ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. মিহির কুমার রায়

টেকসই কৃষি উন্নয়ন খাদ্য নিরাপত্তায় সহায়ক

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ২৪ মার্চ ২০১৮

টেকসই কৃষি উন্নয়ন খাদ্য নিরাপত্তায় সহায়ক

জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি)-২তে উল্লেখ আছে ক্ষুধা থেকে মুক্তি, খাদ্যের নিরাপত্তা বিধান, পুষ্টির মান উন্নয়ন এবং কৃষি ক্ষেত্রে টেকসই কর্মপদ্ধতির বিকাশ সাধন। বর্তমান সরকার কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে নানাবিধ উপায়ে খাদ্য নিরাপত্তা বিধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যার সঙ্গে পুষ্টি উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনের সম্পর্ক রয়েছে। প্রকৃতিগত কারণে প্রতিবছর দেশে ১ ভাগ হারে কৃষি জমি হ্রাস পেলেও দেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে ৩ গুণ, গমের উৎপাদন বেড়েছে ২ গুণ, সবজির উৎপাদন বেড়েছে ৫ গুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ। আবার আম উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে ১ম স্থানে, আলু উৎপাদনে ১০ম স্থানে এবং চাল উৎপাদনে বিশ্বের চতুর্থ স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর তথ্য মতে, বাংলাদেশের ৫৭ শতাংশ গৃহস্থালি কৃষির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত যারা প্রবৃদ্ধিতে, পুষ্টি উন্নয়নে ও খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখছে বিশেষত শ্রমঘন, স্বল্প পুঁজি ও স্বল্প জমির প্রয়োজন হেতু। বিবিএসের বৈদেশিক বাণিজ্য পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, বিগত ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে এই খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে যথাক্রমে চামড়াজাত পণ্য (২০২৪.১০ কোটি টাকা), মাংস ও মাংস জাত (৯.৮৮ কোটি টাকা), প্রাণিজ উপজাত (১২৬.৮১ কোটি টাকা) অর্থাৎ সর্বমোট ২১৭৬.৭৭ কোটি টাকা। জাতিসংসের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-এর ৯টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তা, সুষম খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করণ, কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে প্রাণিসম্পদ সংযুক্ত। এই খাতকে গুরুত্ব দিলে এসডিজি অর্জনে সহায়ক হবে বিশেষত গণতান্ত্রিক সরকার ভিশন ২০২১ অর্জনে জনপ্রতি দুধ ১৫০ মিলিমিটার, মাংস ১১০ গ্রাম এবং বছরে ১০৪টি ডিমের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে কাজ করে চলছে। দেশের কর্মশক্তির ২০ শতাংশ প্রাণিজসম্পদ খাতে রয়েছে এবং ৪৪ শতাংশ আমিষ আসছে এ খাত থেকে। আবার মৎস্য উৎপাদনের বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৬ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয় থেকে মৎস্য চাষে বিশ্বের ৪র্থ স্থানে ও সার্বিকভাবে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে মাছে উৎপাদনের পূর্বের ছেয়ে ৮৪ হাজার টন বেশি যা প্রায় ৫৩ শতাংশ বেড়েছে। দেশের জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ৩.৬১ শতাংশ। এই অবস্থায় টেকসই উন্নয়নের জন্য গতিশীল কৃষির অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখছি যা থেকে মনে হয় সত্যিই কি কৃষির গুরুত্ব কমে যাচ্ছে? যেমন : জিডিপিতে কৃষির অবদান ক্রমেই কমছে আর শিল্প তথা সেবা খাতে তা ক্রমে বেড়েই চলছে। আবার আলোচনায়, পর্যালোচনায় কিংবা টকশোতেও এই কৃষি খাত তেমন কোন গুরুত্ব পাচ্ছে তা বলা যাবে না কেবলমাত্র চ্যানেল আইয়ের কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান হৃদয়ে মাটি ও মানুষ ছাড়া। আরও মজার ব্যাপার যে বর্তমান অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) কৃষি খাতে বরাদ্দ সবচেয়ে কম অর্থাৎ ৫ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা যেখানে পরিবহন খাতে রয়েছে সর্বোচ্চ ৩৭ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা। বিশিষ্ট জার্মান অর্থনীতিবিদ জোসেফ সুমপিটার বহু বছর আগে বলেছিলেন শিল্পায়ন হলো একটি ক্রিয়েটিভ ডেস্ট্রাকশন বা ভাঙ্গাগড়ার প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কম সম্ভাবনাময় খাত থেকে বেশি সম্ভাবনাময় যাতে সম্পদের পুনর্বন্টন ঘটে থাকে। এই সমাজবিজ্ঞানীর সুর ধরে বলা যায় বাংলাদেশে কৃষি একটি সম্ভাবনাময় খাত হওয়া সত্ত্বেও সম্পদের বণ্টনে তা সর্বনি¤েœ রয়েছে যা অনেকটা অবহেলারই শামিল যার ফলে বর্তমানে কৃষিতে প্রবৃদ্ধির হার নেমে এসেছে ২.৬ শতাংশে যা ২০০৯-২০১০ সালে ছিল ৬.১৫৬ শতাংশ। কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হার নিম্নমুখী হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শস্য খাত যার প্রমাণ চাল উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়া। বিবিএসের তথ্য মতে ২০১৭ সালে আউশ, আমন ও বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি বিশেষত সিলেটের হাওড় অঞ্চলে অকাল বন্যা এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্লাস্ট রোগের কারণে। ফলে দেশের চাহিদার তুলনায় চাল উৎপাদন না হওয়ায় চালের আমদানিনির্ভরতা এখন নিত্যদিনের সঙ্গী যদিও সরকারের ভ্রান্ত নীতির কারণে ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে যেখানে চালের আমদানি দাঁড়িয়েছিল ১৪ লাখ ৯০ হাজার টন সেখানে পরের বছরই তা নেমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৫৭ হাজার টন বিশেষত চাল আমদানির ওপর শুল্কের হার ১০ থেকে ১৫ শতাংশে উন্নীত করার জন্য। ফলে দেশের কম-বেশি ৮০ শতাংশ মানুষের প্রধান খাদ্য মোটা চালের দাম প্রতি কেজি ৫০-৫২ টাকা হলে যা সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে দেয়। আবার বর্তমান বছরে দেশে মোট চালের আমদানি বত্রিশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে দাঁড়ায় অথচ বিশ্বের ৪র্থ চাল উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম চাল আমদানি কারক দেশ হিসেবে পরিণত হয়েছে। এই গেল শস্য খাতে চাল উৎপাদন ও বিতরণের কথা। কিন্তু সার্বিক সামষ্টিক অর্থনীতির বিবেচনায় কৃষি অর্থনীতি এখনও অর্থনীতির সিংহভাগ সেখান থেকে কাঁচামাল সরবরাহ হয়ে শিল্প উৎসাহিত হয় এবং উৎপাদনের সরাসরি ভূমিকা রাখে যা খাদ্যপণ্য কিংবা ভোগ্যপণ্য উভয়েই হতে পারে। আবার কৃষি এখনও ৪২.৭ শতাংশ শ্রমশক্তির নিয়োজনের একটি নির্ভরযোগ্য ক্ষেত্র। আবার শিল্পে জিডিপি বাড়লেও কর্মসংস্থান সে হারে বাড়ছে না ফলে তত্ত্ববিদদের যে ধারণা ছিল কৃষির বাড়তি শ্রমিক শিল্পখাতে নিয়োজিত হবে তা মিলছে না অথচ কৃষিতেও কর্মসংস্থান বাড়ছে। আবার জমির স্বল্পতার কারণে প্রান্তিক ক্ষুদ্র শ্রেণীর কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে তারাই এখন দেশের খাদ্য নিরাপত্তার একমাত্র ভরসাস্থল যারা এক খন্ড জমিকে আঁকড়িয়ে ধরে পরে থাকে। তাদের জমিতে যথাযথ প্রযুক্তির উপস্থিতির ঘটালে এবং কর্মসংস্থান বাড়ালে তা টেকসই কৃষি উৎপাদন ও দারিদ্র্য বান্দব হবে। এখানে খাদ্যের বাজার দর কম থাকলে কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির জন্য চাপ কম থাকবে এবং শিল্প লাভজনক হবে। বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশের মোট গ্রামীণ শ্রমশক্তির শতকরা ১১ ভাগ কৃষি শ্রমিকে রয়েছে যাদের বয়স ত্রিশের উর্ধে এবং সনাতনী ধারণায় স্বল্প কিংবা না শিক্ষিত। তাহলে কি এ যুগের শিক্ষিত তরুণরা কৃষিতে আসবেই না? অবশ্য আসবে যদি তাদের নতুন কৃষির ধ্যান-ধারণায় উদ্বুদ্ধ করা যায় যা হবে আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক নতুন শস্য সম্ভাবে আবর্তিত এক রফতানিমুখী শিল্প যেখানে তরুণ শ্রমশক্তি হবে উদ্যোক্তা। অতি সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ২০১৮ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন কোন এলাকায় কৃষি পণ্যের উৎপাদন বেশি হলে সেখানেই কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তুলতে হবে এবং দেশের প্রত্যেকটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প স্থাপন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, কৃষি পর্যায়ক্রমে শিল্পেও উন্নীত হবে কাঁচামাল সরবরাহের মাধ্যমে। আর ক্ষুদামুক্ত ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ে তুলতে কৃষিই হবে মূল চালিকাশক্তি। এই অবস্থ্য়া কৃষিকে টেকসই করতে সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য বিমোচনের স্বার্থে যেমন : এক. পানি ও মাটি কৃষির প্রাণ। পানি ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধিতে মাঠ পর্যায়ের কার্যকর হতে হবে। কারণ প্রাকৃতিক পানির ওপর নির্ভর করে আধুনিক কৃষি সম্ভব নয়। এখন আমাদের পানির উৎস যেমন খাল-বিল-নদী-নালা এগুলো এখন আর পূর্বেকার অবস্থায় নেই বিধায় বর্ষার মৌসুমে পানি প্রবাহ থেকে সংরক্ষণ করে সুষ্ক মৌসুমে তা ব্যবহারের জন্য পানি ধারণের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন যা বর্তমানে অনুপস্থিত রয়েছে। আবার পানি চুক্তি যেমন : তিস্তা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে রয়েছে যার কারণে তিস্তা পারের কৃষি তথা এর উপর ভিত্তি করে বসতিদের জীবনজীবিকা ভিষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার ভূগর্ভস্থ পানি অনেকাংশে ব্যয় বহুল কিছু যান্ত্রিক কারণে তা অনেক ক্ষেত্রে প্রাপ্তিতে ভাটা আছে যার সমাধান প্রয়োজন। দুই. মাটির উর্বরতা শক্তি শস্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে এবং এর একটি সমতা আনয়নের লক্ষ্যে জৈব কৃষির প্রচলন জরুরী যা বর্তমানে অনেকটা হুমকির সম্মুখীন রয়েছে : তৃতীয়ত. বর্তমানে দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে হাওড় বেষ্টিত ছয়টি জেলায় ফসল রক্ষায় বাঁধগুলো কাঠামোগতভাবে খুবই দুর্বল হওয়ায় আগাম পানির তোরে অনায়াসেই প্লাবিত হয়ে বোর ফসল হানি ঘটায় যার প্রমাণ গত বছরের বোর ফসলের বিপর্যয়। বর্তমান বছরেও একি সমস্যা রয়েছে যা প্রকৌশলীদের দুর্নীতির কারণে বাঁধ নির্মাণের ক্রুটিই এর অন্যতম কারণ যার সমাধান জরুরী; চতুর্থত: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শীতের প্রকোপ ও উষ্ণ আবহাওয়া সহনশীল জাত উদ্ভাবনের প্রয়োজন রয়েছে। আবার লবণাক্ত সহিষ্ণ জাতের ধানের প্রচলন সমুদ্র উপকলবর্তী জেলাগুলোতে ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে; পঞ্চমত. বর্তমান বছরের বাজেটে কৃষি খাতের অংশ মোট বাজেটের মাত্র ৬.১ শতাংশ যার একটি বৃহৎ অংশ কৃষি ভর্তুকিতে চলে যাবে। ফলে উন্নয়ন খাতে তেন কিছু থাকে না। তা ছাড়াও স্বাভাবিক ভর্তুকির অতিরিক্ত হিসেবে কৃষিজাত সামগ্রী রফতানির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা হারে ছাড় প্রদান, কৃষি যান্ত্রিককরণের উন্নয়ন সহায়তার হার হাওড় ও দক্ষিণাঞ্চলের জন্য ৭ শতাংশ করা ইত্যাদি বলবত রয়েছে। এই বিষয়গুলো টেকসই কৃষি উন্নয়নের মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলোর ব্যাপারে প্রতিকারমূলক ও প্রাকৃতিক কারণগুলোর মোকাবেলায় উপযুক্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তা হলেই টেকসই উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হবে। লেখক : অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
×