ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আরএসওর তৎপরতা ॥ সংগঠিত হচ্ছে ক্যাডাররা

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৪ মার্চ ২০১৮

আরএসওর তৎপরতা ॥ সংগঠিত  হচ্ছে ক্যাডাররা

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ মিয়ানমারের সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন আরসা ক্যাডারদের অর্থ যোগানদাতা পাকিস্তানীসহ আরএসও জঙ্গীরা গোপনে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মাঝে নগদ অর্থ বিতরণ করে চলছে। বিদেশীদের দেয়া নগদ টাকার লোভে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের মাঝে এ রকম ঘটনা ঘটলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে তাৎক্ষণিক তাদের খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্যুরিস্ট ভিসায় বিদেশীদের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রবেশ নিষেধ থাকলেও কতিপয় রোহিঙ্গা নেতা মানছে না ওই বিধিনিষেধ। প্রতিদিন বিদেশীদের এক ক্যাম্প থেকে নিয়ে যাচ্ছে অন্য ক্যাম্পে। সূত্র জানায়, পুরনো রোহিঙ্গা নেতারা (আরএসও) ক্যাম্পে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের সংগঠিত করছে। নগদ টাকার লোভে ফেলে আরএসও ক্যাডাররা আন্দোলনমুখী করে তুলছে রোহিঙ্গাদের। ফ্রান্সের একটি সংস্থার দেয়া চার কোটি টাকার মধ্যে আড়াই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে সৌদিতে পালিয়েছে আনাছ নামে এক রোহিঙ্গা জঙ্গী। এরপর বিদেশীদের কেউ কেউ নিজেরা এসে আরএসও’র মাধ্যমে টাকা বিতরণ করছে ক্যাম্পে। মিয়ানমারের সন্ত্রাসী সংগঠনকে অর্থ যোগানদাতা ব্যক্তিরা ভ্রমণপিপাসুর ছদ্মাবরণে নগদ টাকা বিতরণ করে ক্যাম্পে অস্থিতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে বলে জানা গেছে। জানা যায়, পাকিস্তান, ফ্রান্স, তুর্কী, মালয়েশিয়া ও সৌদি আরব থেকে ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে আসা ব্যক্তিরা নগদ অর্থ বিতরণ ছাড়াও দো-ভাষীর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে উস্কানিমূলক কথাবার্তাও বলছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক মসজিদসমূহে রোহিঙ্গা মৌলবিরা বক্তব্য রেখে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন না হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে নগদ টাকা বিতরণের ঘটনা। প্রশাসনের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিন বিদেশীরা নগদ টাকা নিয়ে ঢুকে পড়ছে ক্যাম্পে। আশ্রয় শিবিরে কারা ঢুকবে, সেসব বিদেশীর গলায় ঝুলানোর জন্য প্রশাসনের তরফ থেকে কোন ধরনের কার্ড ইস্যু না করায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওসব বিদেশী নারী-পুরুষকে চিহ্নিত করতে পারছে না। দিনের বেলায় বিদেশীরা ক্যাম্পে গিয়ে নগদ টাকা নিতে রোহিঙ্গাদের হাতে টোকেন ধরিয়ে দিচ্ছে। জানিয়ে দেয়া হচ্ছে কোন শেড মাঝির কাছ থেকে তারা টোকেন জমা দিয়ে টাকা গ্রহণ করবে। অথচ দেশী বিদেশী সংস্থার দেয়া ত্রাণ সামগ্রী রোহিঙ্গাদের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে বিতরণের জন্য সরকার সুশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তবে অতি উৎসাহী কিছু আরএসও ক্যাডারের কারণে ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের সামাল দেয়া এবং প্রত্যাবাসনে রাজি করান কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মত প্রকাশ করেছেন সচেতন মহল। সূত্র জানিয়েছে, গত জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ফ্রান্সের তিন নাগরিককে নিয়ে ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে আসে আল ইয়াকিন তথা আরসার অর্থ যোগানদাতা আবু আনাছ নামে এক রোহিঙ্গা জঙ্গী। আবু আনাছের বাবা-মা রোহিঙ্গা স্রোতের সঙ্গে মংডু করইবনিয়া থেকে পালিয়ে আসে বাংলাদেশে। আশ্রয় নেয় উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে। আবু আনাছ সৌদি আরবের রিয়াদে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সুবাদে সম্পর্ক গড়ে ফ্রান্সের সুফিয়ান ও ফৌজিসহ বেশ কয়েক বিদেশী নাগরিকের। মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থানকরা আরএসও নেতাদের এবং আরসা প্রধান আতা উল্লাহর সঙ্গে আগে থেকেই রোহিঙ্গা জঙ্গী আনাছের দারুণ সখ্য রয়েছে। বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার (নিবন্ধন বিহীন) অর্থে পুরনো রোহিঙ্গা নেতারা রোহিঙ্গাদের শেড, মসজিদ নির্মাণ ও টয়লেট-টিউবওয়েল স্থাপনসহ নানা রকমের কাজ করছে। এ দিকে ফ্রান্সের তিন নাগরিকসহ মৌলবি আনাছ গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশে সফরে আসে। দেশে ঘাপটি মেরে থাকা রোহিঙ্গা জঙ্গী মৌলবি ওসমান নেজামী, আয়াছ, শফিক, ইয়াহিয়া, নুর হোসন ও হাফেজ হাশেমের সঙ্গে হোটেলে একাধিক গোপন বৈঠক করে বিদেশীরা। রোহিঙ্গাদের সেবায় ব্যয় করতে প্রায় চার কোটি টাকা মৌলবি আনাছকে দিয়ে চলে যায় ফ্রান্সের নাগরিকরা। তন্মধ্যে প্রায় দেড় কোটি টাকা উপরোক্ত রোহিঙ্গা জঙ্গীদের মাধ্যমে ব্যয় করে আড়াই কোটি টাকা হাতিয়ে সৌদিতে পালিয়ে যায় রোহিঙ্গা আনাছ। এ খবর পাকিস্তান, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া ও তুরস্কে জানাজানি হলে ওসব দেশের নাগরিকরা ভিসা নিয়ে এসে আরএসও নেতাদের মাধ্যমে নিজেরাই গোপনে রোহিঙ্গাদের টাকা বিতরণ করছে বলে জানা গেছে। সূত্র আরও জানায়, রোহিঙ্গা মৌলবি ওসমান নেজাম উদ্দিন ওরফে ওসমান নেজামী নামে এক আরএসও নেতা বৃহস্পতিবার সকালে মালয়েশিয়ার ১০-১২জনের একটি গ্রুপকে বালুখালী ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তার ভাই ছৈয়দ হোছন বালুখালী ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের মাঝি (নেতা) হিসেবে প্রভাব বিস্তার করে চলছে। রোহিঙ্গারা জানায়, পাকিস্তান ও মালয়েশিয়া থেকে আসা ওসব মৌলবির সঙ্গে টাকা বিতরণে বালুখালী, কুতুপালং ক্যাম্পের বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা মাঝি এবং আরএসও নেতা জড়িত রয়েছে। খবর পেয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ গোয়েন্দা কর্মীরা ঘটনাস্থলে এগিয়ে আসছে বুঝতে পেরে টাকা বিতরণে জড়িত আরএসও জঙ্গী রোহিঙ্গা নেতারা সটকে পড়েছে। উখিয়া থানার ওসি মোঃ আবুল খায়ের বলেন, টাকা বিতরণের খবর পেলেও বাস্তবে রোহিঙ্গাদের মাঝে তাদের তাৎক্ষণিক খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দিকে সৌদি আরবে (রিয়াদ) অবস্থানকারী বাংলাদেশী দাবিদার রোহিঙ্গা জঙ্গী আবু সিদ্দিক আরমানের হুন্ডিতে পাঠান টাকা বিতরণ ও আরএসও’র জঙ্গীপনায় ব্যয় করছে হাফেজ মোঃ হাশেম নামে এক পুরনো রোহিঙ্গা জঙ্গী। কিছুদিন আগে ওই আবু সিদ্দিক আরমানসহ ছয় রোহিঙ্গা জঙ্গীকে রামুতে গোপন বৈঠক করার সময় গ্রেফতার করেছিল আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। কয়েকমাস জেল খেটে বেরিয়ে পড়ে তারা। পরবর্তী ভযঙ্কর জঙ্গী আবু সিদ্দিক আরমান পালিয়ে যায় সৌদি আরবে। ওই জঙ্গীর নামে কক্সবাজারে একাধিক পট রয়েছে। সৌদি আরব থেকে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সফর করে রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের দোহাই তুলে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে জঙ্গী আরমান। জঙ্গীপনা ও রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন কাজে ব্যয় করতে হুন্ডির মাধ্যমে কিছু অর্থ পাঠিয়ে থাকে হাফেজ হাশেমের কাছে। ঢাকায় গোপনে অবস্থানকারী রোহিঙ্গা নেতা সলিমুল্লাহ বিদেশী লোকজনকে রিসিভ করে পাঠিয়ে দেয় কক্সবাজারে। রোহিঙ্গা জঙ্গী ইয়াহিয়া, হাফেজ হাশেম, আয়াছ ও ওসমান নেজামী ওই বিদেশীদের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে নিয়ে যায়। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শুরু থেকে এ পর্যন্ত চিহ্নিত আরএসও নেতাদের কেউ আটক না হওয়ায় নির্বিঘ্ন অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। কিছু এনজিওর পাশাপাশি ওই আরএসও নেতারা রোহিঙ্গাদের মাঝে প্রত্যাবাসন বিরোধী উস্কানি ছড়িয়ে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সচেতন মহল। প্রত্যাবাসন কাজ সহজ করতে হলে আগে ওই পুরনো রোহিঙ্গা নেতাদের গ্রেফতার করা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তারা।
×