ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পীর তুলিতে একাত্তর

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ, ভাস্কর্য ম্যুরাল ও লাল সবুজের সমারোহ

প্রকাশিত: ০৫:০০, ২৭ মার্চ ২০১৮

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ, ভাস্কর্য ম্যুরাল ও লাল সবুজের সমারোহ

সুবল বিশ্বাস ॥ এ যেন কোন এক শিল্পীর রং-তুলিতে আঁকা নিখুঁত মুক্তিযুদ্ধময় এক ছবির জনপদ। কোথাও নৌকায় চড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের প্রবহমান ’৭১ ভাস্কর্য, কোথাও অস্ত্র হাতে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে স্বাধীনতা স্মৃতিস্তম্ভ ভাস্কর্য, রয়েছে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ, কোথাও রয়েছে সড়ক ’৭১, আবার ’৭১ চত্বরসহ অসংখ্য ভাস্কর্য-স্মৃতিস্তম্ভ-ম্যুরাল। এখানেই শেষ নয়, উপজেলার বিভিন্ন সেতু, স্থাপনা ও দোকানপাট সবকিছুতেই রয়েছে লাল সবুজের সমারোহ। মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ভবনসহ একাধিক স্থাপনা। এ যেন মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের গ্রাম। এমন দৃশ্য জেলার বা দেশের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। জেলার মধ্যে শিবচর উপজেলায় মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে ইতিহাস গড়ে তোলা হয়েছে। এসব মহান কর্মের নেপথ্যে রয়েছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুজিব বাহিনীর কোষাধ্যক্ষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে মরহুম ইলিয়াস আহম্মেদ চৌধুরী এমপির (দাদাভাই) যোগ্য উত্তরসূরি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের সাধারণ সম্পাদক নূর-ই আলম চৌধুরী এমপি। তার এ মহান উদ্যোগের কারণেই নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। শিবচর উপজেলার এ দৃষ্টান্ত দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেয়ার দাবি মুক্তিযোদ্ধাদের। ভৌগলিক কারণে পদ্মা সেতুসহ দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশদ্বার মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা বহুল পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই উপজেলার বীর সন্তানদের রয়েছে অনন্য অবদান। তৎকালীন প্রাদেশিক সরকারের এমপি ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী দাদাভাই ছিলেন মুজিব বাহিনীর কোষাধ্যক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তার দিক নির্দেশনায় শিবচর থেকে পার্শ^বর্তী ৯ উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী দাদাভাই-এর বড় ছেলে স্থানীয় সংসদ সদস্য নূর-ই আলম চৌধুরীর নানা উদ্যোগ দেশে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। উপজেলাটিতে ঢুকতেই একের পর এক সেতু লাল সবুজের রঙে রাঙানো। বঙ্গবন্ধুর বড় বোন চৌধুরী ফাতেমা বেগম পৌর অডিটোরিয়ামের সামনে প্রায় ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে পানির ফোয়ারার মাঝে নৌকায় চড়ে একদল শাড়ি পরা নারী, লুঙ্গি কাছা দেয়া খালি গায়ে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের ‘প্রবাহমান ’৭১ ভাস্কর্য’। প্রায় ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত কলেজ মোড়ে অস্ত্র তাক করে ‘স্বাধীনতা স্তম্ভে’ দাঁড়িয়ে আছে বীর সেনানীরা। পৌরবাজারে দীর্ঘ একটি সড়ক নামকরণ করা হয়েছে ‘সড়ক ’৭১’ নামে। যেখানে লাল সবুজ রঙে সজ্জিত শতাধিক দোকানও রয়েছে। ’৭১ সড়কে প্রবেশমুখেই প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ’। উপজেলা পরিষদের সামনে প্রায় ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে থাকা একদল মুক্তিযোদ্ধাদের ভাস্কর্য। শহীদদের কবরের পাশে তৈরি করা হয়েছে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি স্তম্ভ।’ যেখানে স্থানীয় ১৩ জন শহীদদের নামসহ যুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। শেখ ফজিলাতুন্নেছা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রায় ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে শেখ ফজিলাতুন্নেছার এক অসাধারণ ভাস্কর্য। ’৭১ চত্বর, বিজয় চত্বর, বরহামগঞ্জ চত্বর, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালসহ অসংখ্য ম্যুরাল। যার প্রায় সবই স্থানীয় সংসদ সদস্য নূর-ই আলম চৌধুরীর নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থ ব্যয় করে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ভাস্কর্য, ম্যুরালসহ বিভিন্ন স্থাপনা মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বহন করছে। বিভিন্ন রাস্তাঘাট শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ, স্কুলের বিভিন্ন ভবন মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ ও বিভিন্ন সেতু মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ করা হয়েছে। বিভিন্ন হাট-বাজারের দোকানপাটও লাল সবুজ সাজে সজ্জিত। সব মিলিয়ে এ যেন জাতীয় পতাকার লাল সবুজের সমারোহ ও ভাস্কর্য সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশের স্বাধীনতার জনপদ। এসব স্মৃতিস্তম্ভে সকল জাতীয় দিবস পালন উপলক্ষে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানমালার। এসব অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষ বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে শিবচরকে মডেল গণ্য করার দাবি বীর মুক্তিযোদ্ধা, জনপ্রতিনিধি, সাধারণ জনগণসহ সকলের। স্কুল শিক্ষার্থী আলমাস বলেন, ‘আমরা কখনও শিবচরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতাম না। বর্তমানে বাজারের বিভিন্ন স্থানে ভাস্কর্য দেখে মুরব্বিদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধে শিবচরের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারছি আর গর্বিত হচ্ছি।’ রিজিয়া বেগম মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ বাবুল আশরাফ বলেন, ‘শিবচর যেন এক মুক্তিযুদ্ধের শহরে রূপ নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের এত স্মৃতি সংরক্ষণ আর কোথাও নেই। এখান থেকে শিক্ষা নিয়েই নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ হতে পারবে।’
×