ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শত শত শোকার্ত মানুষের সামনে আরও ৩ জনকে শেষ বিদায়

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ২৪ মার্চ ২০১৮

শত শত শোকার্ত মানুষের সামনে আরও ৩ জনকে শেষ বিদায়

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে শুক্রবার রাজশাহীর বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম, খুলনার আলিফুজ্জামান আলিফ ও বরিশালের পিয়াস রায়কে শেষ বিদায় জানানো হয়। নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শত শত শোকার্ত মানুষের সামনে তাদের দাফন এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। শুক্রবার রাজশাহীতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলামকে। সবাইকে শোকসাগরে ভাসিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হয় আলিফুজ্জামান আলিফ এবং বরিশালে চোখের জলে সিক্ত করে শেষ বিদায় জানানো হয় পিয়াস রায়কে। প্রতিটি মরদেহ সৎকার করার সময় এলাকায় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এ সময় শোকের ছায়া নেমে আসে। -খবর স্টাফ রিপোর্টারদের পাঠানো- রাজশাহী থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলামকে রাজশাহীতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়েছে। শুক্রবার জুমার নামাজের পর রাজশাহী মহানগরীর গোরহাঙ্গা কবরস্থানে স্ত্রীর কবরের পাশে দাফন করা হয় তাকে। নিহত নজরুল ইসলাম নগরীর উপশহর এলাকার বাসিন্দা। বিমান দুর্ঘটনায় তার স্ত্রী আক্তারা বেগমও নিহত হন। লাশ দেশে আসার পর গত মঙ্গলবার দাফন করা হয় স্ত্রীকে। তবে মরদেহ শনাক্তে জটিলতার কারণে নেপাল থেকে নজরুল ইসলামের লাশ আসে বৃহস্পতিবার বিকেলে। এরপর প্রথমে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলায় গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। শুক্রবার সকাল ১০টায় সেখানে নজরুল ইসলামের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর লাশ রাজশাহী এনে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে গোরহাঙ্গা কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। উপশহর ক্রীড়া সংঘের মাঠে অনুষ্ঠিত জানাজা নামাজে রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরকার, জেলা প্রশাসক এসএম আবদুল কাদের বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু, মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন, মহানগর ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি লিয়াকত আলী লিকুসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ অংশ নেন। দুপুরে ওই মাঠে নজরুলের লাশ নেয়ার পর শোকাবহ হয়ে ওঠে এলাকার পরিবেশ। স্বজনদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে। কফিন ছুয়ে অনেকেই শেষ বিদায় জানান মুক্তিযোদ্ধা নজরুলকে। পরে পুলিশের একটি দল তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। নজরুল ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তার স্ত্রী আক্তারা বেগম ছিলেন রাজশাহী সরকারী মহিলা কলেজের শিক্ষক। বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হাসান ইমাম ও নজরুল ইসলাম দুই বন্ধু ছিলেন। এই দুই বন্ধু তাদের স্ত্রীদের নিয়ে যাচ্ছিলেন নেপাল বেড়াতে। কিন্তু নেপালের মাটিতে পা রাখার আগেই বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন তারা। হাসান ইমামের স্ত্রীর নাম বেগম হুরুন নাহার ওরফে বিলকিস বানু। এই দম্পতি নগরীর শিরোইল এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। নেপালে বিধ্বস্ত হওয়া ইউএস-বাংলার ওই বিমানে রাজশাহীর তিন দম্পতিসহ মোট সাতজন ছিলেন। অন্য তিনজন হলেনÑ রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইমরানা কবির হাসি, তার স্বামী রকিবুল হাসান ও নগরীর নওদাপাড়া এলাকার গোলাম কিবরিয়ার নিউইয়র্ক প্রবাসী মেয়ে বিলকিস আরা মিতু। রাজশাহীর এই সাতজনের মধ্যে বেঁচে আছেন শুধু হাসি। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা চলছে তার। হাসির হাতের কয়েকটি আঙ্গুল কেটে ফেলতে হয়েছে বলে জানা গেছে। আর নিহত হাসান, তার স্ত্রী বিলকিস ও মিতুকে দাফন করা হয়েছে ঢাকায়। রকিবুলের মরদেহ দাফন করা হয়েছে তার গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার বাগুটিয়া গ্রামে। শোকসাগরে ভাসিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত আলিফ ॥ খুলনা অফিস জানায়, খুলনার আলিফুজ্জামান আলিফের (৩২) মরদেহ নিজ গ্রাম রূপসা উপজেলার আইচগাতী ইউনিয়নের বারো পুণ্যের মোড় এলাকার বাড়িতে পৌঁছায় শুক্রবার ভোর রাতে। এরপর আলিফের মা-বাবাসহ আত্মীয়-স্বজনের কান্না ও অহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে এলাকার পরিবেশ। মরদেহ বাড়িতে পৌঁছানোর পর থেকে অসংখ্য স্বজন শুভানুধ্যায়ী আলিফদের বাড়িতে আসেন। পরিবারে সদস্য ও স্বজনদের কান্নায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। বাদ জুমা রূপসার আইচগাতী ইউনিয়নের বেলফুলিয়া ইসলামিয়া হাইস্কুল মাঠে আলিফুজ্জামানের নামাজের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে হাজারও মানুষের চোখের পানিতে তাকে চির বিদায় জানানো হয়। স্থানীয় রাজাপুর মাদ্রাসা সংলগ্ন কবরস্থানে তার মরদেহ দাফন করা হয়। প্রিয় মা-বাবা, ভাই ও আত্মীয়-স্বজনদের শোকসাগরে ভাসিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন তিনি। মরহুম আলিফের জানাজায় রাজনৈতিক ব্যক্তি, প্রশাসনের কর্মকর্তা, আত্মীয়-স্বজন, শুভাকাক্সক্ষী, প্রতিবেশীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার অসংখ্য মানুষ অংশ নেন। জানাজায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেখ হারুনুর রশিদ, জেলা বিএনপির সভাপতি এ্যাডভোকেট শফিকুল আলম মনা, আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডভোকেট সুজিত অধিকারী, কামরুজ্জামান জামাল, আক্তারুজ্জামান বাবুল, স্থানীয় আইচগাতী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যন অধ্যাপক আমরাফুজ্জামান বাবুল, সাবেক চেয়ারম্যান খান জুলফিকার আলী জুলু, খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আরাফাত হোসেন পল্টু, বর্তমান সভাপতি পারভেজ হাওলাদার, সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন প্রমুখ। আলিফের খালু মোঃ ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে আলিফুজ্জামান, নজরুল ইসলাম ও পিয়াস রায়ের মরদেহবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের বিজি ০৭২ নামে একটি ফ্লাইট শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে। পরে বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে আলিফুজ্জামানের বড় ভাই আশিকুর রহমান হামিম ও তার স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল। খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মোঃ আরাফাত হোসেন পল্টু জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে আলিফের প্রথম নামাজের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে আলিফের মরদেহবাহী এ্যাম্বুলেন্স শুক্রবার ভোররাত ৪টা ২০ মিনিটে পৌঁছায় বাড়িতে। শুক্রবার বাদ জুমা দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে আলিফের লাশের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত অলিফুজ্জামান আলিফ খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও বঙ্গবন্ধু ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন। খুলনার সরকারী বিএল কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স পরীক্ষা দিচ্ছিলেন তিনি। ৩ ভাইয়ের মধ্যে আলিফুজ্জামান ছিলেন দ্বিতীয়। তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা মোল্লা আসাদুজ্জামান। চোখের জলে পিয়াসকে বিদায় ॥ বরিশাল থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, শেষবারের মতো বাকরুদ্ধ অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জানালো পিয়াস রায়ের স্কুলজীবনের শিক্ষক ও সহপাঠীরা। শুক্রবার সকাল আটটায় মরদেহবাহী ফ্রিজিং গাড়িতে করে পিয়াসের মরদেহ আনা হয় বরিশাল জিলা স্কুল মাঠে। এর আগে রাত তিনটায় পিয়াসের মরদেহ নগরীর গফুর লেনের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এরপর থেকেই পিয়াসের মা-বাবাসহ স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। একমাত্র সন্তানের কফিন জাপটে ধরে বিলাপ করে কাঁদতে থাকেন পিয়াসের মা স্কুল শিক্ষিকা পূর্ণা রানী রায়। শোকাবহ সেই বাড়িতে ধর্মীয় আচার পালন শেষে সকাল পৌনে আটটায় জিলা স্কুল মাঠে গাড়িটি পৌঁছলে কফিন দেখেই কাঁদতে থাকেন শিক্ষক ও সহপাঠীরা। মরদেহবাহী গাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের সহপাঠীরা কফিনটি নামিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বিদ্যালয়ের প্যারেড প্রাউন্ডে রাখেন। পরে সেখানে ফুল দিয়ে শেষশ্রদ্ধা জানান বরিশাল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মুহাম্মদ জিয়াউল হক সহ পিয়াসের সহপাঠী ও শিক্ষকরা। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে পিয়াস রায়ের মরদেহ দুপুর দেড়টায় বরিশালের মহাশ্মশানে নিয়ে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। পিয়াসের স্কুলজীবনের সহপাঠী ইভান জানান, পিয়াসের সঙ্গে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের সঙ্গে ছিল মধুর সম্পর্ক। পড়াশোনার পাশাপাশি বিতর্ক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিভিন্ন ক্ষেত্র ছিল পিয়াসের দখলে। ২০১০ সালে পিয়াস বরিশাল জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সফলতার সহিত ভাল ফলাফল অর্জন করে। বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, পিয়াস সুন্দর আচার-ব্যবহারের অধিকারী ছিল। তার এভাবে চলে যাওয়া কোনভাবেই মেনে নিতে পারছি না। আমরা তার এ মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত। ১২ দিন পর লাশ হয়ে ফিরল ॥ ১২ দিন পর নিজ বাড়িতে ফিরে এসেছেন পিয়াস রায়। তবে পায়ে হেঁটে কিংবা গাড়িতে করে নয়; কফিনবন্দী হয়ে থাকা পিয়াসের নিথর মরদেহ এসেছে। বিদেশ ভ্রমণে যাওয়ার আগে মা পূর্ণা রানী মিস্ত্রী লঞ্চঘাটে দিয়ে এসেছিলেন একমাত্র পুত্র সন্তান পিয়াস রায়কে। মা যার সঙ্গে হেঁটে গিয়ে লঞ্চে তুলে দিয়ে এসেছিলেন। সেই টগবগে যুবক ছেলেকে বাবা বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে নিয়ে এসেছেন কফিনে করে। রাত তিনটায় যখন গোটা বরিশাল শহরে পিনপতন নিস্তব্ধতা। ঠিক তখন পিয়াস রায়কে বহনকারী গাড়িটি সাইরেন বাতি জ্বালিয়ে প্রবেশ করে শহরে। গফুর লেনের বাড়ির সামনে লাশবাহী গাড়িটি পৌঁছামাত্র স্বজন ও প্রতিবেশীদের আহাজারিতে ওই এলাকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। পিয়াসের একমাত্র ছোট বোনের জামাতা হিমাদ্রি সরকার সুসময় জানান, ঢাকা থেকে পিয়াস রায়ের মরদেহ বুঝে নেয়ার পর সহপাঠী ও শিক্ষকদের অনুরোধে রাত ১২টার দিকে পিয়াসের মরদেহ প্রথম নেয়া হয় গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাসে। সেখানে পিয়াস রায়কে শেষ বিদায় জানায় তার সহপাঠী ও শিক্ষকরা।
×