ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চা শ্রমিকদের দুঃখ কথা

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ২৪ মার্চ ২০১৮

চা শ্রমিকদের দুঃখ কথা

(গতকালের পর) চা শ্রমিকদের জন্য ৫০ শয্যা হাসপাতাল ॥ শ্রীমঙ্গল শহর থেকে দূরে ইছুবপুরে ১৯৮৪ সালে চা শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য শ্রম মন্ত্রণালয় ৫০ শয্যা বিশিষ্ট একটি হাসপাতাল তৈরি করে। ৫ একর জমির উপর প্রায় ৫ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা হয় এ হাসপাতাল। সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই না করে চা বাগান এলাকা থেকে অনেক দূরে হওয়ায় খুব কম সংখ্যক চা শ্রমিক চিকিৎসার জন্য যেত। ফলে শ্রম মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে প্রশাসনিক জটিলতার কারণে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হাসপাতাল ভবন, কর্মকর্তাদের জন্য বাড়ি, চিকিৎসা সরঞ্জাম, ইত্যাদি অযত্নে দীর্ঘদিন ফেলে রাখার ফলে নষ্ট হয়ে যায়। পরে পরিত্যক্ত ও বিকল হয়ে যাওয়া যন্ত্রপাতী মৌলভী বাজার সরকারী হাসপাতালে হস্তান্তর করা হয়। এখন হাসপাতালটি বন্ধ । এখন এখানে চলছে একটি রেসিডেন্সিয়াল বিদ্যালয়। . চা শ্রমিকদের জীবনকে প্রভাবিত করে যারা চা বাগানে চা শ্রমিকদের উপর বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করেন বিভিন্ন ব্যক্তিগণ। এদের মধ্যে কেউ বা ওদের ভালোর জন্য আবার কেউ বা এদের পক্ষে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করার জন্য। ১. বাগানের ম্যানেজার : চা বাগানে তিনি পরোক্ষভাবে সকল কাজে ভূমিকা রাখেন, কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় খুব কঠিন সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। বাগানে অস্থায়ী শ্রমিককে স্থায়ী করা তার ক্ষমতার মধ্যে পড়ে। নতুন শ্রমিক নির্বাচনও তিনি করে থাকেন। বাগানের নিয়ম শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে গিয়ে অনেক অপ্রিয় সিদ্ধান্ত দেন এই ম্যানেজার, তাই তারা ম্যানেজারকে তাদের একজন শুভাকাক্সিক্ষ হিসেবে মনে করেন। ২. বাগান ডাক্তার : যেহেতু অসুস্থ হলে তিনি চিকিৎসা দেন, বিপদে সহায়তা দেন এবং ম্বাস্থ্য শিক্ষার তথ্য সরবরাহ করেন। তাই ডাক্তার খুবই জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। ৩. টিলাবাবু : সাপ্তাহিক বেতন ও ন্যায্য এবং স্বল্প মূল্যে খাদ্য দ্রব্য সরবরাহ করেন। কোন সমস্যা দেখা দিলে সমাধানের চেষ্টা করেন। বাগানে প্রথম শ্রমিক হিসেবে কাজ পেতে সহায়তা করেন। তাই টিলা বাবু তাদের খুবই প্রিয়জন। ৪. পঞ্চায়েত : পঞ্চায়েত চা শ্রমিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন। যা বাগানের নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে, ঝগড়া বিবাদ মেটানো নতুন শ্রমিক নির্বাচন ইত্যাদি কাজ পঞ্চায়েত করে থাকে। তাছাড়া অস্থায়ী শ্রমিককে স্থায়ী করার সুপারিশ করে থাকে। যে কোন সমস্যায় তারা এগিয়ে এসে ম্যানেজমেন্টের সাথে কথা বলে সমাধানের চেষ্টা চালান। পঞ্চায়েত চা শ্রমিকদের মধ্যে খুবই গ্রহণযোগ্য একটি সংগঠন। ৫. কবিরাজ : কবিরাজ বাগানের শ্রমিকেরা অসুস্থ হলে হারবাল চিকিৎসা করে থাকেন এবং ধর্মীয় জ্ঞান দান করে থাকেন। চা শ্রমিকরা কবিরাজকে ভীষণ বিশ্বাস করেন। ডাক্তার যখন কোন রোগীর রোগ ভাল করতে না পারেন তখন তারা কবিরাজের কাছে চিকিৎসার জন্য যান। তাই তিনি চা বাগানে খুবই বিশ্বস্ত ব্যক্তি। ৬. মা : তাদের মা বিশেষ করে অবিবাহিত মেয়েরা অসুস্থ হলে যত্ন নেন। যখন তারা কোন কঠিন অসুখে ভোগেন তখন মা-ই তাদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেবা যত্ন করে থাকেন। তাই মা তাদের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলে থাকেন। নেতিবাচক প্রভাবকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ১. মহাজন : দারিদ্রতার সুযোগে মহাজন চা শ্রমিকদের উচ্চ সুদে ঋণ দান করেন। চা শ্রমিকরা যদি টিলাবাবু বা সমাজে কারও কাছ থেকে বিপদের সময় সাহায্য পান না, তখন তারা মহাজনের কাছে ঋণের জন্য যান। মহাজনরা চা শ্রমিকদের জীবনে ভীষণ প্রভাব ফেলেন। বিপদে তারা সাহায্য করার জন্য সত্যিই এগিয়ে যান কিন্তু বিনিময়ে তাদেরকে ভীষণভাবে প্রতারিত করেন, যাহা অনেক সময় আগে থেকে চা শ্রমিকরা বুঝতে পারেন না। ২. অবিবাহিত যুবক : ১৩-১৪ বছরের যুবকরা চা বাগানে ১০-১২ বছরের যুবতীদের সাথে মেলামেশা করার সুযোগ পান। সেই সুযোগে তাদের মধ্যে শারিরীক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যা চা শ্রমিকদের যুবতি মেয়েদের জীবনে বড় রকমের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই যুবক-যুবতিদের অধিকাংশ পরবর্তিতে অরক্ষিত যৌন কাজে অভ্যস্ত হয়ে উঠে। . চা বাগানে শ্রমিকদের শঙ্কা চা শ্রমিকদের মধ্যে অনেক রকমের থ্রেট বা শঙ্কা কাজ করে। বলা যায়, এক রকম অনিশ্চিয়তার মধ্যে দিন কাটায় তারা। যেমন যে শ্রমিকরা জন্ম-জন্মান্তর ধরে তার বাড়িতে বাস করছে কিন্তু সামান্য ভূল ভ্রান্তির কারণে যদি চাকরি হারায় তবে তার এ বাড়ি ছেড়ে দিতে হয়। ছেলে মেয়ে নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সব সময় তাদেরকে তাড়া করে বেড়ায়। তারা সব সময় ঋণী থাকেন হয় মহাজন নামক সুদ খোরের কাছে। ফলে কোনও সময় তারা নিজেদের উন্নয়নের জন্য চা শ্রমিকের কাজ ছাড়া অন্য কোন কিছু চিন্তাই করতে পারেন না। ইদানিং চা বাগানগুলোতে চুরি ও ডাকাতির হার বেড়েছে। তাই প্রত্যন্ত চা বাগানগুলোর ভাঙ্গা ঘরবাড়ি থেকে প্রায়ই জিনিসপত্র চুরি হয়ে যায়। কিছু কিছু ব্যক্তি মালিকানাধীন চা বাগানে জাত শ্রমিকের পাশাপাশি দেশীয় শ্রমিককে চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেয়ায় এদের সাথে আদি শ্রমিকদের মধ্যে নীরব বিদ্রোহ বাড়ছে। যে সব চা বাগানে গ্রামের শ্রমিক বেশি নিয়োগ হচ্ছে সেখানে অসামাজিক কাজ, চুরি ডাকাতি বাড়ছে। বয়স্ক মহিলা শ্রমিক এবং পুরুষ শ্রমিক যখন চাকরি থেকে অবসর নেন তখন নিজের বাড়ি তাদের ছেলে মেয়েদেরকে হস্তান্তর করে দিতে হয়। তখন তারা ধীরে ধীরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তাদেরকে সম্পূর্ণভাবে অন্যের করুণার উপর নির্ভর করে বাঁচতে হয়। দুবেলা খাবারও কোন কোন দিন খেতে পান না। এরকম অনেক মহিলা এবং পুরুষ দেখা যায় জীর্নশীর্ণ অবস্থায় রাস্তার পাশে অথবা কোন টি-ষ্টলের পাশে বসে দিন কাটাতে। চা বাগানের চালিকা শক্তি মেয়ে শ্রমিকরা সন্তান জন্ম দেয়ার পর ৩ মাস মেটার্নিটি ছুটি পান। এর পর বাচ্চাকে নিয়ে কাজে যেতে হয়। ছায়া বৃক্ষের নীচে এক টুকরা গামছা পেতে এর উপর কোলের শিশুকে রেখে পাতি তুলতে হয়, না হলে যে ৩০ টাকা মুুজুরির জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচা পাতা তুলা যাবে না। দুপুরে চা পানি খাবার সময় গাছ তলায় এসে শিশুকে বুকের দুধ খাইয়ে যেতে হয়। চলবে...
×