ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শংকর লাল দাশ

আসছে বৈশাখ ব্যস্ত অর্থনীতি

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২৫ মার্চ ২০১৮

আসছে বৈশাখ ব্যস্ত অর্থনীতি

পহেলা বৈশাখ, এখন কেবলমাত্র বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন কিংবা শুধুমাত্র উৎসব-আনন্দে মোড়া একটি দিবস নয়। এর তাৎপর্য এখন বহুমুখী। সমাজ ও রাষ্ট্রে দিনটির প্রভাব বেড়েই চলছে। বিশেষ করে জাতীয় অর্থনীতিতে দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অর্থ প্রবাহের দিক থেকে ধর্মীয় সবচেয়ে বড় উৎসব রমজানের ঈদের পরেই বাংলা নববর্ষের অবস্থান। দিনটির সাথে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে জড়িত মানুষের সংখ্যাও অনেক বেশি। তাইতো, নববর্ষের এ দিনটি বাংলাদেশে জাতীয় উৎসবের স্থান দখল করে নিয়েছে। নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে উৎসবে-আনন্দে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটিকে উদযাপনের রেওয়াজ বাংলাদেশে বহু আগ থেকে চলে আসছে। বাঙালী জাতিসত্তার বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামেও দিনটির অবদান স্মরণীয়। আর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর শেকড় অনেক গভীরে। যেদিন থেকে পহেলা বৈশাখে হালখাতার প্রচলন শুরু হয়েছে, সেদিন থেকে বাঙালীর অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। আর এখনতো অর্থনীতির অনেকটাই জুড়ে আছে পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখের অর্থপ্রবাহ নিয়ে দেশে এ যাবত কোন ধরনের গবেষণা হয়নি। ফলে এ দিনটি ঘিরে কি পরিমাণ অর্থ লেনদেন হয়, এর প্রকৃত হিসেব বের করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। তবে অর্থ লেনদেনের সবচেয়ে বড় খাতটির অন্যতম হচ্ছে-বস্ত্র, এটি প্রায় সকলে একবাক্যে স্বীকার করেন। নতুন বছরের প্রথম দিনে নতুন পোশাক পড়া, এটি রীতিমতো পালনীয় রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। তাইতো পহেলা বৈশাখের অন্তত ১৫-২০ দিন আগ থেকে পোশাক কেনার ধুম পড়ে যায়। শহরের বড় শপিংমল থেকে শুরু করে ফুটপাথ, ছোটবড় শহর এবং গ্রামীণ হাটবাজারের কাপড়ের দোকানগুলোতে উপচে পড়ে ভিড়। ছোট-বড় বহু কাপড়ের দোকানে নববর্ষের কয়েকদিন আগ থেকে শুরু হয় ‘চৈত্র সেল’ নামের বিশেষ বিপণন ব্যবস্থা। যা অব্যাহত থাকে চৈত্র সংক্রান্তির গভীর রাত পর্যন্ত। বহু মার্কেট ও দোকানে আবার চৈত্র সেলের নামে পুরনো কাপড় হ্রাসকৃত মূল্যে বিক্রি করা হয়। এরদ্বারা উপকৃত হয় গরিব মানুষ। ফ্যাশন প্রতিষ্ঠানগুলো পহেলা বৈশাখকেন্দ্রিক নানা ধরনের পোশাক বাজারে আনে। দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনলাইনে কেনাকাটার প্রচার ও প্রসার দুই বেড়েছে। এর মাধ্যমেও প্রচুর পোশাক কেনাবেচা হয়। ধারণা করা হয়, বাংলা নববর্ষভিত্তিক পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি পোশাক কেনাবেচা হয়। আর এর সিংহভাগ অর্থ গ্রামীণ অর্থনীতিতে চলে যায়। কারণ, নববর্ষের পোশাকে বেশিরভাগ তাঁতের বস্ত্র প্রধান্য পায়। তাঁতীরাও নববর্ষে নানান ডিজাইনের পোশাক বাজারে আনে। বিশেষ করে শাড়ি। তাঁতীদের হাত ধরে চাঙ্গা হয় গ্রামীণ অর্থনীতি। বর্তমান সরকার বাংলা নববর্ষে সরকারী ছুটি এবং সরকারী কর্মচারীদের বৈশাখী ভাতা চালু করেছে। গত বছর ২১ লাখ সরকারি কর্মচারীকে ৭০০ কোটি টাকা বৈশাখী ভাতা দেয়া হয়। এ অর্থের প্রায় পুরোটাই বৈশাখকেন্দ্রিক বিভিন্ন উৎসব আনন্দে ব্যয় হয়েছে। ফলে ভিন্নমাত্রা পেয়েছে আমাদের অর্থনীতি। পহেলা বৈশাখে মাছ ও মিষ্টিজাত সামগ্রী খাতেও ব্যাপক অর্থের লেনদেন হয়। যদিও গত দু’বছর ধরে ইলিশ খাতে যথেষ্ট মন্দা গেছে। বর্তমান সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পহেলা বৈশাখে ইলিশ খাওয়া নিরুৎসাহিত করছেন। ইলিশের প্রজন্ম রক্ষা করতে তিনি এ মহৎ উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁর ঘোষণায় সাড়া দিয়ে পান্তা ইলিশের পরিবর্তে ভর্তা এবং মরিচপোড়া ইলিশের প্রচলন ঘটেছে। তবে পহেলা বৈশাখে মাছের ব্যবহার একেবারে হয়নি, তা বলা যাবে না। ইলিশের পরিবর্তে সামুদ্রিক ও চাষের অন্যান্য বিশেষত কোড়াল, রুই, কাতল জাতীয় মাছ প্রচুর কেনাবেচা হয়। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে এ জাতীয় মাছের ব্যবহার অত্যন্ত বেশি। চলে দেদার মাংস কেনাবেচা। একইভাবে ঢাকাসহ সারাদেশে মিষ্টির দোকানগুলোতে শত শত মণ মিষ্টিজাত সামগ্রী বিক্রি হয়। নতুন বছরের প্রথম দিনে অতিথি আপ্যায়নসহ একে অপরকে মিষ্টিমুখ করানোর এ রেওয়াজ পুরনো হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা বেশ গতি পেয়েছে। এমনকি এদিনে নিকটজনদের বাড়িতে হাঁড়িভর্তি মিষ্টি পাঠানোর রেওয়াজও চালু হয়েছে। নতুন বছর মানে লালসালুতে বাঁধানো সাদা কাগজের খাতা। যা ‘হালখাতা’ হিসেবে ব্যবসায়ীদের কাছে সমধিক পরিচিত। বছরের প্রথম দিনে খদ্দের-পাইকাররা মহাজনের গদি-দোকানে গিয়ে বকেয়া পরিশোধ করে নতুন করে হিসেব খোলেন। এ প্রক্রিয়ার অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে-মিষ্টি। এভাবে এদিন বিভিন্ন কাজে প্রচুর মিষ্টির ব্যবহার হয়। আর মিষ্টির ব্যবহারে শুধু দোকানদাররাই নয়, এর সঙ্গে জড়িত গ্রামীণ গোয়ালা, দুধওয়ালা, মিষ্টির কারিগর থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সকলেই লাভবান হয়। দেশের কোথাও কোথাও নববর্ষের মিষ্টি সরবরাহে এক-দুই সপ্তাহ আগ থেকে প্রস্তুতি শুরু হয়। দেশের বহু জায়গায় রয়েছে ‘পালপাড়া’। যেখানে কুমার সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত মৃৎশিল্পীরা সংঘবদ্ধ হয়ে বাস করছে। আধুনিকতার দাপটে দেশের এই মৃৎশিল্পীরা মৃৎপ্রায়। পহেলা বৈশাখের নবজাগরণে জেগে উঠেছে ঝিমিয়ে পড়া মৃৎশিল্পীরা। পহেলা বৈশাখ কেন্দ্র করে কয়েক মাস আগ থেকে মৃৎশিল্পীদের শুরু হয় ব্যস্ততা। মাটির তৈরি হাঁড়ি, পাতিল, সানকি, সরা, ফুলের টব থেকে শুরু করে নানান পণ্য সম্ভারের লেনদেনের বেশির ভাগ অর্থে পেশাজীবী গোষ্ঠীর এ মানুষেরা যেন প্রাণ ফিরে পায়। একইভাবে জাগরণ ঘটছে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পীদের। বাঁশের বাঁশি থেকে শুরু করে কাঠ, বাঁশ, প্লাস্টিকের খেলনা সামগ্রীর মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার হয়। শাঁখা-সিঁদুরের মতো ধর্মীয় সামগ্রীর মাধ্যমেও প্রচুর অর্থের লেনদেন হয়। শহর-বন্দর-গ্রামে বৈশাখী মেলার মাধ্যমে আরও বিভিন্ন পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট লোকজন লাভের মুখ দেখে থাকে। লাভবান হয় পর্যটন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লাখো মানুষ। পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে ঠাঁই পাওয়া অনেকের পক্ষে দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। কক্সবাজার, কুয়াকাটা, রাঙ্গামাটি, সুন্দরবনের মতো খ্যাত পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যেমন মানুষের ঢল নামে, তেমনি সোনারচর, সোনাদ্বীপের মতো অখ্যাত পর্যটনকেন্দ্রগুলোতেও ভিড়ের কমতি থাকে না। শহরের নামী-দামী হোটেল রেস্তরাঁর ন্যায় গাঁয়ের চারপায়ের টেবিলগুলোও থাকে খদ্দেরে ঠাসা। বিনোদনকেন্দ্রগুলোতেও প্রচুর অর্থের লেনদেন হয়। পহেলা বৈশাখের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করছে কসমেটিকস ও গৃহস্থালির তৈজসপত্র খাতকেও। সমৃদ্ধ করছে দেশীয় পণ্যকে। উপকৃত হচ্ছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। সারা বছর তেমন একটা কদর না থাকলেও গ্রামীণ শিল্পী বিশেষ করে বাউল ও বয়াতি শিল্পীরা পহেলা বৈশাখে বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। তাদের ডাক পড়ে নানা অনুষ্ঠানে। এরমাধ্যমে গ্রামীণ অবহেলিত এ শিল্পীগোষ্ঠী ও জড়িত মানুষেরা সংস্থান করে নেন নিজেদের। এভাবে পহেলা বৈশাখ আমাদের অর্থনীতিতে এখন বেশ শক্তিশালী অবস্থান করে নিয়েছে। আগের তুলনায় মানুষের আয় বেড়েছে এবং ক্রমে আরও বাড়ছে। বাড়ছে ক্রয় ক্ষমতা। ফলে জাতীয় উৎসবের এ দিনটি দিচ্ছে দেশের লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ। গতি পাচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। আরও চাঙা হচ্ছে দেশের অর্থনীতি।
×