ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প

মহুয়া ॥ নাসরীন মুস্তাফা

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৪ মার্চ ২০১৮

মহুয়া ॥ নাসরীন মুস্তাফা

দিন-তারিখ মনে নেই। কেবল মনে আছে, মাটি ফুঁড়ে যখন মাথাটা তুলেছিলাম, তখন খুব অবাক হয়েছিলাম। এত আলো চারদিকে! গপগপ করে আলো খেতে খেতে দুলছিলাম। কে একজন ছুটে এসে দেখছিল আমার মুখ। ছুটে আসার শব্দ শুনে বুঝেছিলাম, ছোট বয়সী কোন মানুষ হয়ত। মাটির গভীরে থাকতেই তো মানুষ চিনেছিলাম। মায়ের শরীর থেকে পাওয়া বীজ মাটির নিচে যতœ করে রেখেছিল এ রকম এক মানুষই তো। মাটি ভিজে যেত নিয়ম করে। ভেজা মাটি থেকে খাবার পেয়ে যেতাম খুব সহজে। ঘুমিয়েই ঘুমিয়েই খাবার খেতাম আর বড় হতাম। একদিন দুটো পাতা মাথায় গজিয়ে গেল। ছোট্ট বীজের ভেতরে পাতা দুটো। বীজের এক পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে শেকড়। শেকড় শক্ত করে মাটিকে জড়িয়ে ধরে আমার পাতা দুটোকে বলে, হেঁইয়ো! জোরসে জাগ, হেঁইয়ো! মাটির নিচে পাতা থাকবে কী করে? তাই বীজ মাটি ফেটে উঠে এল উপরে। পাতা দুটোকে জাগিয়ে দিয়ে বলে, বাছা! আমার কাজ শেষ। এবার তুমি বড় হতে থাক নিজের জোরে। নিজের জোরেই আমি বলেছিলাম, আমি এসেছি! আমি এসেছি! ছোট্ট মানুষটা পানিভর্তি মগ নিয়ে এসে চেঁচিয়ে বলে, এসে গেছে! এসে গেছে! কে এসে গেছে? আমাল গাছট! ছোট্ট মানুষটা ‘আমার’ না বলে ‘আমাল’ বলেছে শুনে কত হাসি যে ছুটল! ছোট্ট মানুষটার পাশে এসে দাঁড়ানো বড়রা জানাল, তোমার গাছটার নাম কি জান? ওর নাম মহুয়া! কী সুন্দর নাম! মহুয়া খুব সুন্দর গাছ। অনেক বড় হয়। অনেক ছায়া দেয়। অনেক অনেক বছর ধরে ছায়া দেয়। ফুল দেয়। ফল দেয়। আমি এই এইটুকুন ছোট গাছ, শুনেই তো অবাক হলাম। আমার এত গুণ! যতদিন গেছে, তত আরও জেনেছি। ওই যে ছোট্ট মানুষটা, আমার বন্ধু, বলেছিল সব। ততদিনে আমি জেনে গেছি, আমার বন্ধুর নাম কি। খোকা। আমার দশ বছর বয়সেই ফুল এল ডালে। খোকার বয়স তখন পনেরো। খোকার মা খোকাকে আদর দিয়ে বলেন, সবুর কর। বসন্তের শেষে সুপারির আকারের ফল হবে। ফলের বীজ থেকে তেল বানাবো। মহুয়ার পাতা, শরীরের ছালও কী কম কাজের? কত্ত রকমের ওষুধ হয়! মানুষের কত্ত উপকার করে মহুয়া! খোকা আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে। আমি যে খোকার গাছ। আর তাই, সময় পেলেই খোকা আসে আমার কাছে। তবে বছরের একটি মাত্র দিন খোকার মাকে দেখতাম আমার কাছে আসতে। মুখে লেগে থাকত মিষ্টি হাসি। বলতেন, জানিস মহুয়া! আজ আমার খোকার জন্মদিন। সত্যি! হু! আজ মার্চ মাসের ১৭ তারিখ। আজ আমার খোকা আমার কোল জুড়ে এসেছিল। তাই, আজকের দিনটা এলেই আমার খুব ভাল লাগতে থাকে। মনে হয়, আমি পাখি হয়ে উড়ে যাই। সব সময় উড়তে থাকি আমার খোকার পাশে পাশে। এই রকম ইচ্ছে তো আমারও হয়। খোকা বড় হয়ে উঠছে আর খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। মিছিল করছে! মানুষের নানান দাবি আদায়ে খোকা থাকে সবার আগে। আমি গাছ বলে খোকার সঙ্গে যেতে পারি না। পাখি হলেই তো বেশ হ’ত! খোকা যেখানে যেত, আমিও যেতাম। খোকার মা টের পান আমার মনের কথা। বলেন, তুই কেন খোকাকে এত ভালবাসিস্, বল তো? খোকা আমাকে আলোতে এনেছে। আমাকে দিয়েছে বাঁচার আনন্দ। গাছ হয়ে ওঠার স্বাধীনতা তো চিনেছি খোকারই জন্য। ভাগ্যিস খোকা জন্ম নিয়েছিল। নইলে আমার তো আমি হয়ে ওঠা হতো না। খোকা না এ রকমই। আমাকে গাছ হয়ে উঠতে দিয়েছে পরম যতেœ। ওর চারপাশের মানুষকে দিতে চায় মানুষের জীবন। আমার ছায়ায় বসে খোকার এ রকম চাওয়ার গল্প করে মানুষ। যতদিন যায়, টের পাই, খোকার মতো জোরালো হয়ে উঠছে এই মানুষদের কথাগুলো। টের পাই, মানুষের মতো দেখতে অমানুষের দল ভয় দেখানোর খেলায় মেতেছে। আমার গোড়ায় বেঁচে থাকা মানুষের দলকে বেঁধে আনে অমানুষেরা। আমি শুনি শব্দ হয়, ট্যাট্ ট্যাট্ ট্য্টা...মানুষগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে মাটিতে, কারও কোন শব্দ থাকে না। আমি খোকাকে চাই। খোকার কাছে বিচার দেব আমি। ও যে মহুয়াকে বড় করেছে, তার শরীরে কেন খোকার মানুষদের রক্তের দাগ লাগবে? খোকা, তুমি কোথায়? মানুষের কান্নায় জেনে যাই, এই যে মাটি, যে মাটিতে আমি জন্মেছি, সে মাটিকে খোকা দেশ বানিয়েছে। খোকা এই দেশের নাম দিয়েছে বাংলাদেশ। খোকা নাকি বলেছে, দেশকে মুক্ত করতে যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। খোকার কথা বলে কথা! দেশটাকে মুক্ত করতে মানুষরা ‘বিচ্ছু’ হয়ে উঠেছে। দেশকে অমানুষদের হাত থেকে বাঁচাতে ওরা জান হাতে নিয়ে লড়ছে। এক বিচ্ছু বুকে গুলি খেয়েছিল। ওর বিচ্ছু বন্ধুরা ওকে নিয়ে এসেছিল এখানে। বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। ‘জয়বাংলা’ বলে চোখ বুঁজেছিল সে। শেষ বারের মতো তাকিয়েছিল আমার পাতাগুলোর দিকে। এর কিছুদিন পরেই টের পেলাম, অমানুষের দল হেরে গেছে খোকার মানুষদের কাছে। ছোট ছোট সোনামনিরা ছুটে এল আমার কাছে। সবুজ কাপড়ের উপর লাল গোল কাপড় বসিয়ে ছুটে এল। বলল, মহুয়ার ডালে ঝুলিয়ে দেব আমাদের পতাকা। এই বুঝি পতাকা! খোকার বাংলাদেশের পতাকা! আমি মন ভরে দেখছি আর ভাবছি, আমি আর পাখি হতে চাই না। এখন থেকে আমি কেবল পতাকাই হতে চাইব। লাল-সবুজ পতাকা। আমাকে সঙ্গে নিয়ে ছুটবে শিশুরা। আনন্দ করবে। খোকার জন্মদিনে শিশুদের আনন্দ আরও বেশি। ১৭ মার্চ নাকি এই দেশের সব শিশুদের খোকা হয়ে ওঠার দিন! আমার খোকার মতো হতে চায় ওরা। স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন খোকা, নইলে কী করে স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ হতো এই মাটির মানুষগুলো? ওহ্ হো, বলাই তো হয়নি, খোকার মহুয়া এই আমার বয়স এখন একশ’ ছুঁই ছুঁই। সামনের দিনগুলোতে খোকার স্বপ্নকে বুকে লালন করতে চাই নতুন মহুয়াদের। আর তাই ছড়িয়ে দিয়েছি আমার ফলগুলো, যার ভেতরে আছে তাজা তাজা বীজ। ওই যে দ্যাখ, ছোট্ট হাতগুলো সেই বীজ পুঁতে দিচ্ছে মাটির গভীরে। পানি দিচ্ছে। যতœ করছে। পাতা যেই না মাটি ফুঁড়ে বের হচ্ছে, ছোট্ট মানুষগুলো লাফিয়ে উঠছে খুশিতে। আনন্দে আমার তখন কি হয় জান? আমি না খোকা হয়ে যাই। আমার খোকা। আমাদের খোকা। আচ্ছা, খোকার পুরো নামটা তো একবারও বলিনি আমি। না বললেও চলে, তাই না? এই পৃথিবীর কে না জানে সেই আশ্চর্য মানুষটির কথা, যিনি মানুষকে স্বাধীনতা নামের বীজ উপহার দিয়েছিলেন? সেই বীজ থেকে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ। আমি যেখানে শেকড় ছড়িয়ে বেঁচে আছি। তুমি যেখানে স্বাধীনতার আনন্দ নিয়ে বড় হও, স্বপ্ন দেখ, হাসো, খেলো, তাই না? অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
×