ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সারাদেশেই নতুন প্রজন্মের অভূতপূর্ব গণজাগরণ শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার কণ্ঠেই ধ্বনিত হয়েছে জঙ্গীবাদমুক্ত সমৃদ্ধ দেশের প্রত্যাশা

উন্নত দেশ গড়ার শপথ ॥ নানা আয়োজনে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপন

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৭ মার্চ ২০১৮

উন্নত দেশ গড়ার শপথ ॥ নানা আয়োজনে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ স্বাধীনতা দিবসে এক অন্যরকম স্বস্তি, আনন্দ ও শপথে জেগে উঠেছিল বাঙালী। সারাদেশেই নতুন প্রজন্মের অভূতপূর্ব গণজাগরণ এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবারের স্বাধীনতা দিবসে। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তস্নাত লাল-সবুজের পতাকা হাতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের কণ্ঠেই ধ্বনিত হয়েছে জঙ্গীবাদমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রত্যাশার কথা। কালরাতের আঁধার পেরিয়ে আত্মপরিচয় অর্জন ও পরাধীনতার শিকল ভাঙ্গার দিনটি বাঙালী জাতি হৃদয়ের গভীরতা থেকে শ্রদ্ধার সঙ্গেই উদযাপন করেছে নানা অনুষ্ঠানমালায়। সোমবার দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয়ে স্বাধীনতা দিবসে জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ৪৭ বছর পূর্ণ করা বাংলাদেশে এবার স্বাধীনতা দিবস এসেছে নতুন অনুষঙ্গ নিয়ে। এ বছরই স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ওঠার যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতি মিলেছে জাতিসংঘের কাছ থেকে। এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের সামনে যেমন নতুন চ্যালেঞ্জ এনে দিয়েছে, তেমনি রয়েছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে আরও এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণে সোমবারের প্রতিটি অনুষ্ঠানেই ছিল জঙ্গীবাদ-সাম্প্রদায়িকতামুক্ত অসাম্প্রদায়িক উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের দৃঢ় শপথ। দেশ মাতৃকার জন্য আত্মোৎসর্গকারী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবারও মানুষের স্রোত ছিল চোখে দেখার মতো। জঙ্গীবাদের মূলোৎপাটনের দৃপ্ত শপথে লাখো মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে বীর শহীদদের প্রতি। রাস্তায় বের হওয়া শিশু-কিশোর ও তরুণদের হাতে, কারও গালে কিংবা কপালে আঁকা ছিল রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা, প্রিয় মাতৃভূমির মানচিত্র। তরুণ প্রজন্মের ছেলেদের গায়ে জাতীয় পতাকা সদৃশ্য শর্ট পাঞ্জাবি বা গেঞ্জি এবং মেয়েদের পরনে লাল-সবুজের মিশ্রণে জাতীয় পতাকার মতো শাড়ি। সবাই অংশ নিয়ে ছিলেন এবারের স্বাধীনতার আনন্দ-উৎসবে। রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা কণ্ঠে তরুণ প্রজন্মরা শুনেছে তাদের বীরত্বগাথা ইতিহাস, জেনেছে একাত্তরে রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের গণহত্যা, মা-বোনদের সম্ভ্রমহরণ ও বুদ্ধিবীজীদের হত্যার কালো ইতিহাস। তাই শুধু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাধারণ মানুষই নয়, তরুণ প্রজন্মের চোখে-মুখে স্বাধীনতাবিরোধী ও জঙ্গীদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা-ধিক্কারের বহির্প্রকাশ ঘটেছে সর্বত্র। রাজধানী থেকে শুরু করে শহর-বন্দর-গ্রামে দেশের জন্মদিনের প্রতিটি অনুষ্ঠানে নতুন প্রজন্মের ঢল, তাদের চোখে-মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখার দৃপ্ত শপথ আর স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার প্রচ-তা প্রত্যক্ষ করেছে দেশের মানুষ। নতুন প্রজন্মের এমন গণজাগরণ আশাবাদী ও সাহসী করে তুলেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষকে। রাজনীতিক থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই দৃঢ় আশাবাদী- ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নতুন প্রজন্মের এমন জাগরণ জানান দিচ্ছে, যতই ফণা তোলার চেষ্টা করুক, জঙ্গীবাদ-সাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রবিরোধী অন্ধকারের শক্তির দিন শেষ। যুদ্ধাপরাধী রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের নির্মূল করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন এক জন্মভূমির যাত্রা শুরু হবেই। আনন্দ, বেদনা ও বিনম্র শ্রদ্ধায় মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণ এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদমুক্ত অসাম্প্রদায়িক স্বনির্ভর সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে সোমবার বাঙালী জাতি অন্যরকম স্বস্তি ও উৎসবের আমেজে পালন করল মহান স্বাধীনতার ৪৭ বছর পূর্তি ও জাতীয় দিবস। শ্রদ্ধাবনত জাতি ফুলে ফুলে ভরে দেয় সাভারস্থ জাতীয় স্মৃতিসৌধ, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি এবং টুঙ্গিপাড়ার বঙ্গবন্ধুর মাজারের বেদিমূল। লাল-সবুজ পতাকা হাতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের কণ্ঠেই ধ্বনিত হয়েছে একই স্লোগান- ‘মুজিবের বাংলায়, স্বাধীনতাবিরোধী ও জঙ্গীদের ঠাঁই নাই, জামায়াত-শিবির-রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়।’ তবে স্বাধীনতা দিবসে আনন্দমুখর এ উৎসবে বরাবরের মতো এবারও অন্তঃস্রোতে বয়ে গেছে স্বজন হারানোর বেদনা। আর বাঙালীর জাতীয় জীবনে আনন্দ-বেদনার এমন দ্বৈরথের ঘটনা খুব বেশি নেই। বাঙালী জাতি আনন্দ আর বেদনার মহাকাব্য স্বাধীনতার সংগ্রামে একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম সাহসীকতা আর হাজারো নারীর আত্মত্যাগের বীরত্বগাথা। অন্যদিকে বর্বর পাকসেনা আর রাজাকার-আলবদরদের নিচুতা, শঠতা ও হিংস্রতার কলঙ্কময় ইতিহাস। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় ৪৭ বছর আগের এ দিনে পাকিস্তানী বাহিনীর দমন অভিযানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এ ভূ-খ-ের মানুষ। তার পরের ৯ মাস পাকিস্তানী বাহিনী আর তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর চক্র চালিয়েছে ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ। তাই স্বাধীনতা দিবসের এই দিনে দেশবাসী শ্রদ্ধা আর বেদনায় স্মরণ করে যুদ্ধে নিহত স্বজনদের আর অসম লড়াইয়ে বিজয়ী রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। সোমবার রাজধানী থেকে শুরু করে সাভার স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত পরিণত হয়েছিল উৎসবের সেøাগানে বজ্রভূমিতে। যেখানে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা লাল-সবুজে সজ্জিত হয়ে পথে নেমেছিলেন জাতির প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের দাবিতে। পথে পথে ব্যান্ড বাজিয়ে, গলা ছেড়ে দেশের গান গেয়ে, সেøাগানে সেøাগানে আশপাশে সচকিত করে তরুণরা প্রাণস্পন্দিত করে রেখেছিল স্বাধীনতার এ দিনটিকে। প্রত্যুষে তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দর এলাকায় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে সূচনা হয় স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানমালার। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে বীর শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সশস্ত্র বাহিনীর একটি সুসজ্জিত চৌকস দল এ সময় গার্ড অব অনার প্রদান করে। বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। জাতীয় সংসদের স্পীকার, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, বিচারপতি, তিন বাহিনীর প্রধানসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে দলীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সকাল ৭টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানম-ি ৩২ নম্বর সড়কে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে শিশু-কিশোরদের সমাবেশে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন এবং বক্তব্য রাখেন। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোমবার ছিল সরকারী ছুটি। স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বেতার, টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হয়। সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন ভবনে, বাড়িঘর, যানবাহন ও দোকানে উড়েছে জাতীয় পতাকা। সরকারী গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোতে আলোকসজ্জা করা হয়। সারাদেশে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মসজিদে বিশেষ মোনাজাতে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত, দেশের শান্তি ও অগ্রগতি কামনা করা হয়। মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাতেও অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ প্রার্থনা সভা। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন-প্রতিষ্ঠান আনন্দ শোভাযাত্রা, আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আলোকচিত্র প্রদর্শনী, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাসহ নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মহান স্বাধীনতা দিবস পালন করে। টুঙ্গিপাড়াতেও নেমেছিল স্বাধীনতার পক্ষের মানুষের ঢল। অজস্র মানুষের শ্রদ্ধাঞ্জলির ফুলে ফুলে ভরে উঠে স্বাধীনতার মহান স্থপতির মাজারের বেদিমূল। সশস্ত্র বাহিনীও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন করে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্র, হাসপাতাল, জেলাখানা, সরকারী শিশুসনদসহ অনুরূপ প্রতিষ্ঠান সমূহে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হয়। সাভারে লাখো মানুষের ঢল ॥ সাভার থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা সৌমিত্র মানব জানান, মহান স্বাধীনতা দিবসে লাখো মানুষের ধ্বনিতে দিনভর মুখরিত ছিল জাতীয় স্মৃতিসৌধ। সকাল থেকে ফুলে ফুলে ভরে উঠেছিল স্মৃতিসৌধের বেদি। একই সঙ্গে দেশাত্মবোধক গান ও মুহুর্মুহু সেøাগানে মুখরিত হয়ে উঠছিল জাতীয় স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ। শ্রদ্ধায় অবনত জাতি এদিন আবারও স্মরণ করল মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ অমর সূর্য সন্তানদের। স্মৃতিসৌধে এদিন সকাল থেকেই ছিল সর্বস্তরের মানুষের ভিড়। এদিন ভোর ছয়টায় দেশ ও জাতির পক্ষ থেকে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ, প্রধান বিচারপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান প্রমুখ জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা জানান। এরপর অন্যান্য বিচারপতিগণ, তিন বাহিনীর প্রধান ও বিদেশী কূটনীতিকবৃন্দ শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য ভিআইপিদের শ্রদ্ধা জানানোর পর জাতীয় স্মৃতিসৌধ সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয়। স্বাধীনতা দিবসে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই সাধারণ মানুষ ভিড় জমাতে শুরু করে জাতীয় স্মৃতিসৌধের সামনে। বেলা বাড়ার সঙ্গে বৃদ্ধি পেতে থাকে সেই ভিড়। শহীদদের বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, জাতিসংঘ ঘোষিত উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ প্রমাণ করে স্বাধীনতার ৪৭ বছরে দেশ কতটা এগিয়েছে। এখনও যেসব স্বাধীনতা বিরোধী সোচ্চার রয়েছে, তাদের মূলোৎপাটন করা হবে। বিএনপিকে জঙ্গীবাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক আখ্যায়িত করে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ও স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতিরোধের আহ্বান জানান তিনি। জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, বাংলাদেশ এখনও আশঙ্কামুক্ত হয়নি। কারণ, দেশে পাকিস্তানী শক্তি প্রক্সি খেলায় মেতে উঠেছে। ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসে দেশের সব সংগঠন কর্মসূচী দিলেও বিএনপি কোন কর্মসূচী দেয়নি। এরা জাতির পিতা, গণহত্যা দিবস ও ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা মানে না। এরা পাকিস্তানী আদর্শে চলে। জঙ্গীবাদ ও রাজাকার যেমন দেশের শত্রু, তার চেয়েও বড় শত্রু তারা- যারা এদের লালন করে। তাই, আমাদের সামনে এখন দুটি বড় চ্যালেঞ্জ। একটি হলো- সঠিক সময়ে নির্বাচন আয়োজন করা এবং অপরটি জঙ্গীবাদ ও রাজাকার লালনকারী দল বিএনপিকে ক্ষমতার বাইরে রাখা। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বলেন, অনেক দাম দিয়ে পাওয়া এ স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দীর্ঘদিন আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছিল। আমরা তাদের পরাজিত করে বিচারের আওতায় এনেছি। আশাকরি সামনের দিনগুলোতে বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে। এ দেশের মানুষের মুক্তির যে আকাক্সক্ষা, দারিদ্র্য থেকে, ক্ষুধার জ্বালা থেকে মুক্তির জন্য মানুষ সামনের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে চলেছে এবং আরও এগিয়ে যাবে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারান্তরীণ থাকায় এদিন সকাল পৌনে ১০টার দিকে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলীয় অন্যান্য নেতাকর্মীর সঙ্গে নিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধের শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। দলটির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, নজরুল ইসলাম খান, মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান ডাঃ এ জেড এম জাহিদ হোসেন, মোঃ শাহজাহান, শাহজাহান ওমর, যুগ্ম মহাসচবি খায়রুল কবির খোকন, চেয়ারপার্সনের উপদষ্টো আমানউল্লাহ আমান প্রমুখ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মির্জা ফখরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, গণতন্ত্র রক্ষার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, তা এখন অবরুদ্ধ। তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এখন জেলখানায় আটক। মানুষের বাক স্বাধীনতা নেই। রাজনীতি করার অধিকার নেই। কোথাও গণতন্ত্র নেই। আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লড়াই করছি। গণতন্ত্র ফিরে না আসা পর্যন্ত লড়াই চলবেই। এছাড়া দেশে বর্তমানে কোন আইনের শাসন নেই। যদি দেশে গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন থাকত, তাহলে আমাদের নেত্রীকে জামিন পাওয়ার পরও জেলে থাকতে হতো না। এদিন বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এর মধ্যে রয়েছে জাসদ, সিপিবি, বাসদ, জাতীয় পার্টি (জেপি), জাগপা, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল), ন্যাপ, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, ঢাকা মহানগন আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেকক লীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, স্বাচিপ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর হলসমূহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও এর হলসমূহ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ^বিদ্যালয় ও এর হলসমূহ, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, সাভার গণবিশ^বিদ্যালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন, দুপ্রক (সাভার উপজেলা), ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, ক্রাইম রিপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন, সাভার প্রেসক্লাব, আশুলিয়া প্রেসক্লাব, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, ডক্টরস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব), সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমি, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতর, ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, এডাব, সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, জনতা ব্যাংক লিমিটেডসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসমূহ। বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণ জনারণ্য ॥ দেশের জন্মদিনে ধানম-ির ৩২ নম্বর ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণ সোমবার ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিল জনারণ্য। অজস্র কৃতজ্ঞ বাঙালী বিনম্র শ্রদ্ধা জানান স্বাধীন রাষ্ট্রের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জাগরণী দেশাত্মবোধক গান, সেøাগান আর মিছিলে মিছিলে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন প্রাঙ্গণ দিনভর ছিল মুখরিত। হাজার হাজার মানুষ বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ঘুরে দেখেন। সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানম-ির বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে রক্ষিত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রতিকৃতির সামনে কিছুক্ষণ নিরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। পরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানান শেখ হাসিনা। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর প্রধানমন্ত্রী এলাকা ত্যাগ করলে সর্বসাধারণের জন্য স্থানটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এরপর দুপুর পর্যন্ত দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অজস্র সংগঠন বঙ্গবন্ধুকের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে উপস্থিত হাজারো জনতার ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগানে পুরো এলাকা মুখরিত হয়ে উঠে। বঙ্গভবনে এক অন্যরকম মিলনমেলা ॥ দেশের জন্মদিনে সোমবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের উপস্থিতিতে সরগরম ছিল বঙ্গভবনের সবুজ প্রাঙ্গণ। লাল-সবুজ পাতা দিয়ে তৈরি করা একটি পতাকা অনুষ্ঠানে আনে ভিন্নমাত্রা। ব্যান্ডের সুরের মূর্ছনা, খ্যাতনামা শিল্পীদের গানসহ নানা আয়োজনে সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে বিভিন্ন দলের রাজনীতিক, কূটনীতিক, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবার এবং শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে নিয়ে বঙ্গভবনে স্বাধীনতার ৪৭তম বার্ষিকী উদযাপন করলেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ; সঙ্গে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিকাল পৌনে ৫টায় স্ত্রী রাশিদা খানমকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গভবনের মাঠে আসেন রাষ্ট্রপতি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গভবনে পৌঁছান তার কিছুক্ষণ আগে। রাষ্ট্রপতি সস্ত্রীক মঞ্চে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় জাতীয় সঙ্গীত। এরপর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কুশল বিনিময় করেন। পরে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবারের সদস্যসহ আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন তারা। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নেয়ার পাশাপাশি তাদের সার্বিক সহায়তার আশ্বাস দেন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান। এরপর বঙ্গভবনের মাঠে ভিভিআইপি এনক্লোজারে স্বাধীনতা দিবসের কেক কাটেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। পরে মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, বিদেশী অতিথি, সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি, সংসদ সদস্য, গণমাধ্যমের সম্পাদক, তিন বাহিনীর প্রধানসহ সামারিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন তারা। অনুষ্ঠানে সংরক্ষিত এলাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে বসেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহানাও ছিলেন অনুষ্ঠানে, ছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদও। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে। ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, ড. মসিউর রহমান। ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা, ব্রিটিশ হাইকমিশনার এলিসন ব্লেইক, চীনের দূত ঝ্যাং জুয়ো, ডিপ্লোম্যাটিক কোরের ডিন ভ্যাটিক্যানের দূত জর্জ কোচেরি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূত রেনসে টিরিংক, জাপানের রাষ্ট্রদূত হিরোইয়াসু ইজুমিসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের এই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন অতিথি হয়ে। নাট্যব্যক্তিত্ব হাসান ইমাম, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ শিল্পাঙ্গনের বিভিন্ন পরিচিত মুখ বঙ্গভবনের এই অনুষ্ঠানে ছিলেন। ভারতের প্রেসক্লাবের সভাপতি গৌতম লাহিড়ী ও সাধারণ সম্পাদক বিনয় কুমারও বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। শিল্পী রথীন্দ্র নাথ রায়, রফিকুল আলম, ফাহমিদা নবী, হৈমন্তী রক্ষিত, কোনাল ও হায়দার হোসেন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে শোনান।
×