ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লায়ন ডাঃ বরুণ কুমার আচার্য বলাই

কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র ও এমএ হান্নানের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ২৭ মার্চ ২০১৮

কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র ও এমএ হান্নানের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ

এমএ হান্নানের জন্ম ১৯৩০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের তেহট্ট থানার খাসপুর গ্রামে। তাঁর পিতা মাওলানা মোহাম্মদ মুহিবুর রহমান ব্রিটিশ ভারতে কংগ্রেস ও পরে মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভারত বিভাগের পর মুহিবুর রহমান ১৯৪৮ সালে সপরিবারে মেহেরপুর জেলার আমঝুপিতে এসে বসতি স্থাপন করেন। এমএ হান্নান ১৯৪৯ সালে মেহেরপুরের দারিয়াপুর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫১ সালে কুষ্টিয়া কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ঢাকার জগন্নাথ কলেজে বিএ অধ্যয়নকালে তিনি ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। পরে তিনি চট্টগ্রামে সিটি কলেজে নৈশ বিভাগে ভর্তি হন। একই সঙ্গে তিনি চার্টার্ড ব্যাংকে চাকরি গ্রহণ করেন। পরে তিনি আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ব্যবস্থাপক হিসেবেও চাকরি করেন। এমএ হান্নান ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বিরোধী আন্দোলনে তিনি অংশ নেন। ১৯৬৮ সালে তিনি চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, ১৯৭০ সালে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে তিনি ২৪ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে ‘সোয়াত’ জাহাজ থেকে পাকিস্তানীদের অস্ত্র খালাসের বিরুদ্ধে ছাত্র শ্রমিক জনতাকে নিয়ে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণা কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রথম পাঠ করেন। পরে তিনি আগরতলা যান এবং সেখানে হরিনা যুব শিবির প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। এমএ হান্নান ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সম্মেলনে (আইএলও কনভেনশন) যোগ দেন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ রেল শ্রমিক লীগের সভাপতি, চট্টগ্রাম জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৪ সালের ১১ জুন চৌদ্দগ্রামে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন এবং পরদিন ফেনী হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। এমএ হান্নান, স্বাধীনতার ঘোষণা ও মহান স্বাধীনতা সম্পর্কে চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের চারবারের নির্বাচিত মেয়র, সদ্যপ্রয়াত আলহাজ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই নির্দেশনার পর থেকে চট্টগ্রামে এসে আমরা পুরোদমে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকি। আমি ও মৌলভী সৈয়দসহ অনেকেই সেদিন চট্টগ্রাম থেকে ছুটে গিয়েছিলাম রেসকোর্স ময়দানে। রেসকোর্সে সেদিন ছিল মানুষের উপচেপড়া ঢেউ। আমরা ছিলাম বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার অপেক্ষায়, আর পাকিস্তানী শাসক শক্তিও ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠায়। বঙ্গবন্ধুর সেই জ্বালাময়ী বক্তৃতায় আমাদের জন্য পথনির্দেশনা ছিল। চট্টগ্রামে ফিরে আমরা মাদারবাড়ি ও রাইফেল ক্লাব এলাকার অস্ত্র গুদাম থেকে বিপুল অস্ত্র বারুদ দখলে নেই। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কর্মীরাও জোট বাঁধেন। চট্টগ্রামে আমরা গঠন করি ‘জয়বাংলা’ বাহিনী। সে সময় অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য, পুলিশ আর তৎকালীন ইপিআর সদস্যদেরও সংগঠিত করতে মাইকিং করা হয়। তাদের স্টেশন রোডের রেস্ট হাউসে যোগাযোগ করতে অনুরোধও জানানো হয়। ব্যারাক ছেড়ে অনেকেই সেদিন রেস্ট হাউসে আসেন। আমরা তাদের আপ্যায়িত করলাম। এদিকে অগ্নিঝরা সেই মার্চের সতেরো থেকে পঁচিশের মধ্যে কিছু ঘটনা ঘটতে থাকে। দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে পরিস্থিতি। পাক সেনারাও অস্ত্র বোঝাই করে আনতে থাকে চট্টগ্রাম বন্দরে। ‘এমভি সোয়াত’ জাহাজ থেকে তারা অস্ত্র খালাসের চেষ্টা করলে জনতার বাধায় তা পণ্ড হয়। অপারেশন সার্চলাইট আর বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার পর ঢাকা বেতার পাকিস্তানী সেনাদের দখলে থাকলেও চট্টগ্রাম বেতারকে আমরা মুক্ত রাখতে পেরেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি ইপিআরের ওয়্যারলেসে চট্টগ্রামে পৌঁছে। সেই বার্তা পাঠানো হয় দামপাড়াস্থ জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসায়। খবর পেয়ে আমরা ছুটে যাই। তারপর সেই বার্তার কপি নূর আহমদ সড়কের ‘গেস্টেটনার’ নামের একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে সাইক্লোস্টাইল করা হয়। সেদিনই চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন জননেতা এম এ হান্নান। পরে এ ঘোষণাটি বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই কালুরঘাট কেন্দ্র থেকে পাঠ করেন মেজর জিয়াউর রহমান। ওই সময়টাতেই সশস্ত্র অবস্থায় একটি জিপ নিয়ে আমরা ওই রেস্ট হাউস থেকে জুবিলি রোডের নেভাল এভিনিউর মোড়ে গেলে পাকিস্তানি নৌকমান্ডো আমাদের ওপর আক্রমণ চালায় এবং সেখানে সংঘর্ষের পর একপর্যায়ে গ্রেফতার হই। কাজিরদেউড়ির আইল্যান্ডে দাঁড় করিয়ে গুলি করার ঘোষণা দিয়ে ওরা কলমাও পড়তে বলে আমাদের। এ সময় কয়েক শ’ বাঙালী ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকসেনাদের ওপর। আমাদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় কমোডর কমান্ডিংয়ের বাসভবনে। সেখানে চালানো হয় বর্বর নির্যাতন। আমরা তিনজন ‘ছাত্রনেতা’ হিসেবে শনাক্ত হলে আরও অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সিদ্ধান্ত হয়। কমোডর কমান্ডিংয়ের সে বাসভবন ঘেরাও করে ‘জয়বাংলা বাহিনী’। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের কাছে তারা টিকতে পারেননি। গ্রেফতার হওয়া আমিসহ অন্যদের সশস্ত্র পাহারায় টাইগারপাস নেভাল বেইসে স্থানান্তর করে সমানে চালানো হয় নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদ। নিয়ে যাওয়া হয় নৌবাহিনীর সাব-ক্যাম্পেও। নির্যাতন করে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় আমি ও গ্রেফতারকৃত সিদ্দিকুর রহমান, মোছলেম ও ইউনুছকে হত্যা করা হয়েছে বলে। আমাদের পরে নিয়ে যাওয়া হয় সিআরবি ক্যাম্পে। সেখানে ব্যাপক নির্যাতনের পরে তৃষ্ণায় কাতর হয়ে আমি পানি খেতে চাইলে আমাকে প্রথমে একটি বদনায় করে পানি খেতে দেয়ার জন্য মুখের কাছে পানি এনেও তা ফেলে দিয়ে জানোয়ার পাকসেনারা মুখে প্রস্রাব ঢেলে দেয়। নিউমুরিং নেভাল বেইসে নিয়েও নির্যাতন চালানো হয়। নখের নিচে সুই ঢুকিয়ে, শরীরে সিগারেটের ছেঁকা এবং হাতের আঙ্গুল ভেঙে উচ্ছিষ্ট খাবার খেতে দিয়ে নির্যাতন করা হয় অবর্ণনীয়ভাবে। পরে চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠিয়ে বন্দরে নিয়ে লেবারের কাজও করানো হয়। সে সময় দখলদার পাক সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম স্টেশন কমান্ডার বালুচ এক ক্যাপ্টেনের নির্দেশনা মতে কারাগার থেকে ‘পাগল জাতীয় লোকদের’ ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হলে পাগলের অভিনয় করে কারাগার থেকে বের হয়ে আসি। এর তিন-চার দিনের মাথায় ট্রেনিং নিতে ভারত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। ফটিকছড়ির রামগড় হয়ে আমরা প্রায় অর্ধশতজন ভারতের সাব্রুম দেরাদুন ক্যাম্পে গিয়ে দেখি আমার নামে ‘শহীদ মহিউদ্দিন ব্যারাক’ স্থাপিত হয়েছে। অর্থাৎ আগেই যে আমাকে মেরে ফেলার গুজব ছড়ানো হয়, তা থেকেই সবার ধারণা হয় যে আমি মৃত। কিন্তু জীবিত আমাকে পেয়ে সেদিন সবাই আনন্দে উল্লসিত হন। আগরতলা কুঞ্জবনস্থ এনপিসিসি রেস্ট হাউসে নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। সেখানে ছিলেন জহুর আহমদ চৌধুরী। তিনি (জহুর আহমদ চৌধুরী) যুদ্ধের শুরুতেই ভারত চলে যান। কিছু দিন পর আমিও আগরতলার শ্রীধর ভিলায় যাই। শেখ ফজলুল হক মণি আমাকে নিয়ে যান কলকাতায়। উত্তর প্রদেশের তান্ডুয়া সামরিক একাডেমিতে প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের ১৩তম স্কোয়াড কমান্ডার করা হয় আমাকে। এরপর আমি উচ্চতর গেরিলা লিডার্স প্রশিক্ষণে যোগ দিই। প্রশিক্ষণ নিয়ে শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে পূর্বাঞ্চলীয় মাউন্টেন্ট ডিভিশনের ‘প্লাটুন কমান্ডার’ হিসেবে লড়াইয়ে যোগ দেই পাকসেনা ও তাদের দোসর মিজো বাহিনীর বিরুদ্ধে। বিজয়ের দিনে সেই রেসকোর্সের আনন্দের ঢেউ চট্টগ্রামেও এসে দোল খায়। চট্টগ্রাম ১৭ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে হানাদারমুক্ত হয়। আঠারো ডিসেম্বর আমরা পাহাড়ের গহিন অরণ্য ছেড়ে চট্টগ্রাম ফিরি। যুদ্ধের পূর্বাপর সময়ে জহুর আহমদ চৌধুরী, এম এ আজিজ, এম এ মান্নানের নিবিড় সান্নিধ্য আমার জীবনে বিশেষ মাত্রা যোগ করে। আজ যখন দেখি, মুক্তিযুদ্ধের সব স্বপ্ন পূরণ হয়নি তখন বিষাদে মন ভরে উঠলেও হতাশ নই। কারণ নতুন প্রজন্ম নিশ্চয়ই একদিন ওইসব স্বপ্ন পূরণ করবে।’ মহান স্বাধীনতার ঘোষণা ও কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র ইতিহাসের সূত্রে এক ঐতিহাসিক স্থান। চট্টগ্রাম নগরীর পুরান চান্দগাঁও থানা সংলগ্ন এই স্থানটিকে মর্যাদা দিয়ে সংরক্ষণের মাধ্যমে জাতীয়ভাবে তার ইতিহাস তুলে ধরা গেলে স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা মর্যাদাসীন আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারবে। এই প্রজন্মের অনেকেই কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের ইতিহাস থেকে দূরে আছে। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে এমএ হান্নান ও কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের ঘটনাবহুল ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। লেখক : গবেষক
×