ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

উন্নয়নশীল দেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২৪ মার্চ ২০১৮

উন্নয়নশীল দেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ

আর স্বল্পোন্নত বা অনুন্নত নয়, এখন থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের অপ্রতিরোধ্য কাতারে স্থান করে নিয়েছে। এক সময় যারা বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে উপহাস করেছিল তারাই এখন বলছে অমিত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। পিতা স্বপ্ন দেখেছিলেন ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলার, কন্যা তা গড়ে তুলেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করলে বহু আগেই বাংলাদেশ উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হতো। মানুষ খেয়ে-পরে সুখে-শান্তিতে থাকত। তা হতে পারেনি। ওরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে মানুষের ভাগ্যের চাকা থামিয়ে দিয়েছিল। তারপরও বাংলাদেশ থেমে থাকেনি, এগিয়ে চলেছে উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে। এবারের স্বাধীনতার মাসে আমাদের দুটি অর্জন সাধিত হয়েছে- ১. ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যের দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, অর্থাৎ এ ধরনের যে সব প্রামাণ্য দলিল যে সব memory of the world international রেজিস্ট্রারে অন্তর্ভুক্ত করা হয় সে তালিকায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইউনেস্কোর যে উপদেষ্টা কমিটি এ মনোনয়ন দিয়েছে সেই কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের ন্যাশনাল আরকাইভের মহাপরিচালক ড. আবদুল্লাহ আলবাইসি। ইউনেস্কোর সদর দফতর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে যে ১৪ জন উপদেষ্টা কমিটির সদস্য অংশ নেন তারা সবাই এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে মিলিটারি জিয়াসহ যারা ভাষণটিকে মুছে দিতে চেয়েছিল ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি তাদের গালে কড়া চপেটাঘাত করল। ২. গত ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি দিল জাতিসংঘ। ১৭ মার্চ ১৯২০ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন এবং ঘোষণাটিও এলো বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে। অর্থ ও বহিঃসম্পদ মন্ত্রণালয় এ উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপী আনন্দোৎসবের আয়োজন করেছে। বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে উৎসবের উদ্বোধনকালে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা এক পর্যায়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু লন্ডন যান। তখন তিনি ইতালিতে স্বামীর কাছে ছিলেন এবং সেখান থেকে লন্ডন যান। বঙ্গবন্ধু লন্ডন শহরের সাজানো-গোছানো এলাকা পরিদর্শন করে বলেছিলেন, একদিন বাংলাদেশও এমন গোছানো হবে। আজ আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে সকল মানুষকে ঘর করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু দেখে যেতে পারলেন না- এই বলে শেখ হাসিনা কয়েক সেকেন্ড নীরব থাকেন এবং চোখের জল মোচেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে স্বৈরশাসক মিলিটারি জিয়া ৬ বছর দেশে আসতে দেয়নি। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ শেখ হাসিনা স্বামী ড. এম ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে জার্মানিতে থাকায় প্রাণে বেঁচে গেলেও বিদেশে দুঃসহ জীবনযাপন করেন। মিলিটারি শাসক জিয়া তাদের দেশে আসার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। ৬ বছর পর ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করে এবং শেখ হাসিনা সকল বাধা অতিক্রম করে ওই বছর ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন। শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। তিনি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ছাত্র রাজনীতি করেছেন। ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে তিনি ইডেন কলেজ ছাত্রী সংসদের ভিপিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুকন্যা হিসেবে তিনি রাজনীতির সঙ্গে বড় হয়েছেন। তাই শুরুতেই মিলিটারি জিয়ার সামরিক স্বৈরতন্ত্রের মোকাবেলা করেছেন সাহসের সঙ্গে। মিলিটারি এরশাদেরও মোকাবেলা করেছেন এবং দীর্ঘ একুশ বছর লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে পুনরায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় আনেন। ক্ষমতায় বসেই জিয়া-এরশাদ-খালেদার ধ্বংসের হাত থেকে বাঙালী জাতির অস্তিত্ব পুনরুদ্ধারে কাজ শুরু করেন। কিন্তু ২০০১ সালে আমেরিকার তোলা গ্যাস ভারতের কাছে বিক্রির নিশ্চয়তা না দেয়ায় বা অস্বীকার করায় তাদের চক্রান্তে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেননি। সঙ্গে সঙ্গে খালেদা জিয়ার ফ্যাসিস্ট শাসনে পড়েন এবং দেশকে আবার সাম্প্রদায়িক জঙ্গী রাষ্ট্রে পরিণত করেন। বাংলা ভাই-ইংলিশ ভাইরা মানুষ হত্যা শুরু করে। নৌকায় ভোট দেয়ার দায়ে (?) সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও সাধারণ মানুষ জানমাল হারাতে শুরু করে। বিএনপি-জামায়াতের জঙ্গী সন্ত্রাসীরা দেশে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। শেখ হাসিনা আবারও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং খালেদা জিয়া ও মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারকে উৎখাত করে পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন ২০০৯ সালে। এবার তার রাজনৈতিক অঙ্গীকার অনুযায়ী প্রথমে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেন। একই সঙ্গে জাতীয় চার নেতার হত্যারও বিচার করেন। এরপর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। অনেক বড় বড় শক্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, সাকা চৌধুরী, মীর কাশেম আলীসহ ভয়ঙ্কর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে দেশকে পাপমুক্ত করার পথে এগিয়ে চলেছেন। ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে সমাবেশ চলাকালে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তাকেসহ দলকে নেতৃত্ব শূন্য করার চক্রান্ত চলে। ২০ বার তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি, বোমা হামলাসহ নানাভাবে আক্রমণ চালানো হয়। আল্লাহর রহমতে তিনি বেঁচে যান এবং জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের সঙ্গে সঙ্গে গরিব-দুঃখী মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেন এবং বাংলাদেশ গরিব বা স্বল্পোন্নত দেশের গলিপথ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মহাসড়কে হাঁটতে শুরু করে। একটি স্বল্পোন্নত দেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে হলে তাকে তিনটি প্রশ্নে সক্ষমতা প্রমাণ করতে হবে- ১. মাথাপিছু জাতীয় আয় ২. মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ৩. অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা নিরসন। এই তিনটি বিষয় বিবেচনা করেই একটি স্বল্পোন্নত দেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে দাঁড়াতে পারে। অন্তত উপরোক্ত তিনটির মধ্যে দুটি সূচক পূরণ করতে হয়। বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশুগলোর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম তিনটির মধ্যে সব ক’টি সূচকই পূরণ করেছে এবং উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে মহাসড়কে যাত্রা শুরু করল। সূচকগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে : বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে রফতানির চিন্তা করছে । জিডিপি বছর বছর ৭ প্লাস-মাইনাস, এবার ৭ পয়েন্ট ২৮ আশা করা হচ্ছে। মাথাপিছু আয় এখন ১৬১০ মার্কিন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গড় আয়ু ৭২ বছর। শিক্ষার হার ৭১%। গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্য ক্লিনিক। বিদ্যুত উৎপাদন সক্ষমতা ১৬০০০ মেগাওয়াট। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ। প্যারা সি পোর্ট নির্মাণ। কর্ণফুলী টার্নেল নির্মাণ। মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। শাক-সবজিতে তৃতীয়। গার্মেন্টস রফতানিতে দ্বিতীয়। আইনী প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি দমন। জিরো টলারেন্সের মাধ্যমে জঙ্গী দমন। জিরো টলারেন্সের মাধ্যমে মাদক নিয়ন্ত্রণ। এভাবে বাংলাদেশ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এক ঈর্ষণীয় অগ্রগতি লাভ করেছে। এগিয়ে চলেছে। বৃহস্পতিবার উৎসবস্থলে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধনে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জাইকাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানানো হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন পেশার পক্ষ থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়। ইতোপূর্বে রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কটের সমাধানে তার মানবিকতা বিশ্বব্যাপী প্রশংসা অর্জন করে এবং তাতে Mother of humanity, star of the east, champions of the earth এমনি অনেক দুর্লভ সম্মানে ভূষিত করা হয়। বিশ্ব তার পাশে এসে দাঁড়ায়। তবে কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়াও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কিছু বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছিল, সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবে কী? কিছু বুদ্ধির ফেরিওয়ালা এরই মধ্যে এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। বিষয়টি এমন যেন ভিক্ষা বন্ধ হয়ে যাবে বলে আয়-রোজগার করব না! একটি ঘটনা মনে পড়ে। তখন মিলিটারি জিয়া ও খালেদা জিয়ার অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান। পার্লামেন্টে খাদ্য ঘাটতি নিয়ে আলোচনা চলছিল। সদস্যদের আলোচনার প্রেক্ষিতে বক্তব্য প্রদানকালে সাইফুর রহমান বলেছিলেন, ‘দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা যাবে না। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে বিদেশী সাহায্য বন্ধ হয়ে যাবে।’ অর্থাৎ খাদ্যেও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা যাবে না, দেশকে অর্থনৈতিকভাবেও এগিয়ে নেয়া যাবে না, ভাবখানা এমনই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বক্তব্য, যে জাতি যুদ্ধ করে, বিরাট ত্যাগ স্বীকার করে দেশ স্বাধীন করেছে, সে জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই, আমরা দাঁড়াবই, এগিয়ে যাবেই বাংলাদেশ। এখানেই শেখ হাসিনার শ্রেষ্ঠত্ব আর তাই উন্নয়নশীলতার ঐতিহাসিক অর্জন আজ বাংলার ঘরে ঘরে। ঢাকা ॥ ২২ মার্চ, ২০১৮ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×