ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ২৬ মার্চ ২০১৮

‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’

১৯৭১-এর ছাব্বিশে মার্চ ছিল শুক্রবার। পঁচিশে মার্চ বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর মণি ভাই রওনা দেই সেগুনবাগিচার দিকে। রোকেয়া হলের সামনে দিয়ে যখন যাই তখন সংগ্রামী জনতা রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছে। সেগুন বাগিচায় একটা প্রেসে স্বাধীনতার ঘোষণা সংবলিত লিফলেট ছিল। সেই লিফলেট নিয়ে যাব ফকিরাপুলে মণি ভাইয়ের বাসায়। প্রেস পর্যন্ত গেলাম, লিফলেট নিলাম। রাস্তায় ব্যারিকেড থাকার কারণে গাড়ি রেখে অগত্যা হেঁটেই রওনা দিলাম। রাত ১২টায় মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পূর্ব পরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুযায়ী শুরু করেছে ইতিহাসের পৈশাচিকতম হত্যাকান্ড, বাঙালী নিধনে গণহত্যা। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত বাঙালীর জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের লড়াইকে সশস্ত্রপন্থায় নিশ্চিহ্ন করতেই এই হীন চক্রান্ত। চারদিকে প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দ ছাপিয়ে তখন আমার কানে কেবলই বাজছে বিদায় বেলায় বঙ্গবন্ধুর সেই নির্দেশ, ‘তোমাদের যে দায়িত্ব আমি দিয়েছি সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন কর। আমার জন্য ভেব না। আমি যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি আমার স্বপ্নের সেই বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই হবে। ওরা অত্যাচার করবে, নির্যাতন করবে। কিন্তু আমার বাংলাদেশের মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’ বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী বাংলার মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। মাত্র নয় মাসের মধ্যে ৩০ লক্ষাধিক প্রাণ আর ৪ লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করি প্রিয় মাতৃভূমির সুমহান স্বাধীনতা। মার্চের ২৬ তারিখ প্রথম প্রহরেই সারাদেশসহ ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কার্ফু জারি করা হয়। এ অবস্থার মধ্যে রাতেই খবর পেলাম বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ইয়াহিয়া খান তার ভাষণে সারাদেশে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘সপ্তাহখানেক আগেই আমার উচিত ছিল শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা...। ...কেননা কয়েকটি শর্ত দিয়ে সে আমাকে ট্র্যাপে ফেলতে চেয়েছিল। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সে আক্রমণ করেছে- এই অপরাধ বিনা শাস্তিতে যেতে দেয়া হবে না।’ ২৭ মার্চ যখন ২ ঘণ্টার জন্য কার্ফু প্রত্যাহার করা হয় তখন আমি আর মণি ভাই জহিরুল ইসলামের বাসায় যাই। সেখান থেকে আমাদের ব্যাগ নিয়ে এ ইউ আহমেদের একটা ভক্সওয়াগন গাড়িতে চেপে গুলিস্তান দিয়ে নবাবপুর রোড ধরে সদরঘাট গিয়ে কেরানীগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা করি। পেছনে পড়ে থাকে ধ্বংস আর মৃত্যু উপত্যকাসম রক্তাক্ত ঢাকা নগরী। যাওয়ার সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে দফায় দফায় প্রচারিত এমএ হান্নানের ভাষণ শুনলাম, ‘কে বলে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে? তিনি আমাদের মধ্যেই আছেন।’ এরপর কেরানীগঞ্জে বোরহানউদ্দীন গগনের বাড়িতে আমরা আশ্রয় নেই। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান, মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই, আমি, আ স ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজসহ অনেকেই তখন সেই বাড়িতে। সকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে হান্নান এবং আমাদের অন্য নেতারা বিরামহীনভাবে ঘোষণা দিতে থাকেন যে, ‘বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে প্রিয় মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে আমাদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন।’ এরপর সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়। টানা ২৪ দিন ধরে চলা সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন আর বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে অবশেষে গণহত্যার দিকে এগিয়ে যায় পাকিস্তানী সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়া এবং চক্রান্তকারী পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুুট্টো। ২৫ মার্চ জিরো আওয়ারে গণহত্যা শুরুর পরপরই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন!’ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুযায়ী রাত ১২টায় পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকার চারটি স্থানকে টার্গেট করে-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, তৎকালীন ইপিআর সদর দফতর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স এবং ধানমন্ডি ৩২নং স্থিত বঙ্গবন্ধুর বাসভবন। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী গণহত্যাযজ্ঞ শুরু করে অখন্ড পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়। স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক বাহিনীর প্রধান লে. জেনারেল নিয়াজীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারী তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে ক্ষীণস্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ওই কণ্ঠের বাণী মনে হলো পূর্বেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।’ স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে তিনি আরও লিখেছেন, ঘোষণায় বলা হয়, ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’ বিগত ২৪ বছরের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম আর ’৭১-এর ২ মার্চে শুরু হওয়া ২৪ দিনের নিয়মতান্ত্রিক অসহযোগ আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে বঙ্গবন্ধুকে কোনরূপ আপোস-মীমাংসায় আনতে অক্ষম হয়ে অবশেষে ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী চরম নিষ্ঠুরতায় বাঙালী হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। নির্মম এ হত্যাকান্ড শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই সংখ্যাগরিষ্ঠের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত শেষ বার্তায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য এরকম একটি চূড়ান্ত ঘোষণা দেয়ার উত্তুঙ্গ অবস্থায় পৌঁছতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দীর্ঘ ২৪টি বছর নিজেকে, দলকে এবং বাঙালী জাতিকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচীর ভিত্তিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে লক্ষ্য স্থির করে, ধাপে ধাপে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা করে, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে শাসকগোষ্ঠীর সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, জেল-জুলুম-হুলিয়া, ফাঁসির মঞ্চকে উপেক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়েছে। একদিনে হয়নি। বহু বছর ধরে, অগণিত মানুষের আত্মদানের মধ্য দিয়ে সমগ্র বাঙালী জাতি প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাকে শিরোধার্য জ্ঞান করেছে। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত এই ঘোষণাটিই ’৭১-এর এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ কর্তৃক গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ৬নং প্যারায় অনুমোদিত হয়ে সাংবিধানিক বৈধতা অর্জন করেছে। স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পরিস্থিতির শুরুটা হয়েছিল মূলত ৬ দফা দেয়ার মধ্য দিয়েই। ৬ দফাই ছিল স্বাধীনতার বীজমন্ত্র। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলতেন, ‘সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।’ পাকিস্তানীরা গণহত্যা চালানোর আগ পর্যন্ত কোন রকম উগ্রতাকে অতি বিপ্লবীপনাকে আমরা প্রশ্রয় দেইনি। নিয়মতন্ত্রের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম পরিচালনা করেছেন। বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগে আমাদের কখনই অভিযুক্ত করা যায়নি, আমরা আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ন্যায্যতা প্রমাণ করে মুক্তি সংগ্রামী হিসেবেই এগিয়ে গেছি। নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যেই বঙ্গবন্ধু ’৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭০-এর ৩০ মার্চে রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-২ অনুযায়ী লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক অর্ডার বা সংক্ষেপে এলএফও জারি করেন। সর্বমোট ৪৮টি অনুচ্ছেদ সংবলিত এই এলএফওতে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব মেনে নেয়া হয়। জাতীয় পরিষদে ৩১৩টি আসনের মধ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে আমরা পেলাম ১৬৯টি। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ভবিষ্যতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও যাতে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে না পারেন সে জন্য এলএফওতে বিতর্কিত ২৫ ও ২৭ নং দুটি অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত করেন। ২৫ নং অনুচ্ছেদের শিরোনাম ছিল ‘শাসনতন্ত্রের প্রমাণীকরণ’। যাতে বলা হয়েছিল, ‘জাতীয় পরিষদে গৃহীত শাসনতন্ত্র বিল, প্রমাণীকরণের জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে উপস্থাপিত হবে। এ পর্বে প্রমাণীকরণে প্রত্যাখ্যাত হলে জাতীয় পরিষদের অবস্থান লুপ্ত হবে।’ আর ২৭ নং অনুচ্ছেদের শিরোনাম ছিল ‘আদেশের সংশোধন এবং ব্যাখ্যা, ইত্যাদি’, এর ক ধারায় ছিল ‘এই আদেশের কোন আইনের ধারা সম্পর্কে কোন ধারণা, কোন ব্যাখ্যা বা কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হলে সে সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে এবং এ ব্যাপারে কোন আদালতে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।’ এবং একই অনুচ্ছেদের খ ধারায় ছিল ‘জাতীয় পরিষদ নয় বরং রাষ্ট্রপতিই এই আদেশের সংশোধনের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী।’ এলএফওতে সন্নিবেশিত দুটি ধারাই ছিল আসন্ন নির্বাচনে বিজয়ী দলকে ঠেকানোর অপপ্রয়াস। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য আওয়ামী লীগকে প্রস্তুত করছিলেন। এর অংশ হিসেবে ’৭১-এর ১৬ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে যথাক্রমে বঙ্গবন্ধু ও মনসুর আলী নেতা নির্বাচিত হন। জাতীয় পরিষদের উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং এএইচএম কামারুজ্জামান সচিব নির্বাচিত হন। এ ছাড়াও সর্বজনাব ইউসুফ আলী, আব্দুল মান্নান ও আমীর-উল ইসলাম যথাক্রমে চীফ হুইপ ও অপর দু’জন হুইপ নির্বাচিত হন। এরপর আসে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। ’৭১-এর শহীদ দিবস ছিল সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এ দিনটিতে মধ্যরাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মশালের আগুনে উদ্দীপ্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই বাংলার স্বাধিকার-বাংলার ন্যায্য দাবিকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র চলছে। এখনও চলছে, ভবিষ্যতেও চলবে। কিন্তু বাংলার সাত কোটি মানুষ আর বঞ্চিত হতে রাজি নয়। আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজন হলে আরও রক্ত দেব। আর শহীদ নয়, এবার গাজী হয়ে ঘরে ফিরব। বাংলার ঘরে ঘরে আজ দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে হবে আমাদের সংগ্রাম। মানুষ জন্ম নেয় মৃত্যুর জন্য; আমি আপনাদের কাছে বলছি এই বাংলার মানুষ রক্ত দিয়ে আমাকে আগরতলা মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছে, আমিও আপনাদের জন্য নিজের রক্ত দিতে দ্বিধা করব না। বাংলার সম্পদ আর লুট হতে দেব না।’ ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেন এবং পিন্ডিতে গবর্নর ও সামরিক প্রশাসকদের নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে লারকানা ও রাওয়ালপিন্ডি বৈঠকের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করা হয়। সামরিক শাসকচক্রের সঙ্গে মিলে ভুট্টো যে ভূমিকায় লিপ্ত তাতে এটা স্পষ্ট যে, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কোনভাবেই বাঙালীদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। উপরোক্ত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘...গত সপ্তাহে জাতি যে ধরনের নাট্যাভিনয় প্রত্যক্ষ করেছে, তা বন্ধ হওয়া দরকার। জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বানচালের উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করা হচ্ছে। ...পাকিস্তানে যখনই জনসাধারণ গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা গ্রহণে উদ্যত হয়েছে তখনই এই তামস শক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই গণবিরোধী শক্তি ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার নির্বাচিত শক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করে, ১৯৬৬ সালের আইন পরিষদ ভেঙ্গে দেয়, ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক আইন জারি করে এবং তারপর প্রতিটি গণআন্দোলন ব্যর্থ করার জন্য হস্তক্ষেপ করে। এই ষড়যন্ত্রকারী শক্তি যে আবার আঘাত হানার জন্য তৈরি হচ্ছে, জাতীয় পরিষদের তারিখ ঘোষণার পর যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলো থেকেই এটা প্রতীয়মান হয়। জনাব জেড এ ভুট্টো ও পিপল্স পার্টি আকস্মিকভাবে এমন সব ভঙ্গিমা ও উক্তি করতে শুরু করেছে যা জাতীয় পরিষদের স্বাভাবিক কাজে বাধা সৃষ্টি করে শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতি বানচালের প্রবণতাই উদ্ঘাটন করে। এভাবে জনসাধারণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বানচালেরও চেষ্টা করা হচ্ছে। ...বাংলাদেশের জাগ্রত জনতাকে, কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র ও জনগণকে বিজয় বানচালের ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। ...আমরা যে ক্ষমতাকে স্বীকার করি, তা হচ্ছে জনগণের ক্ষমতা। জনগণ সকল স্বৈরাচারীকেই নতি স্বীকারে বাধ্য করেছে। কারণ, স্বৈরাচারীর ক্ষমতার দম্ভ জাগ্রত জনগণের সঙ্কল্পবদ্ধ আঘাতের কাছে টিকে থাকতে পারেনি। ...আমরা আজ প্রয়োজন হলে আমাদের জীবন বিসর্জন করারও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি- যাতে আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের একটি কলোনিতে বাস করতে না হয়। যাতে তারা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে সম্মানের সঙ্গে মুক্ত জীবনযাপন করতে পারে, সে প্রচেষ্টাই আমরা চালাব।’ এই দীর্ঘ ও তাৎপর্যপূর্ণ বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু ষড়যন্ত্রকারীদের নাটুকেপনা বন্ধ করা এবং ভবিষ্যত বংশধরদের যাতে একটি কলোনিতে তথা উপনিবেশে বসবাস করতে না হয় তার অংশ হিসেবে স্বাধীন দেশের কথা বলছেন। ’৭১-এর মার্চের ১ তারিখে দুপুর ১টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চ তারিখে ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার মধ্য দিয়ে ভুট্টো এবং জেনারেলদের মধ্যকার ঐকমত্য জনসাধারণ্যে প্রকাশিত হলো। এ রকম একটি ষড়যন্ত্র হতে পারে এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু পূর্বেই আমাদের ধারণা দিয়েছিলেন এবং তাঁর অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার করে জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের এহেন বক্তব্যে তাৎক্ষণিক ক্ষোভ-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা নগরী। এদিন হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় ৬ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছিল। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ মানুষ হোটেল পূর্বাণীর সামনে এসে সমবেত হয়ে স্লেøাগানে স্লেøাগানে চারদিক প্রকম্পিত করে তোলে। বঙ্গবন্ধু হোটেলের সামনে এসে সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘অধিবেশন বন্ধ করার ঘোষণায় সারাদেশের জনগণ ক্ষুব্ধ। আমি মর্মাহত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। আমি সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছি। সংগ্রাম করেই মুক্তি আনব। আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকুন।’ বিকেল ৩টায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে প্রতিবাদ সভা হবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পল্টন ময়দানের স্বতঃস্ফূর্ত জনসভায় যোগদান করি। পল্টন ময়দান তখন জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। সেখানে বক্তৃতায় বলি, ‘আর ৬ দফা ও ১১ দফা নয়। এবার বাংলার মানুষ ১ দফার সংগ্রাম শুরু করবে। আর এই ১ দফা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আজ আমরাও শপথ নিলাম-বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ সুশৃঙ্খল সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’ প্রতিবাদ সভায় আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ও নির্দেশ মতো আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাই। এক মাস আগে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত এমএনএ এএইচএম কামারুজ্জামান বলেছিলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা যদি ৬ দফা ও ১১ দফাকে পাশ কাটাতে চেষ্টা করেন, তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দেয়া হবে।’ ’৭০-এর নির্বাচন না হলে, নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে কিছুই হতো না, কিছুই সম্ভব ছিল না। বঙ্গবন্ধু মুজিব নির্বাচনে অংশগ্রহণের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি জানতেন বাংলার মানুষ ৬ দফা ও ১১ দফার পক্ষে। নির্যাতিত বাঙালীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর আস্থা ছিল গগনচুম্বী। আর তাই তিনি জনগণের কাছে আহ্বান রেখেছিলেন এই নির্বাচনকে রেফারেন্ডামে পরিণত করতে। বাঙালীর ইতিহাসের পরমাকাক্সিক্ষত দিন সাতই মার্চ। সেদিন ছিল রবিবার। বাংলাদেশের সার্বিক মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে দুর্গম প্রস্তর পথের প্রান্তে অতুলনীয় স্মৃতিফলক এই দিনটি। সংগ্রামী বাংলা সেদিন ছিল অগ্নিগর্ভ, দুর্বিনীত। কারও চাপিয়ে দেয়া অন্যায় প্রভুত্ব মেনে নেয়ার জন্য, কারও কলোনি বা করদ রাজ্য হিসেবে থাকার জন্য বাংলার মানুষের জন্ম হয়নি। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিকামী মানুষের ঢল নেমেছিল সার্বিক জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের পরবর্তী কর্মসূচী সম্পর্কে পথ-নির্দেশ লাভের জন্য। আমরা যারা সেদিনের সেই জনসভার সংগঠক ছিলাম, যারা আমরা মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর পদতলের পাশে বসে ময়দানে উপস্থিত পুরনারী, অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কচি-কিশোর, তরুণ-যুবক, কৃষক-শ্রমিক জনতার চোখে-মুখে প্রতিবাদের-প্রতিরোধের যে অগ্নিশিখা দেখেছি তা আজও স্মৃতিপটে ভাস্বর হয়ে আছে। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির ওপর কালো মুজিব কোট পরিহিত বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন, বাংলার বীর জনতা বজ্রনির্ঘোষে তুমুল করতালি ও স্লোগানের মধ্যে তাঁকে বীরোচিত অভিনন্দন জ্ঞাপন করে। তাঁর চোখে-মুখে তখন সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী মানুষের সুযোগ্য সর্বাধিনায়কের দুর্লভ তেজোদৃপ্ত কাঠিন্য আর সংগ্রামী শপথের দীপ্তির মিথস্ক্রিয়ায় জ্যোতির্ময় অভিব্যক্তি খেলা করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু যখন বক্তৃতা শুরু করলেন জনসমুদ্র যেন প্রশান্ত এক গাম্ভীর্য নিয়ে পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে ডুবে গেল। এত কোলাহল, এত মুহুর্মুহু গর্জন নিমেষেই উধাও। আবার পরক্ষণেই সেই জনতাই সংগ্রামী শপথ ঘোষণায় উচ্চকিত হয়েছে মহাপ্রলয়ের উত্তাল জলধির মতো, যেন জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার। সেদিনের সেই গণমহাসমুদ্রে আগত মানুষের বয়স, পেশা, সামাজিক মর্যাদা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও শ্রেণীগত অবস্থানের যতই ফারাক থাকুক না কেন, সে জনতার মধ্যে আশ্চর্য যে ঐকতান ছিল তা হচ্ছে- হাতে বাঁশের লাঠি, কণ্ঠের স্লোগান আর অন্তরের অন্তরতম কোণে লালিত জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা। সাতই মার্চের রেসকোর্স বাংলার মানুষকে শুনিয়েছে স্বাধীনতার অমোঘমন্ত্র। সর্বাত্মক মুক্তি সংগ্রামের অগ্নি শপথে ভাস্বর, যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত সভাস্থলের প্রতিটি নিরস্ত্র মানুষ যেন সেদিন সশস্ত্র হয়ে ওঠে; তাদের চোখ-মুখ শত্রুর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আত্মত্যাগের অপার মহিমায় আলোকিত হয়। নেতার বক্তৃতার শেষাংশ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বস্তুত এটাই ছিল বীর বাঙালীর জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা। আজ সেই ঐতিহাসিক ভাষণ জাতিসংঘের ইউনেস্কো ঘোষিত ‘বিশ^ ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল’ হিসেবে বিশ^সভায় স্বীকৃত। দেশকে স্বাধীন করে জাতির পিতা তাঁর জীবনের প্রথম লক্ষ্য পূরণ করেছেন। কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় লক্ষ্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন, যা তিনি সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। সেই লক্ষ্য পূরণ হতে চলেছে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। ১৯৯৬-এ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশকে তিনি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ২০০৯-এ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে আজ আন্তর্জাতিক বিশে^ বাংলাদেশকে তিনি উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছেন। যে বাংলাদেশকে নিয়ে একদিন হেনরী কিসিঞ্জারসহ পৃথিবীর অনেক অর্থনীতিবিদ হাস্যাস্পদ মন্তব্য করে বলেছিল, ‘বাংলাদেশ হবে তলাবিহীন ঝুড়ি, বাংলাদেশ হবে দরিদ্র দেশের মডেল।’ আজ তাদের সেই বক্তব্য ভুল প্রমাণিত হয়েছে। যে বাংলাদেশ ’৭৫-এ ছিল স্বল্পোন্নত, আজ প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছি। ইতোমধ্যে জাতিসংঘ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমরা যে প্রথম ধাপ অতিক্রম করেছি তার স্বীকৃতির সনদপত্র দিয়েছে। সুতরাং এই বছরে স্বাধীনতা দিবসের আনন্দঘন ক্ষণে গভীরভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে মনে পড়ে। তাঁর সেই স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ক্ষুধামুক্ত-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হয়ে তাঁরই পরমারাধ্য স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে চলেছে। লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
×