ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সংস্কৃতি সংবাদ

গণহত্যা দিবসে শিল্পের আলোয় উদ্ভাসিত কালরাত্রির বর্বরতা

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৬ মার্চ ২০১৮

গণহত্যা দিবসে শিল্পের আলোয় উদ্ভাসিত কালরাত্রির বর্বরতা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিশাল প্রান্তরে দৃশ্যমান ছোট ছোট কুড়েঘর। চারপাশে ক্ষতচিহ্ন। বসতবাড়ির সামনে লুটিয়ে আছে মরদেহ। চোখ ফেরাতেই উপস্থাপিত হয় আরও হৃদয়বিদারক দৃশ্য। মায়ের কাঁধের ওপর পাক হানাদারের বুটের লাথি। মানুষ নামের ওই পিশাচের এক হাতে ঝুলছে একটি শিশু সন্তান। হত্যা করা হবে নিষ্পাপ শিশুটিকে। স্থাপনাশিল্পের হৃদয়বিদারী সেসব দৃশ্য দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে নেমে আসে সন্ধ্যা। বিস্তৃত আঙিনার শিল্প-অবলোকনকারীদের হাতে জ্বলে ওঠে মোমের আলো। আলোকরশ্মির হলদে আভায় ভালবাসা জানানো হয় একাত্তরের পঁচিশে মার্চ কালরাত্রিতে নিহতদের। এভাবেই স্মরণ করা হয় সেদিনের গণহত্যার শহীদদের। রবিবার শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে ‘৭১-এর বর্বরতা’ শীর্ষক স্থাপনাশিল্পের শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় গণহত্যার স্বীকার শহীদদের। একাডেমির উন্মুক্ত আঙিনায় এ স্থাপনা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। সেই সঙ্গে ছিল আলোক প্রজ্বলন ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এছাড়াও এদিন আলোচনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শহীদদের স্মরণ করেছে বাংলা একাডেমি ও জাতীয় জাদুঘর। বসন্ত বিকেলে নাট্যদল প্রাচ্যনাট শহীদদের স্মরণে লাল যাত্রা শীর্ষক শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে। সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমি মাঠে একাত্তরের বর্বরতা শীর্ষক স্থাপনাশিল্প প্রদর্শনী, আলোক প্রজ্বলন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শিল্পী মিন্টু মিন্ট দের পরিকল্পনায় সজ্জিত শিল্পটির ভাবনায় ছিলেন লিয়াকত আলী লাকী। দুদিনের এ শিল্প প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী ও সংস্কৃতি সচিব মোঃ সাসির উদ্দিন আহমেদ। উদ্বোধনী বক্তব্যে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, একাত্তরের পঁচিশে মার্চ পাক হানাদারদের নিষ্ঠুরতার কোনো পরিমাপ হয় না। দেশের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় চক্ষু চিকিৎসক আলীম চৌধুরীর চোখ উপড়ে নিয়েছিল তারা। সেদিনের গণহত্যার ইতিহাস ছিল এমনই ভয়াবহ। এটা ছিল বাঙালী জাতির রক্তঋণের ইতিহাস। পাকিস্তানি শাসকরা যে এদেশের মানুষকে ঘৃণা করতোÑএই ইতিহাস নতুন প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরতে হবে। তাই ওই পিশাচ বাহিনী ও তাদের সহচর যুদ্ধাপরাধীদের কখনই ক্ষমা করা যাবে না। লিয়াকত আলী লাকী বলেন, জার্মানির নাৎসি বাহিনীর বর্বরতাকেও ছাপিয়ে গেছে একাত্তরে পাকবাহিনীর নৃশংসতা। শহীদজামায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, এদেশের স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আর মানুষ হত্যার সেই সূচনা হয়েছিল একাত্তরের পঁচিশে মার্চের কালরাত্রে। এদিনটিকে তাই গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। আলোচনা শেষে ছিল কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। রাকসানা আক্তার রূপসা গেয়ে শোনান ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’, ইয়াসমিন আলী ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, সোহান ‘ভেবো না গো মা তোমার ছেলেরা’, সূচিত্রা রানী সূত্রধর ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, সজীব ‘এই দেশ আমার কথা নাই ভাবুক’, মোমিন ‘যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে’ এবং ইবনে রাজনের কণ্ঠে গীত হয় ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’। সব শেষে ঢাকা সাংস্কৃতিক দলের শিল্পীরা সম্মেলক কণ্ঠে গেয়ে শোনায় ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’। কর্কশিটের আশ্রয়ে নিমিত হয়েছে ভাস্কর্যগুলো। সহজ কথায় শোলার। শোলা কেটে তাতে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে নানা অবয়ব। আর এই অবয়ব বেদনার, বর্বরতার। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ, মানবতাবিরোধী নানা অপকর্ম এসবে মূর্তমান। দীর্ঘ ৯ মাস হায়েনারা গণহত্যা চালায় শহর, গ্রাম, টিলা, নদী, ক্ষেত ও খামারে। বর্বরতা চালায় গোটা বাংলায়। স্থাপনা চিত্রে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে একাত্তরে হানাদারদের বর্বরতা। শিল্পবোধ আর একান্ত ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতার মিশেলে তৈরি হয়েছে যে শিল্প, তা আমাদের নিয়ে যাবে একাত্তরের বধ্যভূমিতে। নতুন প্রজন্মকে একাত্তরের ববর্রতা, নৃশংসতা, হত্যা-নির্যাতনের ভয়াবহতা এবং বাঙালীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস জানানোর জন্য ব্যক্তিগতভাবে এমন উদ্যোগ নিয়েছেন শিল্পী মিন্টু দে। তাঁর এই কর্মযজ্ঞে রয়েছে এক হাজার ৭১টি প্রতীকী লাশ, বেশকিছু ছোট ঘর, চারটি গণকবর, কাক, কুকুর, শকুন ইত্যাদি। গণহত্যা দিবসে বাংলা একাডেমির আলোচনা ॥ স্বাধীনতা উদ্যাপন এবং কালরাত্রির হত্যাযজ্ঞে শহীদ স্মরণে গণহত্যা দিবস বাংলা একাডেমি রবিবার বিকেলে আলোচনাসভার আয়োজন করে। একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে ‘২৫ মার্চের পাকিস্তানি গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক ড. মোঃ মশিউর রহমান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ড. নূহ-উল-আলম লেনিন ও ফিরোজ আহমেদ। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। প্রাচ্যনাটের লাল যাত্রা ॥ ১৯৭১ সালের কালরাত স্মরণে প্রতিবছরের মতো এ বছরও দেশের অন্যতম নাট্য সংগঠন প্রাচ্যনাট বের করে শোক শোভাযাত্রা ‘লাল যাত্রা’। বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বর (টিএসসি) থেকে একটি ইম্প্রোভাইজেশনের মাধ্যমে নাট্যদলের শিল্পী সবান্ধব হেঁটে যান ফুলার রোডের স্মৃতি চিরন্তন পর্যন্ত। এ সময় সম্মেলক কণ্ঠে গীত হয় ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’সহ দেশাত্মবোধক গান। স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে সকল শহীদের প্রতি সম্মানার্থে প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে শেষ হয় লাল যাত্রা। আয়োজনটির মূল ভাবনায় ছিলেন জলের গান ব্যান্ড ও প্রাচ্যনাটের শিল্পী রাহুল আনন্দের।
×