ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঘরে বাইরে দ্বিগুণ কাজ করে নারী

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২৬ মার্চ ২০১৮

ঘরে বাইরে দ্বিগুণ কাজ  করে নারী

আনোয়ার রোজেন ॥ শারমিন আক্তার (ছদ্মনাম)। চাকরি করেন রাজধানীভিত্তিক একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে। থাকেন মিরপুরে। অফিস পল্টনে। ভোরে ঘুম থেকে ওঠে পরিবারের সবার রুচিমতো নাস্তা তৈরি করে তবেই রওনা হন অফিসের পথে। আবার অফিস শেষ করে বাজার করে ঘরে ফেরা। ঘরে ফিরে আবার ঘরের কাজ, রান্নাবান্না। ঠিক কতটা কাজ করতে হয় শারমিনকে? ‘গৃহকর্মী রাখার সামর্থ্য নেই। বাসার রান্না আমি নিজেই করি। সেই সঙ্গে অফিস করা, কাপড় ধোয়া, বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করাসহ বিভিন্ন কাজ আমাকেই করতে হয়।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন শারমিন। প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠেন ভোরে। আর ঘুমাতে যাওয়ার সুযোগ মেলে রাত বারোটার পর। স্বামী কী করেন? ‘চাকরি করেন গুলশানের একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে। সকালে বের হলে অফিস শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ন’টা-দশটা বেজে যায়। বেশি বাজারের প্রয়োজন হলে ছুটির দিনে তিনি সেটা করেন।’ অর্থাৎ সপ্তাহে এক বার! স্বামী কখনই রান্নাঘর মুখো হন না। শরীর খারাপ থাকলেও রান্নার কাজ করতে হয় শারমিনকেই। আর সংসারের টুকিটাকি কাজ তো আছেই। বেশিরভাগ পুরুষ ভাবেন রান্না করা তো সহজ কাজ। এ আর এমন কী পরিশ্রমের? বেশির ভাগ পুরুষ অফিস শেষ করে বাসায় এসে হাতে রিমোট কন্ট্রোল তুলে নেন, একই সময়ে কর্মজীবী সংসারী নারীর হাত ব্যস্ত থাকে হাঁড়ি-পাতিলে। এটি কি কেবলই ধারণা? মোটেও না, প্রচলিত এই ধারণা যে সত্য সেটা উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপেও। জরিপ অনুযায়ী কর্মজীবী পুরুষের তুলনায় কর্মজীবী নারী কাজ করেন তিন গুণ। তবে কর্মজীবী নারীর গৃহস্থালির কর্মকা-ের আর্থিক মূল্যায়ন করা হয় না, এর গুরুত্ব দৃশ্যমান হয় না। সম্প্রতি বিবিএস পরিচালিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের শ্রমশক্তি জরিপে কর্মজীবী নারীর ঘরের কাজকে ‘ডাবল বারডেন’ (দ্বিগুণ বোঝা) বলা হয়েছে। ঘরের কাজ কে কতটুকু করে ॥ জরিপ অনুযায়ী, পুরুষ ও নারী উভয়েই কর্মজীবী এমন পারিবারিক পরিবেশে শতকরা ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই রান্নার কাজটি করতে হয় ওই নারীকেই। আর কর্মজীবী পুরুষের রান্না করতে হয় মাত্র আড়াই শতাংশ ক্ষেত্রে। কর্মজীবী ১০০ নারীর মধ্যে ৮৯ জনই কাপড় ধোয়ার কাজ নিজেই করেন। আর ১০০ কর্মজীবী পুরুষের ক্ষেত্রে এই কাজ করেন মাত্র ১২। অন্য পুরুষদের কাপড় ধোয়ার এই কাজ করেন গৃহকর্মী ( বেশিরভাগ নারী), পরিবারের অন্য নারী সদস্য অথবা লন্ড্রি। কর্মজীবী নারীদের ৮৮ শতাংশ ঘর পরিষ্কারসহ বাসার বিভিন্ন জিনিস সাফ সুতরো রাখার কাজ করে থাকেন। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ৭ শতাংশ। ঘরের কেনাকাটার (শপিং) ক্ষেত্রে অবশ্য কর্মজীবী পুরুষের অংশগ্রহণ বেশি। কর্মজীবী পুরুষদের ৭৭ শতাংশই ঘরের কেনাকাটার কাজটি করে থাকেন। অন্যদিকে ২৬ শতাংশ কর্মজীবী নারী চাকরির পাশাপাশি সংসারের জন্য কেনাকাটার কাজটিও নিয়মিত করে থাকেন। পরিবারের শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ সদস্যদের দেখভালের দায়িত্বও বেশির ভাগ কর্মজীবী নারীকে সামলাতেও হয়। ৫৩ শতাংশ কর্মজীবী নারী নিয়মিত এ কাজ করেন। বিপরীতে পরিবারের এসব সদস্যদের যতœ নেয়ার কাজটি করে থাকেন ২১ শতাংশ কর্মজীবী পুরুষ। এসব নির্দিষ্ট কাজের বাইরেও সংসারের টুকিটাকি অন্য কাজে কর্মজীবী নারীর অংশগ্রহণ (৫০ শতাংশ) কর্মজীবী পুরুষের তুলনায় বেশি। এই জরিপ অনুযায়ী কর্মজীবী নারীরা পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ পাচ্ছেন না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো নাজনীন আহমেদ বলেন, পরিবারের জন্য এই ধরনের কাজ করে কেউ কোন বেতন বা পারিশ্রমিক পান না। অর্থনীতির ভাষায় এটাকে ‘আনপেইড ফ্যামিলি ওয়ার্ক’ বলে। আর এই কাজগুলো নারীরাই বেশি করেন। শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে কিন্তু ঘরের কাজ বাদ দিয়ে নয়। অর্থাৎ একই সঙ্গে তারা ঘরের কাজও করছে। ফলে তারা পর্যাপ্ত বিশ্রাম বা অবসর পাচ্ছে না। এতে কর্মজীবী নারীদের মানসিক চাপ বাড়ার আশঙ্কা থাকছে। তিনি বলেন, নারীরা বাইরেও কাজ করছে আবার সংসারের কাজও করছে। অনেক পরিবার আছে নারীকে শর্তই দেয় যে, ঘরের কাজ সামলে যদি চাকরি করতে পার তাহলে করো। নাজনীন আহমেদ বলেন, যিনি বেশি বেতনে চাকরি করেন তিনি হয়ত ঘরের কাজে সহায়তা করার জন্য লোক রাখতে পারেন। কিন্তু কম পারিশ্রমিক পাওয়া চাকরিজীবী নারীদের সমস্যা হয় বেশি। তারা ঘরে বাইরে কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই গবেষক মনে করেন, নারীর শ্রমবাজারে আসা মানেই ঘর ঠিক রেখে আসা- এটা যেন না হয়। ঘরের কাজ নারী-পুরুষ সবাইকে মিলেমিশে করার মানসিকতা তৈরির করতে হবে। জরিপের অন্য একটি তথ্যে অবশ্য আশাব্যঞ্জক চিত্র ফুটে ওঠে। সেটি হলো- আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজারের পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ দ্রুতগতিতে বাড়ছে। জরিপ মতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশের শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত নারীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। এর আগের অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৯১ লাখ। অর্থাৎ এক অর্থবছরে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বেড়েছে নয় লাখ। অন্যদিকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশের শ্রমশক্তির মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৩৫ লাখ। আগের অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৩১ লাখ। অর্থাৎ এক বছরে শ্রমশক্তিতে পুরুষের অংশগ্রহণ বেড়েছে মাত্র চার লাখ। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, জরিপে নারীর সত্যিকার ক্ষমতায়নের চিত্র উঠে এসেছে। শ্রমশক্তিতে পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়ছে। এটা গর্ব করার মতো বিষয়। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার বিভিন্ন কর্মসূচী ও প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর ফলই আমরা এখন পাচ্ছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ ১০ উদ্যোগের মধ্যে একটি হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন কার্যক্রম। এছাড়া অন্য সব উদ্যোগেও নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য সরকারীভাবে নীতিমালা ও উৎসাহিত করা হচ্ছে। জানতে চাইলে শ্রম জরিপ প্রকল্পের পরিচালক কবির উদ্দিন আহমদ বলেন, জরিপে আমরা দেখেছি ‘আনপেইড ফ্যামিলি ওয়ার্কার’, যারা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন, তাদের সংখ্যা কমে আসছে এবং অধিক হারে নারীরা ‘আনপেইড’ থেকে ‘পেইড এমপ্লয়মেন্টে’ আসছেন। অর্থাৎ অর্থ উপার্জনমূলক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। জরিপের তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত এক বছরে আনপেইড ফ্যামিলি ওয়ার্কারের সংখ্যা ১৪ লাখ কমে ৮৬ লাখ হতে ৭২ লাখে পৌঁছেছে। অর্থাৎ ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ কমেছে। এক্ষেত্রে পুরুষদের ক্ষেত্রে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ কমলেও নারীদের ক্ষেত্রে কমেছে প্রায় ১৯ শতাংশ, যাদের অধিকাংশ আনপেইড থেকে পেইড এমপ্লয়মেন্টে এসেছেন।
×