ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রিপোর্টারের ডায়েরি

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৮ মার্চ ২০১৮

রিপোর্টারের ডায়েরি

দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে ২২ মার্চ, বৃহস্পতিবার। গাজীপুর থেকে গুলিস্তানগামী একটি বাস এয়ারপোর্টে যানজটে আটকা পড়ে। এক পর্যায়ে যাত্রীদের মধ্যে শুরু হয় সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা। এসময় এক যাত্রী ক্ষুব্ধ কণ্ঠে সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে থাকে। তার ভাষায় বর্তমান সরকার যানজট নিরসন করতে না পারাসহ সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ। এ কথা শুনে বাসের আরেক যাত্রী বলেন, এতকিছু অর্জনের পরও আপনি সরকারকে ব্যর্থ বলছেন। দেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল হলো এবং উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচিতি পেল। পদ্মা সেতু নির্মাণসহ এত উন্নয়ন কাজ হলো সেগুলো কি চোখে পড়ছে না! ওই বাসের আরেক যাত্রী সরকারের সমালোচনা করে বলতে থাকেন আমরা যারা প্রতিদিন যানজট ঠেলে বহু কর্মঘণ্টা নষ্ট করে উত্তরা-এয়ারপোর্ট এলাকা থেকে রাজধানীর কেন্দ্রে যাওয়া-আসা করি তাদের জন্য সরকার কি করেছে? এর জবাব দিতে গিয়ে অপর এক যাত্রী বলেন, সরকার অনেক কিছুই করছে। সামনে চেয়ে দেখুন এলিভেটেট এক্সপ্রেস ওয়ের কাজ চলছে। এটি হয়ে গেলে যানজটমুক্ত পরিবেশে বিমানবন্দর থেকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাজধানীর মতিঝিলসহ বিভিন্ন পয়েন্টে পৌঁছা যাবে। বাসটি খিলক্ষেত পৌঁছার পর এক যাত্রী পূর্ব দিকে কিছু খাস জমিতে দখলদারদের বিভিন্ন স্থাপনা তৈরির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, এই হচ্ছে উন্নয়নের নমুনা। এতক্ষণে বাসটি কুড়িল সেতুর ওপর ওঠে গেছে। এ সময় আরেক যাত্রী বলেন, এই যে ফ্লাইওভার দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপরপ্রান্তে চলে যাচ্ছেন এটা কি উন্নয়নের নমুনা নয়? কুড়িল থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত ৩০০ ফুট চওড়া রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে এটি কি উন্নয়নের ছোঁয়া নয়? এ কথা বলতে বলতেই বাসটি পৌঁছে গেল যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে। এ সময় আঙ্গুল দিয়ে যমুনা ফিউচার পার্ক দেখিয়ে তিনি বললেন, এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ শপিং পার্ক এখন বাংলাদেশে এটি কি উন্নয়নের লক্ষণ নয়? বাসটি নর্দা স্টেশন ছাড়িয়ে একটু সামনে গিয়ে আবার যানজটে পড়লে আরেক যাত্রী বলেন, সবাই দেখুন কত সুন্দর একটি রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করা হচ্ছে, আর এ কারণে আমাদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে, এর নাম কি উন্নয়ন? জবাবে আরেক যাত্রী বলেন, উন্নয়নের জন্যই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করা হচ্ছে। আর এই যে দেখছেন রাস্তার দুই পাশে বারিধারা কূটনৈতিক এলাকা এটি এক সময় ছিল নয়ানগর গ্রাম। নগর উন্নয়নের কারণেই এক সময়ের অবহেলিত একটি গ্রাম এখন রাজধানীর ‘এক্সক্লোসিভ জোন’। বাসটি নতুন বাজার স্টেশন অতিক্রম করতেই দেখা যায় ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকে কাগজপত্র দেখার নাম করে টাকা আদায় করছে। ক্ষুব্ধ এক যাত্রী বলেন, সরকার এত বেতন বাড়ানোর পরও ট্রাফিক পুলিশ বেপরোয়াভাবে গাড়ি আটকে টাকা নিচ্ছে। এটা দেখার কি কেউ নেই? বাড্ডা এলাকা অতিক্রমের সময় রাস্তার দুই পাশে কেবল সরকারী দলের ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুন দেখতে পেয়ে এক যাত্রী বলেন, দেশে কি বিরোধী দল নেই! তাদের ব্যানার-পোস্টার কোথায়? এভাবে কি দেশের উন্নয়ন হয়। এতক্ষণে বাসটি রামপুরা ব্রিজের ওপর চলে আসে। এ সময় এক যাত্রী সরকারের সমালোচনাকারীদের উদ্দেশ করে বলেন, ডান পাশে তাকিয়ে দেখুন হাতির ঝিলের নান্দনিক সৌন্দর্য। এটি এক সময় ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় ছিল। এখন বিনোদন কেন্দ্র। এটি কি দেশের উন্নয়ন নয়। আর সামনে যে ‘ইউ’ লোপটি দেখছেন এটি কি উন্নয়নের চিহ্ন নয়। বাসটি রামপুরা বাজারের কাছে গেলে এক যাত্রী রাস্তার ওপর বসা বাজার ও ময়লা আবর্জনার স্তূপ থেকে আসা দুর্গন্ধ ও সেখানে বসা মশা মাছির কথা উল্লেখ করে বলেন, দেশের উন্নয়ন করতে হলে এসব সমস্যার সমাধান করতে হয়। দীর্ঘদিনের এ সমস্যা সমাধানে কেউ এগিয়ে আসছে না। আরেকটু সামনে ওভার ব্রিজ দিয়ে মালিবাগ রেললাইন এলাকা অতিক্রম করার সময় এক যাত্রী রেললাইনের পাশে থাকা বস্তি ও সেখানে বসবাস করা হতদরিদ্র মানুষগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, কিভাবে তারা সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করছে- এই কি দেশের উন্নয়ন? এর জবাবে আরেকজন বলেন, ওরা আগে খেতে পেত না এখন তিনবেলা পেট ভরে খেতে পায়। তাদের পুনর্বাসনে সরকার বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। আর এই যে ফ্লাইওভার দিয়ে আমরা যাচ্ছি এর কারণে আবুল হোটেলের সামনে থেকে কাকরাইল মোড়ে পৌঁছতে পারছি মাত্র ৩ মিনিটে। আগে এটুকু রাস্তা অতিক্রম করতে এক ঘণ্টা সময় লেগে যেত। তাহলে কি দেশের উন্নয়ন হয়নি। আসলে কিছু মানুষ রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে, অন্ধ হয়ে গেছে। তারা বর্তমান সরকারের উন্নয়ন চোখে দেখে না। সরকার যদি দেশের উন্নয়ন নাই করত তাহলে কি জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি দিত! তার কথায় সায় দিয়ে আরেক বাস যাত্রী সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, বর্তমান সরকার দেশের যে উন্নয়ন করেছে স্বাধীনতার পর কোন সরকার তা করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণেই দেশের এত উন্নয়ন হয়েছে। তাঁর কারণেই বংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে। -শরীফুল ইসলাম সন্তানের চেয়ে দেশ বড়! ২৮ মে, ২০১৬। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল তাজিকিস্তান যাবে খেলতে। যাবার দিনই দলের দুই ফুটবলার ফয়সার মাহমুদ এবং নাসির উদ্দিন চৌধুরীর দুই রকম অনুভূতির পরিচয় পাই। একজন তার ছেলের প্রথম জন্মদিনে উপস্থিত থাকতে না পেরে কষ্ট পান। আরেকজন তার সদ্য জন্ম নেয়া দ্বিতীয় কন্যা সন্তানের মেয়ের মুখ দেখেই প্লেনে ওঠেন। মজার ব্যাপার, ওইদিন ২৮ মে ছিল আমার বড় বোন দিলরুবা কোহিনূর সুইটিরও জন্মদিন! ‘আজ আমার ছেলের প্রথম জন্মদিন, কিন্তু ওর কাছে যেতে পারছি না। কারণ দেশের স্বার্থ!’ কথাগুলো বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের ডিফেন্ডার ফয়সাল মাহমুদের। ছেলে আহনাফ বিন ফয়সাল। ডাকনাম নাদিফ। এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের প্লে-অফপর্বে এ্যাওয়ে ম্যাচ খেলতে সেদিন তাজিকিস্তানের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়বে বাংলাদেশ দল। আর তাই নাদিফের জন্মদিনে ইচ্ছে করলেও থাকতে পারেননি জাতীয় দলের সবচেয়ে সিনিয়র ফুটবলার ফয়সাল। ফয়সালের যখন এমন কষ্টদায়ক অনুভূতি, তখন এর বিপরীত অবস্থা জাতীয় দলের আরেক ডিফেন্ডার নাসির উদ্দিন চৌধুরীর বেলাতে। ওইদিনই চট্টগ্রামের মেহেদীবাগের একটি হাসপাতালে তাঁর স্ত্রী দ্বিতীয় কন্যা সন্তানের জন্ম দেন (প্রথম কন্যা তায়েবা চৌধুরী মাইশার বয়স ৭)। ফয়সাল তার ছেলের প্রথম জন্মদিনে তার পাশে থাকতে না পারলেও নাসির সৌভাগ্যবান। তিনি স্বচক্ষে তার মেয়ের মিষ্টি মুখখানি প্রাণভরে দেখার সুযোগ পান। এজন্য আগেই তিনি জাতীয় দলের ক্যাম্প থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার জন্য ছুটি নিয়েছিলেন কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফের কাছ থেকে। সেদিন সকালে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে গিয়ে, মেয়েকে দেখে আবার বিকেলেই ঢাকা ফিরে আসেন। পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, এত অল্প সময়ে কিভাবে ঢাকা টু চিটাগাং আসা-যাওয়া সম্ভব? উত্তরটা খুবই সহজ, বিমানযোগে! নাসির জানান, মেয়ে ও তার মা আল্লাহর রহমতে সুস্থ আছে। মেয়ের নাম এখনও ঠিক করিনি। তবে আপাতত ওকে প্রিন্সেস বলেই ডাকছি!’ ফয়সাল ঢাকার মোহাম্মদপুরে থাকলেও সেই মুহূর্তে তার স্ত্রী-ছেলে ছিলেন যশোরে। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, ‘আজ সকালে আমাদের অনুশীলন হয়েছে। বিকেলে হবে না। তারা যদি এখন ঢাকায় থাকত, তাহলে ক্যাম্প থেকে ছুটি পেলে, বিকেলে একবার ছেলেকে গিয়ে আদর করে আসতাম।’ নুসরাত আল নিশাতকে ভালবেসে (পরিবারের সম্মতিতেই, ফয়সাল মজা করে বলেন, প্রেমের সফল পরিণতি আর কি!) ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর বিয়ে করেন ফয়সাল। দীর্ঘ সাত বছর পর তাদের কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে শিশু নাদিফ। তার প্রথম জন্মদিনে অনেক আনন্দ করবেন হৈচৈ করবেÑ এমনটাই পরিকল্পনা ছিল ফয়সালের। জন্মদিনের অনুষ্ঠান অবশ্য ঠিকই হবে (ঘরোয়াভাবে), সবাই আসবে। কিন্তু থাকবেন না ফয়সাল। তিনি বলেন, ‘খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু কিছু করার নেই। সবার আগে নিজের দেশ। দেশ মানে মা। দেশের জন্য অনেকে নিজের জীবন দেয়, আর আমি এটুকু করতে পারব না? দেশ আমাকে কি দিল, সেটা বড় কথা নয়। আমি দেশকে যদি কিছু দিতে পারি, তাহলেই জীবনটা স্বার্থক!’ ফয়সাল নিজের ছেলে প্রসঙ্গে বলেন, ‘ছেলেটা যদিও ওর মায়ের ভক্ত বেশি, তবে আমি বাসা থেকে বেরুনোর সময় আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য অনেক অস্থির হয়। আমি চাই আমার ছেলে যেন বড় হয়ে আমার চেয়েও অনেক বড় জাতীয় বীর হয়। সেটা ফুটবলার বা যে কোন পেশাতেই হোক না কেন। সে কি হবে, এটা সে নিজেই ঠিক করবে। আমি কোন চাপ দেব না।’ সত্যি, ফয়সালের এই কথাগুলো শুনে খুব ভাল লেগেছিল। ভেবেছিলাম একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিকের তো এমনটাই হওয়া উচিত। -রুমেল খান
×