ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এইচএসসিতে প্রশ্নের সেট ঠিক হবে ২৫ মিনিট আগে লটারিতে

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২৬ মার্চ ২০১৮

এইচএসসিতে প্রশ্নের সেট ঠিক হবে ২৫ মিনিট  আগে লটারিতে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্কট কাটাতে আসন্ন এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরুর ২৫ মিনিট আগে লটারির মাধ্যমে প্রশ্নপত্রের সেট নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পরীক্ষার্থীদের ৩০ মিনিট আগেই কেন্দ্রে প্রবেশ বাধ্যতামূলক। প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে প্রশ্ন বিতরণ ব্যবস্থায় নানা পরিবর্তন আনার পর রবিবার সচিবালয়ে পরীক্ষা সংক্রান্ত আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে লটারির মাধ্যমে সেট নির্ধারণের ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সরকার কর্মকমিশন (পিএসসি) বিসিএসসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় লটারির মাধ্যমে প্রশ্ন সেট নির্ধারণ করে এলেও পাবলিক পরীক্ষায় এবারই প্রথম একই পদ্ধতি চালু হতে যাচ্ছে। এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রশ্ন ফাঁসের ছয়টি কারণ চিহ্নিত করে বলেছে, সুষ্ঠুভাবে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার সহযোগিতা প্রয়োজন। আগামী ২ এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাওয়া এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা নির্বিঘ্ন করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সভাপতিত্বে বসেছিল শৃঙ্খলা কমিটির বৈঠক। যেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মোঃ সোহরাব হোসাইন, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মোঃ আলমগীর ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা বোর্ডের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে সম্প্রতি সঙ্কট কাটাতে প্রশ্ন বিতরণ ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত হয়। রাজধানীসহ সারাদেশেই কমিয়ে আনা হয়েছে অভিযুক্ত ও অপ্রয়োজনীয় অর্ধ-শতাধিক পরীক্ষা কেন্দ্র। প্রশ্নপত্র ট্রেজারি থেকে কেন্দ্রে নিয়ে পরীক্ষা শুরু হওয়া পর্যন্ত একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা সমমর্যাদার কর্মকর্তা সঙ্গে থাকবেন জানিয়ে বলা হয়, ট্রেজারি থেকে কেন্দ্রে প্রশ্ন নেয়ার সময় ব্যবহার করা হবে বিশেষ ধরনের ব্যাগ। এরই ধারাবাহিকতায় রবিবার শিক্ষামন্ত্রী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। বৈঠক শেষে মন্ত্রণালয়ের নতুন সিদ্ধান্তের কথা সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মোঃ সোহরাব হোসাইন। তিনি বলেন, পরীক্ষার ২৫ মিনিট আগে সেট নির্ধারিত হবে। লটারির মাধ্যমে ঢাকা বোর্ড এই সেট নির্ধারণ করবে। এর আগে কোন কারণে প্যাকেট খোলার প্রমাণ পাওয়া গেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বছর অনুষ্ঠিতব্য এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা দিয়েই এই পদ্ধতি চালু হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি জানান, পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্রের সব সেট নিরাপত্তার মোড়কে কেন্দ্রে পাঠানো হবে। পরীক্ষার্থীরাও আধাঘণ্টা আগে কেন্দ্রে প্রবেশ করবেন। এরপর ঢাকায় লটারি করে কোন সেটে পরীক্ষা হবে, তা সবাইকে জানিয়ে দেয়া হবে। তবে কত সেট প্রশ্ন ছাপা হবে, তা জানাননি সচিব। এসএসসির মতো এইচএসসিতেও পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে পরীক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে পরীক্ষার হলে বসতে হবে বলে জানান তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, প্রশ্নফাঁস নিয়ে অন্যের অপরাধের জন্য বিনা কারণে বিনা অন্যায়ে মন্ত্রণালয়কে দোষারোপ করা হয়েছে, যা দুঃখজনক, অন্য কেউ পরীক্ষা নিলেও এর চেয়ে ভালভাবে পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হবে না। সাচিব দাবি করেন, সদ্যসমাপ্ত এসএসসি পরীক্ষায় যেসব প্রশ্নফাঁস হয়েছে তাতে খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গড়ে সাড়ে ৭ শতাংশ নম্বরের প্রশ্নফাঁস হয়েছে দাবি করে সোহরাব হোসাইন বলেন, ১৭ পরীক্ষার মধ্যে ১২টিতে প্রশ্নফাঁস হয়েছে, তবে তাও এমসিকিউ (নৈর্ব্যক্তিক) অংশ। রচনামূলক ৭০ নম্বর ফাঁস হয়নি। শিক্ষার্থীরা ৩০ মিনিট আগে প্রবেশ করলেও ৫ মিনিট পরে সেট নির্ধারণের ব্যাখ্যা দিয়ে সচিব বলেন, অতিরিক্ত সময় পেলে প্রশ্নফাঁস হওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে নতুন এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গৃহীত সিদ্ধান্তের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, এবার যে কোন মূল্যে বাংলাদেশের যে প্রান্তেই পরীক্ষার কেন্দ্র থাকুক, আধঘণ্টা আগে সেখানে প্রশ্ন পৌঁছে যাবে। এর আগে বা পরে নয়। এর আগে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এসএসসির প্রায় প্রতিটি পরীক্ষাতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। ফলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। সংসদে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিও ওঠে। আগামী ২ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে এবার তাই বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছে সরকার। ৬ কারণে প্রশ্নফাঁস! শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের একাধিক তদন্তে ইতোমধ্যেই বেশ কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তদন্তে প্রশ্ন ফাঁসের পেছনে অন্তত ছয়টি কারণ চিহ্নিত হয়েছে। যে কারণগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয় চিহ্নিত করেছে তার মধ্যে আছে- বিজি প্রেসে প্রশ্ন কম্পোজ এডিট, প্রিন্ট ও প্যাকেজিং পর্যায়ে ২৫০ জনের মতে কর্মী প্রশ্ন দেখতে পারে। তারা প্রশ্ন কপি করতে না পারলেও তার স্মৃতিতে ধারণ করা অসম্ভব ব্যাপার নয়। ৩/৪ জনের একটি পুরো গ্রুপের পক্ষে এভাবে প্রশ্নফাঁস করা সম্ভব হতে পারে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে ট্রেজারি বা নিরাপত্তা হেফাজত থেকে প্রশ্ন গ্রহণ করে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে অনেক কেন্দ্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না মর্মে অভিযোগ রয়েছে। অতিরিক্ত কেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে, যার ব্যবস্থাপনা করার মতো পর্যাপ্ত জনবল নেই। তাছাড়া ভেন্যুগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মূল কেন্দ্র থেকে দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত। ফলে ৩০ মিনিট সময়ের অধিক পূর্বে কেন্দ্র সচিবরা প্রশ্ন খুলতে বাধ্য হচ্ছেন। এর পরের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, পরীক্ষার্থী কিংবা পরীক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্তদের স্মার্টফোন নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর হয়ে পড়ছে। গুটিকয়েক শিক্ষক-কর্মচারীর কারণে গোটা প্রশ্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্নফাঁসকারীদের চিহ্নিত করতে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তৎপরতা আরও বৃদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে। এটা পরীক্ষা শুরুর কমপক্ষে ১৫ দিন পূর্ব হতে করা সম্ভব হলে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে। গোয়েন্দা সংস্থার লোকবল, অবকাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত স্বল্পতার কারণে কাক্সিক্ষত মাত্রায় নজরদারি করা সম্ভব হচ্ছে না মর্মে প্রতীয়মান হয়। দুষ্কৃতকারীদের তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার ও শাস্তি দিতে না পারায় অন্যরাও অপরাধ করতে ভয় পাচ্ছে না। এরপরের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বিটিআরসি কর্তৃক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন আপলোডকারীদের চিহ্নিত করতে দেখা যাচ্ছে না এবং সন্দেহজনক এ্যাকাউন্ট বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। গত বছর ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ পাওয়ার পর এ বছর ‘অধিক সতর্কতা’ অবলম্বন করেও সফল হওয়া যায়নি বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সভার কার্যপত্রে তাই স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ডাকঘর ও রেলপথে প্রশ্নপত্র পৌঁছানোসহ বিভিন্ন কাজে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ সংস্থা জড়িত। ফলে সুষ্ঠুভাবে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠানে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সস্থার সহযোগিতা প্রয়োজন।
×