্থিতির কারণে গভীর নলকূপের পানিও এখন আর নিরাপদ থাকছে না পানি নেমে যাওয়ায়। সেখানে নানা ধরনের দূষিত পদার্থ পানিতে জমা হয়ে স্তরকে দূষিত করছে। এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথ পরিচালিত ওয়াটার কোয়ালিটি টেস্টিং ল্যাবরেটরির এক গবেষণায় বলা হয়েছে দেশের অধিকাংশ নলকূপের পানিতে ব্যাকটেরিয়া ছাড়াও ম্যাঙ্গানিজ নামের ভারি ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভারি এ ধাতুটি স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। মাটির নিচে পানির স্তরে ভারি ধাতুর উপস্থিতির কারণেই তা পানের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। আবার অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণেও পানির স্তর সমুদ্রের পানির উচ্চতার চেয়ে ৩-১০ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে যায়। প্রতিবছর যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে তা বৃষ্টি ও বন্যার মাধ্যমে পূরণ হচ্ছে না। সম্প্রতি গবেষণায় বলা হয়েছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বঙ্গোপসাগরের পানির গড় উচ্চতার তুলনায় নিচে নেমে যাওয়ায় সাগরের লোনা পানি অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতিতে প্রবাহিত হয়ে ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় টিউবওয়েলের পানি পান এখন স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশের কাছে এখনও বিশুদ্ধ খাবার পানি পৌঁছায় না। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের কাছে স্বল্প খরচে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাবার পানি পৌঁছে দেয়ার জন্য ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি) কর্তৃক গ্রহণকৃত সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ৬* ঘোষণা করেছে। এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী জনসাধারণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের ওয়াটার পিউরিফায়ার ব্র্যান্ড পির্ওইট ইউএনডিপি সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গ্লোবাল গোল ৬-এর কার্যক্রমের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে গ্রামাঞ্চলে বিশুদ্ধ পানি পৌঁছে দিতে কর্মসূচী স্থির করেছে। তারা জানায় দেশে জনসাধারণের জন্য বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাবার পানি নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পির্ওইট এবং এসডিআই যৌথভাবে পরিচালনা করছে মাইক্রোফাইন্যান্স কার্যক্রম। প্রধানত বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ, যারা সবচেয়ে বেশি দূষিত পানি পানের ঝুঁকিতে থাকে, তাদের বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানির চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। এই মাইক্রোফাইন্যান্স কার্যক্রম সম্পর্কে এসডিআইএর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর শামসুল হক বলেন, এসডিআই এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড আয়োজিত একটি অভিনব উদ্যোগ। যা এদেশের গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের জীবন আরও স¦াস্থ্যকর করে তুলতে সহায়ক হবে। পরবর্তীতে এসব মানুষ তাদের পরিবারের স্বাস্থ্য, উৎপাদনশীলতা ও আয়ের উন্নতি ঘটিয়ে সার্বিকভাবে নিজেদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সক্ষম হবে। মাইক্রোফাইন্যান্স কার্যক্রম অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী যে কেউ সুবিধাজনক মাসিক কিস্তিতে পির্ওইট ডিভাইস কেনার সুযোগ পাবেন। এক্ষেত্রে পির্ওইট ক্লাসিক-এর জন্য প্রতি মাসে মাত্র ২৫০ টাকা কিস্তি দিতে হবে। যা বিনা সুদে ১২ মাসে পরিশোধ করা যাবে। প্রতিটি পির্ওইট ক্লাসিক ডিভাইস থেকে একটি পরিবার ১৫শ’ লিটার বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাবার পানি পাবেন। আর এভাবেই পির্ওইট-এর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ৪ স্তরের পানি বিশুদ্ধকরণ প্রযুক্তি পৌঁছে যাবে দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে। তারা পাবে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাবার পানির নিশ্চয়তা। ২০১৭ সালের অক্টোবর মাস থেকে পরিচালিত এই মাইক্রোফাইন্যান্স কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পিওরইটি ও এসডিআই-এর সেফ ওয়াটার এজেন্টরা (এসডব্লিউএ) গ্রামাঞ্চলে পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধে প্রতিটি মানুষের কাছে বিশুদ্ধ পানি পান সংক্রান্ত বিষয়ে সচেতন করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই ৭ হাজার পরিবারকে বিশুদ্ধ পানি পান সংক্রান্ত বিষয়ে সচেতন করা হয়েছে। এই প্রোজেক্ট বর্তমানে সাভার এবং ধামরাই এলাকার চারটি গ্রামে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ফাতেমা বেগমের পরিবারও মাইক্রোফাইন্যান্স কার্যক্রমের সুবিধা নিয়েছেন। তিনি এ সম্পর্কে বলেন, ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড-এর ওয়াটার পিউরিফায়ার ব্র্যান্ড পির্ওইট এবং সোসাইটি ফর ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভসের (এসডিআই) পরিচালিত এক উঠান বৈঠকের মাধ্যমে জানতে পারি পরিবেশ দূষণের কারণে পানির অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। ফলে টিউবওয়েলের পানি বা ফোটানো পানি এখন আর পানের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ নয়। সেখান থেকেই আমি জানতে পারি ‘পির্ওইট’-এর ৪ স্তর বিশিষ্ট পানি বিশুদ্ধকরণ পদ্ধতির কথা। যা দেয় ফোটানো পানির থেকেও নিরাপদ পানি। মাইক্রোফাইন্যান্স প্রোজেক্টের কথা জানার পর আর দেরি না করে মাত্র ২৫০ টাকা মাসিক কিস্তিতে বিনা সুদে ঘরে এনেছি পির্ওইট ক্লাসিক ডিভাইস। আগে ২ বাচ্চার অসুস্থতার জন্য মাসে কমপক্ষে ৮শ’-১ হাজার টাকা খরচ হয়ে যেত। এখন মাসে ব্যয় হচ্ছে মাত্র ২৫০ টাকা। একই সঙ্গে পির্ওইট ডিভাইস পরিবারকে দিচ্ছে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাবার পানি। যার মাধ্যমে আমার বাচ্চারা থাকছে সুস্থ ও নিরাপদ! ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড-এর ওয়াটার পিউরিফায়ার ব্র্যান্ড পির্ওইট কর্মকর্তারা জানান বহু পরিবার মাইক্রোফাইন্যান্স প্রোজেক্টের মাধ্যমে শুধু স্বাস্থ্যরক্ষার ক্ষেত্রে নয় বরং আর্থিকভাবেও উপকৃত হতে শুরু করেছে। পির্ওইট ওয়াটার পিউরিফায়ার মাত্র ৫০ পয়সা/লিটার হিসেবে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাবার পানির নিশ্চয়তা দিতে প্রস্তুত। যা নিঃসন্দেহে সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। পির্ওইট ডিভাইসের প্রযুক্তি কঠিনতর ইউএসইপিএ গাইডলাইন মেনে চলে। তারা জানান পির্ওইট বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের ল্যাবে যাচাইকৃত একমাত্র ওয়াটার পিউরিফায়ার, যা নিশ্চিত করে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ও নিরাপদ প্রতি পানি। তারা উল্লেখ করেন, পির্ওইট ও এসডিআই পরিচালিত মাইক্রোফাইন্যান্স কার্যক্রমের মাধ্যমে এদেশে গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের কাছে নিরাপদ খাবার পানি পৌঁছে দিয়ে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ৬ অর্জনে বাংলাদেশ অনেকাংশেই এগিয়ে যাবে। একই সঙ্গে তারা বলেন, মাইক্রোফাইন্যান্স প্রোজেক্টের মতো বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে একত্রে এগিয়ে এলে দেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে বিশুদ্ধ খাবার পানি পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব।
×