ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আলুর ন্যায্যমূল্য না পেয়ে লোকসানের আশঙ্কায় হতাশ রংপুরের কৃষক

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ২৭ মার্চ ২০১৮

আলুর ন্যায্যমূল্য না পেয়ে লোকসানের আশঙ্কায় হতাশ রংপুরের কৃষক

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর ॥ আলুর ন্যায্যমূল্য না পেয়ে লোকসানের আশঙ্কায় হতাশায় ভুগছেন রংপুরের কৃষক। কম দামের কারণে অনেকেই বস্তাভর্তি আলু জমিতে রেখে দিয়েছেন। কৃষকরা জানিয়েছেন, গত বছর যে মজুদদার ব্যবসায়ীরা হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করেছিলেন তারা চরম লোকসান খেয়েছেন। অনেকে লোকসানের কারণে পুঁজি হারিয়ে ব্যবসা বাদ দিয়েছেন। ফলে এখন বাজারে আলু কেনার লোক নেই। আবার লোকসানের ভয়ে এবারে চাষীরাও হিমাগারে আলু সংরক্ষণ না করে এখনই বিক্রির চেষ্টা করছেন। তাই বাজারে সরবরাহ বেড়েছে, ক্রেতা কমেছে, ফলে আলুর চাহিদা কমে যাওয়ায় দামও কমেছে। রংপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা যায়, ৮৫ কেজির প্রতি বস্তা গ্রানুলা সাদা আলু কৃষক পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা, লাল স্টকি, কার্ডিনাল ও ডায়মন্ড আলু বিক্রি হচ্ছে প্রতি বস্তা ৫৫০ টাকা। রংপুর সদরের দর্শনা ইউনিয়নের কৃষক রবিউল ইসলাম জানান, প্রতি বস্তা আলুর উৎপাদন খরচ হয়েছে ৭০০-৮০০ টাকা। বর্তমান আলুর মূল্যে তাকে বস্তা প্রতি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এ বছর তিনি ১৪ দোন (প্রতি দোন ২২ শতক) জমিতে আলু আবাদ করেছেন। তিনি সেখানে আলু পেয়েছেন ৪০০ বস্তা যার বর্তমান বিক্রয় মূল্য ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। অথচ এর উৎপাদন খরচ হয়েছে তার ২ লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা। রংপুরে প্রতিবছর এ সময়ে সবগুলো হিমাগারে আলু মজুদের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে থাকে। তবে এ বছর সবগুলো হিমাগারে এখনও এক তৃতীয়াংশ জায়গা ফাঁকাই পড়ে আছে। কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, আলু ব্যবসায়ীরা অর্থের অভাবে আলু ক্রয় করতে পারছেন না । গতবছর আলুতে ব্যাপক লোকসান হওয়ায় তারা পুঁজি সঙ্কটে পড়েছেন। এ কারণে ক্ষেত থেকে আলু ক্রয় করার ব্যবসায়ী নেই। এ কারণে আলুর ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষক। নগরীর সাতমাথা এলাকার আলু মজুদকারী ব্যবসায়ী যাদু মিয়া বলেন, গত ১০০০ বস্তা আলু কোল্ডস্টোরে রেখেছিলাম। আলুর ক্রয় মূল্য ছিল প্রতি বস্তা ৬০০ টাকা। আবার স্টোর ভাড়া ৩২০ টাকা। সংরক্ষিত আলুর মোট মূল্য দাঁড়িয়েছিল ৯২০ টাকা। অথচ, সেই আলু বিক্রি করতে হয়েছে ৩৫০ টাকায়। অর্থাৎ বস্তা প্রতি আমার লোকসান হয়েছে ৫৭০ টাকা। তাই এবারে আলু কেনার মতো পুঁজি আমার নেই। তিনি বলেন, আমার মতো অনেক ব্যবসায়ী এবারে আলু কিনছেন না। রংপুর মাহিগঞ্জ এলাকার আলু ব্যবসায়ী আব্দুস সবুর জানান, গত বছর তিনি প্রায় পচিশ লাখ টাকা লোকসান করেছেন। এ বছর আলু ক্রয় করার মতো তার সামর্থ্য নেই। তার মতো কয়েক শ’ আলু ব্যবসায়ীর একই অবস্থা। তারা আলু ক্রয় না করলে কৃষকের আলু অবিক্রীতই থেকে যাবে। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রংপুর জেলায় ৫১ হাজার ২শ’৭৫ হেক্টর জমিতে আলু চাষ করা হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি বলা হলেও কৃষকরা জানিয়েছেন ভিন্ন কথা। কৃষকদের মতে এ বছর গতবারের তুলনায় অন্তত ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কম জমিতে আলু চাষ করা হয়েছে। তবে এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। যা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে। অন্যদিকে, রংপুরের ব্যাংকগুলো অন্যান্য বছর আলুর ওপর হিমাগার মালিকদের যেভাবে ঋণ দিত এ বছর তা দিচ্ছে না। এর কারণও গত বছর আলুতে ব্যাপক লোকসান। সাধারণত ব্যাংকগুলো ঋণ দেয় হিমাগার মালিকদের। হিমাগার মালিকরা সেই টাকা আলু সংরক্ষণকারীদের ঋণ দিয়ে থাকেন। বছর শেষে আলু ছাড়ের সময় সেই টাকা সুদসমেত কেটে নেয় হিমাগার মালিকরা। গত বছরের শেষদিকে আলুর দাম এত নিচে নেমে গিয়েছিল যে, হিমাগারের ভাড়া দেয়ার ভয়ে অনেকেই আলু উত্তোলন করেন নি। এতে ব্যাংকের অনেক টাকা অনাদায়ী রয়ে গেছে। এ কারণে এ বছর ব্যাংকগুলো হিমাগার মালিকদের কোন ঋণ দিচ্ছে না। এ কারণেও আলুর চাহিদা কমে গেছে। মোতাহার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক ও রংপুর চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মোস্তফা সরোয়ার টিটু জানান, গেল বছর মোতাহার গ্রুপের সাতটি হিমাগারে আলু সংরক্ষণকারীদের কাছ থেকে পাঁচ কোটি টাকার ঋণ ফেরত পাওয়া যায়নি। এ কারণে এ বছর তারা আলুতে কোন ঋণ দিতে পারছেন না। একই কথা জানিয়েছেন আরও কয়েকটি হিমাগারের মালিকরা। আলুর দাম কমে যাওয়ার আর একটি বড় কারণ হলো এবারে বিদেশে আলু রফতানি কমে যাওয়া। প্রায় চার বছর আগে রাশিয়া বাংলাদেশ থেকে আলু আমদানি বন্ধ করেছে। এরপরও কিছু আলু বাংলাদেশ থেকে গতবছর মালয়েশিয়া ও সিংঙ্গাপুর এবং নেপালে রফতানি হতো। কিন্তু এ বছর এখন পর্যন্ত রফতানিকারকদের কাছ থেকে সাড়া মেলেনি। রংপুর নব্দিগঞ্জের আলু ব্যাবসায়ী শরিফুল আলম জানান, আমি গেল বছর মার্চ মাসে রফতানিকারককে প্রায় একশত ট্রাক আলু সরবরাহ করেছি। এ বছর এখনও পাঁচ ট্রাক আলু দিতে পারিনি। কৃষি বিপণন অধিদফতরের রংপুর আঞ্চলিক প্রকল্প পরিচালক আনোয়ারুল করিম জানিয়েছেন, আলুর বর্তমান বাজার দর কিছুটা কম। তবে তিনি কৃষকদের এই মুহূর্তে আলু না বেচার পরামর্শ দিয়ে বলেন, কৃষকদের উচিত দেশীয় পদ্ধতিতে বাড়িতে আলু সংরক্ষণ করা। বাড়িতে মাচা করে দুই বা তিন মাস বাড়িতে আলু সংরক্ষণ করতে পারলে কৃষকরা আলুতে ভালো দাম পাবেন বলে তিনি মন্তব্য করেন।
×