ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হতে দারিদ্র্য বিমোচনের বিশ্ব মডেল

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৮ মার্চ ২০১৮

‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হতে দারিদ্র্য বিমোচনের বিশ্ব মডেল

আনোয়ার রোজেন ॥ ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর পশ্চিমা অর্থনীতিবিদদের মূল্যায়ন ছিল বাংলাদেশ টিকে থাকতে পারবে না এবং এটা হবে দরিদ্র রাষ্ট্রের উদাহরণ। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭২ সালে বলেছিলেন, বাংলাদেশ একটি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হতে যাচ্ছে। সব পূর্বাভাস-অনুমানকে ভুল প্রমাণিত করেছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের ১৬ মার্চ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক পত্রের মাধ্যমে জানিয়েছে, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের ক্যাটাগরিতে উত্তরণের তিনটি পূর্বশর্ত পূরণ করেছে। দারিদ্র্যবিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্য বিস্মিত করেছে গোটা বিশ্বকে। বাংলাদেশকে বলা হচ্ছে ‘দারিদ্র্যবিমোচনের বিশ্ব মডেল’। নব্বইয়ের দশকেও বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত অর্ধেকের বেশি লোক। ১৯৯১ সালে এই হার ছিল ৫৮ শতাংশ। ২০০৫ সালে এই হার নেমে আসে ৪১ শতাংশের মতো। আর গত ১৩ বছরে এটা আরও প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যানের হিসাবে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ দারিদ্র্যসীমা পেরিয়ে যাচ্ছেন। ২০১৭ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা জরিপ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ১৭ লাখ। প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ বাড়লে এই সংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৩৭ লাখের কাছাকাছি। জরিপ মতে প্রতিবছর দারিদ্র্য মুক্তি হচ্ছে ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে। অর্থাৎ বছরে ১৯ লাখ ৬৫ হাজারের মতো মানুষ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাচ্ছে। প্রতিদিনের হিসাবে এটা হয় পাঁচ হাজার ৩৮১ জন। ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্যবিমোচন, রফতানি আয়, বৈদেশিক শ্রমবাজার, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, সামাজিক বৈষম্য নিরসনসহ প্রায় সব সূচকেই অগ্রগতি করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী আগের ছয় বছরে দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত এই খানা জরিপ চালায় বিবিএস; তার আগের জরিপটি করা হয়েছিল ২০১০ সালে। ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী দেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১০ সালে যা ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০০৫ এ ছিল ৪০ শতাংশ। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী অতি দারিদ্র্যের হার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০১০ সালে ছিল ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সরকার ২০২০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়েছে। ওই সময়ে চরম দারিদ্র্য হার ৮ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করছে সরকার। বাস্তবতা বিবেচনায় ওই লক্ষ্য অর্জনে সঠিক পথেই আছে বাংলাদেশ। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পল্লী-কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, অনেকে এক সময় বলেছে আমাদের দেশের কোন ভবিষ্যত নেই। কিন্তু আমরা তো সেটাকে ভুল প্রমাণ করলাম। আমরা গত আট নয় বছরে ধারাবাহিকভাবে অগ্রগতি করেছি। অর্থনৈতিক, সামাজিক সূচকসহ প্রতি সূচকেই অগ্রগতি করেছি। এখন আমরা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করা দেশ। তিনি বলেন, যারা আমাদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছিল তারা হয়ত আমাদের পছন্দ করত না, হিংসা করত। খলীকুজ্জমান বলেন, আমাদের প্রায় সব খাতেই উন্নয়ন হয়েছে। বিশেষ করে কৃষি গ্রামীণ অর্থনীতি, রফতানি, রেমিটেন্স এসব দিকে বেশি অগ্রগতি হয়েছে। আরও উন্নতির সুযোগ রয়েছে। এখনও বাংলাদেশে তিন কোটি ৬৬ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে রয়েছে। আর এই মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ইউজিসি অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি এখনও দেশের এক নম্বর সমস্যা রয়ে গেছে। সর্বশক্তি দিয়ে শক্ত হাতে দুর্নীতিকে মোকাবেলা করতেই হবে। প্রাথমিক জ্বালানি ও ভৌত অবকাঠামোগত সমস্যাগুলো এখনও খুবই সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় রয়ে গেছে। এ বিষয়ে আরও মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। ২০১৮ সালের নির্বাচনী বছরে রাজনৈতিক হানাহানি ও জঙ্গীবাদী সন্ত্রাস ইতিবাচক অর্জনগুলোকে বরবাদ করে দিতে পারে। তাই এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। পাকিস্তানে দারিদ্র্যের হার বাংলাদেশের দ্বিগুণ ॥ বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজনের একজন দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকলেও পাকিস্তানে এই হার দ্বিগুণ। দেশটির প্রতি পাঁচজন মানুষের মধ্যে দরিদ্র দুইজন। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। সবশেষ জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ থেকে আট ধাপ পেছনে পাকিস্তান। বাংলাদেশের অবস্থান যেখানে ১৩৯তম, সেখানে পাকিস্তান ১৪৭। মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দিক দিয়েও এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৫৩৮ ডলার, পাকিস্তানে সেই জিডিপি এক হাজার ৪৭০ ডলার। একই সঙ্গে বেড়েছে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ও। পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় এখন এক হাজার ৩৮০ ডলার। সেখানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এক হাজার ৬০২ ডলার। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৩৩ বিলিয়ন ডলার যা পাকিস্তান থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার বেশি। বাংলাদেশে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আসায় দেশের অর্থনীতিতে বাড়ছে শিল্পের অবদান। এখানেও বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে আছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির শতকরা ২৪ শতাংশ আসে শিল্প খাত থেকে। অথচ বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের ৩০ শতাংশ আসে শিল্প খাত থেকে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল বেশি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি উল্টো হয়ে গেছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন প্রায় ১৬ কোটি ৩৭ লাখ। কিন্তু পাকিস্তানের জনসংখ্যা এখন প্রায় ২০ কোটি। দুই বছর আগের হিসাবে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩৭, পাকিস্তানে এই হার ২ দশমিক ২ শতাংশ। বাংলাদেশে মা প্রতি সন্তানের গড় সংখ্যা ২.১৪ জন। কিন্তু পাকিস্তানে এই সংখ্যা ৩.৫৫ জন।
×