ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জলি রহমান

পোশাক শিল্পে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২৫ মার্চ ২০১৮

পোশাক শিল্পে এগিয়ে  যাচ্ছে দেশ

তৈরি পোশাক শিল্প বা আরএমজি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। তিনটি রফতানিমুখী খাতের মধ্যে পোশাক শিল্পই অন্যতম। দেশের অর্থনীতিকে বেগবান করতে পোশাক শিল্পের কোন বিকল্প নেই। যে কোন দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা নিঃসন্দেহে সে দেশের শিল্পের উপর নির্ভরশীল। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো শিল্পনির্ভর। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হলেও পোশাক শিল্পে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে বহির্বিশ্বে। তৈরি পোশাকশিল্প রফতানি বাণিজ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বেকার সমস্যা সমাধান, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ শিল্পের অবদান ঈর্ষণীয়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ এই শিল্পের হাত ধরে বিশ্ববাজারে একটি ব্র্যান্ড সৃষ্টি করেছে। যার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত আমাদের দেশ বিশ্বদরবারে নতুন পরিচিতি ও সুনাম অর্জন করছে। দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট। দীর্ঘ ১৫ মাস ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির পর গত জানুয়ারিতে পোশাক রফতানিতে প্রায় আড়াই শতাংশ প্রবৃদ্ধি করেছে বাংলাদেশ। এর আগে সর্বশেষ ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৪৯ কোটি ডলার বা ৪ হাজার ১৮ কোটি টাকার পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। গত বছরের জানুয়ারিতে রফতানি হয়েছিল ৪৮ কোটি ডলারের পোশাক। ২০১৭ সালে ৫০৬ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছিল বাংলাদেশ। গত জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশ থেকে ৭০৫ কোটি ডলারের পোশাক আমদানি করেছে। প্রবৃদ্ধি মাত্র দশমিক ৯২ শতাংশ। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল এ্যান্ড এ্যাপারেলস (অটেক্সা) এর পরিসংখ্যান থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। গত জানুয়ারিতে ১৮ কোটি ৮৬ লাখ বর্গমিটারের সমপরিমাণ কাপড়ের তৈরি পোশাক রফতানি করেছে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ। জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের মোট পোশাক রফতানির ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ গেছে বাংলাদেশ থেকে। গত ডিসেম্বরে যা ছিল ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাজার হিস্যা সামান্য বেড়েছে বাংলাদেশের। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রফতানিতে বরাবরের মতো শীর্ষে আছে চীন। গত জানুয়ারিতে তারা যুক্তরাষ্ট্রে ২৩৪ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে। এটি গত বছরের জানুয়ারিতে রফতানি হওয়া ২৫২ কোটি ডলারের চেয়ে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ কম। ফলে দেশটির রফতানি অনেক কমে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে মোট পোশাক রফতানির ৩৩ দশমিক ৪১ শতাংশই চীনের দখলে। গত বছর শেষে সেটি ছিল ৩৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ভিয়েতনাম দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রফতানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্রে। গত জানুয়ারিতে ১১০ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে ভিয়েতনাম। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ০৯ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানিতে ভিয়েতনামের বাজার হিস্যা ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। পোশাক রফতানিতে তৃতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রে গত জানুয়ারিতে চতুর্থ সর্বোচ্চ ৪১ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে ইন্দোনেশিয়া। পঞ্চম সর্বোচ্চ ৩৪ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে ভারত। ভারতের বাজার হিস্যা বর্তমানে ৪.৬ শতাংশ। সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর পাঁচ বছরের জন্য বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশ উন্নয়নে এ্যালায়েন্স গঠিত হয়। উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট এ্যালায়েন্সের সদস্য তৈরি পোশাক কারখানার ৮৮ শতাংশ সংস্কারকাজ শেষ করেছে। এর মধ্যে শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ৮৪ শতাংশ সংস্কারকাজ অন্তর্ভুক্ত আছে। তবে ৩২২ কারখানা তাদের সংশোধনী কর্মপরিকল্পনা (ক্যাপ) অনুযায়ী সবধরনের সংস্কারকাজ সম্পন্ন করেছে। তৈরি পোশাক শিল্পে একসময় নারী ও পুরুষ শ্রমিকের মজুরি বৈষম্য ছিল লক্ষণীয়। বর্তমানে এ মজুরি ব্যবধান প্রায় ৩ শতাংশ। এ খাতে কর্মরত পুরুষ শ্রমিকেরা গড়ে ৭ হাজার ২৭০ টাকা ও নারী শ্রমিকেরা ৭ হাজার ৫৮ টাকা মজুরি পান। রানা প্লাজা ধসের পরও পোশাক শিল্পে নতুন বিনিয়োগ থেমে থাকেনি। বর্তমানে যেসব পোশাক কারখানা আছে, তার ১৮ শতাংশই ২০১৩-১৬ সালের মধ্যে স্থাপিত হয়েছে। এতে অনেক নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণের সঙ্গে মাধ্যমে বস্ত্র, সুতা, আনুষঙ্গিক উপকরণ, প্যাকেটজাতকরণের উপকরণ ইত্যাদি শিল্পেরও সম্প্রসারণ হতে থাকে। যার ফলে পরিবহন, ব্যাংকিং, শিপিং এবং ইন্সুরেন্স সেবার চাহিদাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর সবটাই অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে। এ ধরনের পরোক্ষ-কর্মসংস্থান মূলত তৈরি পোশাক শিল্প কর্তৃক সৃষ্টি। এ শিল্পের সম্প্রসারণ বাংলাদেশের সমাজে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন করেছে। মানুষের জীবন যাত্রার মানকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। গ্রামীণ জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গ্রামের যেসব ছেলে-মেয়ে, স্বামী পরিত্যক্তা নারীরা কর্মহীন হতাশ জীবন কাটাত। তাদের নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছে এই খাত। যাদের দ্বারা কোন কর্মসাধন প্রায় অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তারা এখন দেশের অবদানে সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে তাদের এই শ্রম বাংলাদেশকে নতুন করে জাগাচ্ছে। সেই সঙ্গে তারা সুস্থ সুন্দর জীবনযাপন করতে পারছে। বাংলাদেশে উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক এই তৈরি শিল্পের উপর নানা সময়ে এসেছে ছোটবড় অসংখ্য আঘাত। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকসহ নানা সংকট গার্মেন্টস শিল্পের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করেছে। এই সব সমস্যা বার বার পিছু টেনেছে এই খাতকে। শ্রমিক অসন্তোষ, মালিক-শ্রমিকের বিরূপ সম্পর্ক, বৈদেশিক বাধা, অগ্নিকা-সহ নানা দুর্ঘটনা ছিল গার্মেন্টস শিল্পের নিত্যসঙ্গী। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে নিভে যায় এক হাজার ১৩৭টি তাজা প্রাণ। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসে পঙ্গুত্ববরণ করেছে আরও দুই হাজার চারশ’ পোশাক শ্রমিক। রানা প্লাজা ধস কেবল বাংলাদেশকেই নয়, বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ এই তৈরি পোশাকশিল্প খাতে এমন মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলা সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সরকারের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে ঘুরে দাঁড়ায় এই খাত। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে স্বজনহারা মানুষ। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে পোশাক রফতানি থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিজিএমইএ। এই লক্ষ্যমাত্রাকে অনেকে উচ্চাভিলাষী বললেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব। এর জন্য বিদ্যমান অনেক সমস্যা দূর করতে হবে। বিশ্ব পোশাক বাজার এখন ৬৫০ বিলিয়ন ডলারের। বাংলাদেশ এর মাত্র ৫ শতাংশ সরবরাহ করে। এ হার ৮ শতাংশে উন্নীত করতে পারলেই ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব।
×