ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আত্মগোপনে দুই শীর্ষ জঙ্গী ভারতে

প্রকাশিত: ০৪:৫১, ২৫ মার্চ ২০১৮

আত্মগোপনে দুই শীর্ষ  জঙ্গী  ভারতে

শংকর কুমার দে ॥ দেশ-বিদেশে বহুল আলোচিত গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলাকারীদের মধ্যে এখন আর মাত্র মামুনুর রশীদ রিপন ও শরিফুল ইসলাম খালিদ নামে দুই শীর্ষ জঙ্গী পলাতক, যারা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে গেছে বলে তদন্তকারী সংস্থা সিটিটিসির দাবি। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার জন্য চিহ্নিত হয়েছে ২২ জন। এর মধ্যে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে ১৩ জন। গ্রেফতার করা হয়েছে ৫ জন, আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে তারা। নব্য জেএমবির শীর্ষ জঙ্গী হাদিসুর রহমান সাগর ও আকরাম হোসেন নিলয়কে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার বিষয়ে এই ধরনের তথ্য পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিটিসি)। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, ধরা পড়ার আগে নব্য জেএমবিকে আবার নতুন করে নাশকতা ও জঙ্গী হামলার জন্য সংগঠিত করার চেষ্টা করছিল রিমান্ডে থাকা দুর্ধর্ষ দুই জঙ্গী সাগর ও নিলয়। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার আগে হামলকারী জঙ্গী নিবরাস, রোহান, ইমতিয়াজ, মোবাশ্বেরসহ কয়েকজনকে ঝিনাইদহে বাসা ভাড়া করে দিয়েছিল হাদিসুর রহমান সাগর, আর আকরাম হোসেন নিলয়; নব্য জেএমবির অন্যতম শীর্ষ একজন অর্থদাতা। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার জন্য অস্ত্র, বিস্ফোরক, অর্থের যোগান দিয়েছিল এই দুই জঙ্গী। এই দুই জঙ্গীই সীমান্তের চোরাইপথে ভারত থেকে বাংলাদেশে অস্ত্র, বিস্ফোরক আনার বিষয়ে অভিজ্ঞ, দক্ষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গী হামলার চার্জশীট যেই মুহূর্তে দেয়ার প্রস্তুতি চলছিল তখনই ধরা পড়ে যায় গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী সাগর ও নিলয়। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার জন্য মূল পরিকল্পনাকারী তামিম আহমেদ চৌধুরীসহ ২২ জনকে চিহ্নিত করার কাজ শেষ। এর মধ্যে সাগর, নিলয়, খালিদ ও রিপন পলাতক ছিল। সাগর ও নিলয় গ্রেফতার হওয়ার পর এখন আর মাত্র দুই জন পলাতক। খালিদ ও রিপন নামের শীর্ষ এই দুই জঙ্গী এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোথাও আত্মগোপনে বলে জিজ্ঞাবাদে জানিয়েছে গ্রেফতার হওয়া দুই জঙ্গী সাগর ও নিলয়। সাগর ও নিলয় গ্রেফতার হওয়ার কারণে গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার বিষয়ে আরও তথ্যসমৃদ্ধ অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দেয়া সম্ভব হবে বলে সিটিটিসির দাবি। সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নজর কাড়তে গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করে নব্য জেএমবি। জঙ্গী হামলা করে হত্যাকা-ের জন্য বেছে নেয় বিদেশী নাগরিকদের। এই পরিকল্পনার সঙ্গে নব্য জেএমবি জঙ্গী সংগঠনের যারা জড়িত ছিল তার মধ্যে সাগর ও নিলয় ছিল অন্যতম। এই জঙ্গী হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী। ২০১৩ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে আসার পর তিনি নব্য জেএমবি গঠন করে সারা দেশে একের পর এক টার্গেট কিলিং মিশন বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে। ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন আইএস মতাদর্শিক এ সংগঠনটি বেশি করে আলোচনায় আসতে বড় হামলা চালিয়ে বিদেশীদের হত্যার পরিকল্পনা করে। জঙ্গী হামলার আগে হামলাকারীদের জন্য ঝিনাইদহে বাসা ভাড়া করে দেয় সাগর ও নিলয়। গুলশানে জঙ্গী হামলার আড়াই মাস আগে হামলার পরিকল্পনা হয় গাইবান্ধার চরে এবং হামলাকারীদের জঙ্গী হামলার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়ানো হয় সেই চরেই। রিমান্ডে থাকা সাগর ও নিলয় জিজ্ঞাসাবাদে এই ধরনের তথ্য দিয়েছে বলে জানা গেছে। সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলায় জড়িত ২২ জঙ্গীর মধ্যে গ্রেফতার হওয়া পাঁচ জঙ্গী আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দী প্রদানকারীরা হলো রাকিবুল হাসান রিগ্যান, পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত জাহাঙ্গীর ওরফে রাজীব গান্ধী, অস্ত্র সরবরাহকারী মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, সংগঠক ও বোমা প্রস্তুতকারী সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ ও রাশেদুল ইসলাম র‌্যাশ। পলাতক চার জনের মধ্যে নব্য জেএমবির অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী হাদিসুর রহমান সাগর, অন্যতম পরিকল্পনাকারী মামুনুর রশীদ রিপন, শরিফুল ইসলাম খালিদ এবং পৃষ্ঠপোষক আকরাম হোসেন নিলয়। এদের মধ্যে খালিদ ও রিপন ভারতে পালিয়ে গেছেন। সাগর ও নিলয় বগুড়ায় ধরা পড়ার পর ঢাকায় নিয়ে এসে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তারা জিজ্ঞাসাবাদ ও রিমান্ড শেষে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে পারে বলে তদন্তকারী সূত্র আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলায় চিহ্নিত ২২ জনের মধ্যে যে ১৩ জন নিহত হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে চালানো অভিযান ‘অপারেশন থান্ডারবোল্টে’ নিহত হন হামলাকারী পাঁচ জঙ্গী- রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম পায়েল। কল্যাণপুরের অভিযানে নিহত হন জঙ্গী প্রশিক্ষক আবু রায়হান তারেক। নারায়ণগঞ্জে নিহত হন মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী। রূপনগরে জঙ্গী প্রশিক্ষক মেজর (অব) জাহিদ, আজিমপুরে সংগঠনের অর্থ সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা তানভীর কাদেরী, আশুলিয়ায় সরোয়ার জাহান মানিক, মোহাম্মদপুরে গুলশান হামলার অপারেশনাল কমান্ডার নুরুল ইসলাম মারজান নিহত হন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে নিহত হন অর্থ সংগ্রহের দায়িত্ব পালনকারী বাশারুজ্জামান এবং অস্ত্র সরবরাহকারী মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান। সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, গ্রেফতার হওয়া সাগর ও নিলয়কে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে ও অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার মিশন বাস্তবায়নের এক মাস আগে গুলশানের কাছাকাছি একটি বাসা ভাড়া নেন তানভীর কাদেরী। ২০১৬ সালের ১ জুন স্ত্রী ও দুই কিশোর ছেলেকে নিয়ে ওই বাসায় ওঠেন তানভীর। এর এক সপ্তাহ পরে ওই বাসায় ওঠেন বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট। এর একদিন পর পাঁচ হামলাকারীকে নিয়ে ওই বাসায় যান মারজান। জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে ওই বাসায় যান হামলার মূল পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরী। ওই বাসার বড় একটি কক্ষে পাঁচ হামলাকারীকে নিয়ে থাকতেন তামিম। হামলার দিন পর্যন্ত তারা ওই বাসায়ই ছিলেন। হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো ওই বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলেন নুরুল ইসলাম মারজান। ২০১৬ সালের ১ জুলাই সকালে বাশারুজ্জামান পাঁচ হামলাকারীর প্রত্যেকের ব্যাগে একটি করে একে-২২, একটি পিস্তল, একটি চাপাতিসহ পর্যাপ্ত পরিমাণ গুলি ঢুকিয়ে দেন। বিকেলে দুই ভাগে ভাগ হয়ে পাঁচ হামলাকারী ভাটারা থেকে কিছু পথ রিক্সায় এবং কিছু পথ হেঁটে ঘটনাস্থলে পৌঁছেন। গুলশান হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র এসেছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও যশোর সীমান্ত পথে। রাশেদ ওরফে র‌্যাশ চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ২০১৬ সালের মে মাসে চারটি পিস্তল আনেন। একই সীমান্ত দিয়ে পাঁচটি একে-২২ রাইফেল আনে ছোট মিজান ও সাগর। প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশান ২ নম্বর সার্কেলের ৭৯ নম্বর সড়কে হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ হামলা চালিয়ে পাঁচ জঙ্গী। তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়তে গিয়ে প্রাণ হারান দুই পুলিশ কর্মকর্তা। জঙ্গীরা হত্যা করেছিল দেশী-বিদেশী ২০ জনকে। পরদিন সকালে প্যারা কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় পাঁচ জঙ্গীসহ ৬ জন। পরে হাসপাতালে মারা যান আরও একজন। সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলা মামলার তদন্তে চার জঙ্গীকে পলাতক দেখিয়ে অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দাখিলের প্রস্তুতি চলার সময়ে হঠাৎ করেই বগুড়ায় ধরা পড়ে যায় সাগর ও নিলয়। পলাতক চার জঙ্গীর মধ্যে এই দুই জন অন্যতম পরিকল্পনাকারী। তাদের বগুড়া থেকে ঢাকায় নিয়ে এসে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, পলাতক অপর দুই জঙ্গী খালিদ ও রিপন এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোথাও আত্মগোপনে থেকে জঙ্গী তৎপরতা চালাচ্ছেÑ এমন চাঞ্চল্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে বলে সিটিটিসির দাবি।
×