ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

যানজটই ওদের জন্য আশীর্বাদ

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ২৪ মার্চ ২০১৮

যানজটই ওদের  জন্য আশীর্বাদ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ট্রাফিক জ্যামে গাড়ির চাকা আটকে যায়, ব্যস্ত নগরী স্থবির হয়ে পড়ে। কিন্তু এই ট্রাফিক জ্যামেই কারও কারও জীবনের চাকা ঘুরতে শুরু করে। রাজধানীর রাস্তায় সিগন্যাল পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভ্রূ কুঁঁচকে যায়, বিরক্তির রেশ ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন যানবাহনে থাকা মানুষের মনে। তবে ঠিক এ সময়টাতেই রাস্তার পাশে থাকা অনেকেরই পায়ে গতি আসে। বিভিন্ন খাদ্য ও পণ্যদ্রব্য নিয়ে যানবাহনের দিকে দৌঁড়াতে শুরু করেন তারা। হ্যাঁ, হকারদের কথাই বলছি। নগরীর জ্যামে যখন সবকিছু থমকে থাকে, তখন সেই জ্যামকে পুঁজি করেই তাদের পরিবারের চাকা ঘুরতে শুরু করে। জ্যামের সময় যাত্রীদের কাছে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করেই সংসার চালাচ্ছেন হকারদের একটা অংশ। ট্রাফিক জ্যামের সুযোগই তাদের কর্মসংস্থান তৈরির অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের ভাষ্যমতে, ‘জ্যাম নাই তো আয় নাই।’ সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকার প্রতিটি সিগন্যালেই হকারের উপস্থিতি। তাদের কেউ শসা, কেউ বাদাম, কেউ আমড়া, কেউ বরই, কেউ পানি কিংবা চিপস বিক্রি করছেন। এর বাইরে নিত্যদিনের ব্যবহারযোগ্য আরও কিছু পণ্য বিক্রি করেন তারা। তবে জ্যামে বসে সময় কাটানোর জন্য খাবারকেই বেছে নেন বেশিরভাগ মানুষ। হকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকার প্রায় ৭০টি ট্র্যাফিক সিগন্যাল-পয়েন্টে হকার হিসেবে যুক্ত রয়েছেন নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ। শাহবাগ এলাকার হকারদের থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, শুধু হাইকোর্ট থেকে শাহবাগ সিগন্যাল পর্যন্ত হকার আছেন ৬৫ থেকে ৭০ জন। এরা সবাই বিভিন্ন ধরনের খাবার নিয়ে বিক্রি করে থাকেন। এর মধ্যে একজন পানি বিক্রেতা আরশাদুল। তার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা, থাকেন ঢাকায় ফুলবাড়িয়াতে। গ্রামের বাড়িতে মা আছেন তার। প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় পানি বিক্রি করে বোতলপ্রতি ৫ টাকা লাভ করেন তিনি। দৈনিক তার আয় প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। পল্টন থেকে শাহবাগের মধ্যে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত পানি বিক্রি করেন তিনি। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাস্তা ফাঁকা থাকলে বিক্রি কম হয়। জ্যাম থাকলে বিক্রি বেশি। তার সারাদিনের যে আয়, তাতে কোন রকমে পরিবারের খরচ চালানো যায়। শাহবাগ এলাকাতেই কথা হয় আরও একজন হকারের সঙ্গে। নাম রনি। লালমনিরহাটের রনি ঢাকায় এসেছেন ৯০-এর দশকে। পড়ালেখা করেছেন ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। ক্লাসরুমে পড়া না পারার কারণে শিক্ষকদের তোপের ভয়ে ঢাকায় চলে এসেছেন। বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছেন। কখনও কারও বাড়িতে, কখনও অফিসে আবার কখনও রেস্টুরেন্টে। গত কয়েকদিন ধরে বিক্রি করছেন আমড়া এবং বরই। রনি জানান, মহাজনের কাছ থেকে দু’ভাবে আমড়া কেনা যায়। একটা প্যাকেজ সিস্টেম, আরেকটা মাখানো অবস্থায়। প্যাকেজ সিস্টেমে আমড়ার সঙ্গে থালা ও চামড়া খোলার পিলার পাওয়া যায়। রনি আরও জানান, সকালের অফিস টাইম আর দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটে। কারণ, এই সময় গাড়ির চাপ থাকে অনেক। যখন রাস্তায় গাড়ি থাকে না, তখন একপাশে বসে থাকতে হয়। ট্র্যাফিক সিগন্যাল পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির কাছে দৌঁড়ে যান তারা। এদিকে শুধু বরই বিক্রি করতে প্রতিদিন গাজীপুর থেকে ঢাকায় আসেন মমিনুল। প্রতিদিন ৫ ঘণ্টা সময় তার ব্যয় হয় গাজীপুর থেকে ঢাকা আসা-যাওয়া করতেই। তারপর কারওয়ান বাজার থেকে এক মণ বরই কিনে চলে যান শাহবাগ। সেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বরই বিক্রি করেন। এই এক মণ বরই বিক্রি করতে তিনি সঙ্গে রেখেছেন আরও একজনকে। তিনি জানান, দিনের বরই দিনে বিক্রি না হলে ফেলে দিতে হয়। মমিনুলের বাড়ি গোপালগঞ্জে। বাড়িতে তার বউ আছে। এই বরই বিক্রির টাকা দিয়েই সংসার চালান তিনি। আবার দীর্ঘ ১২ বছর ধরে শুধু শসা বিক্রি করছেন শহিদুল। তার গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরা। তার সারাদিনের আয় দিয়েই পরিবার চলে। তিনিও একই কথা জানালেন, জ্যাম নাই তো আয় নাই।
×