ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দশ দিনের ব্যবধানে বাবা-মা হারিয়ে ছেলে মাহি এখন নির্বাক, শোকস্তব্ধ

ক্যাপ্টেন আবিদের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন স্ত্রী আফসানা

প্রকাশিত: ০৪:৫৭, ২৪ মার্চ ২০১৮

ক্যাপ্টেন আবিদের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন স্ত্রী আফসানা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাবা ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান ক’দিন আগে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। বাবার শোকে মা আফসানা খানম টপিও চলে গেলেন। মাত্র ১০ দিনের ব্যবধান, বাবা-মাকে হারিয়ে একমাত্র সন্তান তামজিদ সুলতান মাহি (১৪) এখন নির্বাক নিস্তব্ধ। আফসানার মরদেহ বাসায় আনার পর স্বজনদের কান্নায় উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের আবিদের বাড়ির পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। দুর্ঘটনায় স্বামীর মৃত্যুর খবরে ‘স্ট্রোকে’ আক্রান্ত হলে রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস এ্যান্ড হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছিল আফসানাকে। সেখানে ৬ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে শুক্রবার সকালে সাড়ে নয়টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এরপর বিকেল পাঁচটা ১৩ মিনিটে উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে গাউছুল আজম জামে মসজিদে আফসানার নামাজের জানাজা হয়। পরে বনানী সামরিক কবরস্থানে স্বামী ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতানকে কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন আফসানা খানম টপি। আফসানার চাচা ইয়াদ আলী জানান, শুক্রবার ভোরেই আমরা জানতে পারি ওর (আফসানার) অবস্থা খারাপের দিকে। আমরা আসতে আসতে ওর অর্গানগুলো অকার্যকর হতে থাকে। পরে সাড়ে নয়টায় মারা যায়। এ সময় হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক বদরুল আলম জানান, আমরা সম্ভব সব চেষ্টাই করেছি। কিন্তু আজ সকালেও উনার কার্ডিয়াক এ্যারেস্ট হয়। এরপর আর কিছু করার ছিল না। এ দিকে আফসানার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে স্বজনরা হাসপাতালে ছুটে এলে সেখানে এক আবেগঘন হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। দুপুরে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় আবিদ-আফসানার উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের বাসায়। আফসানা খানমের ফুফাত ভাই খন্দকার রেজাউল করিম জানান, বাবা-মাকে হারিয়ে মাহি একবারে নিশ্চুপ হয়ে গেছে। কাঁদলে মন হাল্কা হতো। তিনি জানান, আবিদের মৃত্যুর সংবাদ পেয়েও তার স্ত্রী আফসানা কাঁদেনি। একেবারে শোকস্তব্ধ হয়ে যায়। সেই শোকে আফসানা স্ট্রোক করেন। সে সময় মায়ের পাশে মাহি ঘুমিয়ে ছিল। অনেকক্ষণ মায়ের সাড়া শব্দ না পেয়ে চিৎকার করে মাহি। এরপর উত্তরায় বাংলাদেশ মেডিক্যাল হাসপাতালে নেয়া হয় টপিকে। সেখান থেকে নেয়া হয় শেরে বাংলা নগরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স এ্যান্ড হাসপাতালে। তিনি জানান, প্রথমে বাবা আবিদ সুলতানের মৃত্যুর সংবাদ। এরপর সবকিছু ছাপিয়ে স্বামীর কাছে চলে গেলেন আফসানা। এখন মা-বাবা হারা তাদের একমাত্র সন্তান মাহিকে নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়েছে। আফসানার ফুফাত ভাই ইঞ্জিনিয়ার শাহিনুর রহমান শাহিন জানান, বৃহস্পতিবার হাসপাতালের তৃতীয় তলায় আইসিইউ বিভাগের নিচে ডাক্তারের চেম্বারে রাখা হয়েছিল মাহিকে। রাতেও হাসপাতালে ছিল মাহি। মায়ের খোঁজ খবর রেখেছে। শুক্রবার ভোরে বাসায় চলে যায় মাহি। কিন্তু সাড়ে নয়টার দিকে তার মা আফসানার মৃত্যু হয়। সাড়ে ১০টায় দুঃসংবাদটি জানান হয় মাহিকে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে মাহি। কোনভাবে বোঝান যাচ্ছে না। বারবার মায়ের কাছে যেতে চাইছে। শাহিন জানান, একটা ছেলে যার বাবার পর মাও এক সপ্তাহের ব্যবধানে মারা গেল তার মনের অবস্থাটা বুঝুন। আমরা সবাই ওকে সহযোগিতা করব। আপনারা ওর জন্য দোয়া করবেন। দেশবাসীর কাছে অনুরোধ আবিদ-আফসানাকে জান্নাত কামনায় দোয়া করবেন। মাহি যেন শোক কাটিয়ে শক্ত হতে পারে সেজন্য দোয়া কামনা করছি। সকালে হাসপাতালে আবিদ সুলতানের ছোট ভাই ডাক্তার খুরশিদ মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, সবার প্রতি অনুরোধ মাহিকে একা থাকতে দিন। ওর ওপর দিয়ে ঝড় যাচ্ছে। আমাদের স্বপ্ন ও দুশ্চিন্তা সব এখন ওকে ঘিরেই। এর আগে সকালের দিকে হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার, ডাক্তার কাজী ইকরাম হোসেন জানান, হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন আফসানা। তার চিকিৎসা ও সুস্থতার জন্য হাসপাতাল থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল জানিয়ে তিনি জানান, আবিদ সুলতানের ভাই ও আফসানার বাবার উপস্থিতিতে আফসানার মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। ইউএস-বাংলার একটি উড়োজাহাজ গত ১২ মার্চ কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হলে ২৮ বাংলাদেশীসহ ৫১ জনের মৃত্যু হয়। ওই ফ্লাইটের প্রধান বৈমানিক ছিলেন বিমান বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা আবিদ সুলতান। ওই দুর্ঘটনায় নিহত ২৩ জনের মরদেহ রবিবার দেশে ফিরিয়ে এনে আর্মি স্টেডিয়ামে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মাকে হাসপাতালে রেখে সেদিন বাবার লাশ নিতে বনানীতে যায় উত্তরার মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ‘ও’ লেভেলের ছাত্র মাহি। ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র আবিদ সুলতান একসময় বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের বৈমানিক ছিলেন। তার বাবা এমএ কাশেমও ছিলেন বৈমানিক। গ্রামের বাড়ি নওগাঁর রানীনগরে। পাঁচ হাজার ঘণ্টা ফ্লাইট চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল আবিদের। নেপালের বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত ড্যাশ ৮-কিউ ৪০০ এয়ারক্র্যাফটটি ক্যাপ্টেন তিনিই কানাডা থেকে বাংলাদেশে উড়িয়ে এনেছিলেন। আর তার স্ত্রী আফসানার গ্রামের বাড়ি নাটোরে। তার বাবা এ কাশেম শেখ একজন চিকিৎসক। ছেলেকে নিয়ে তারা থাকতেন উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর সড়কের ৩৮ নম্বর বাসায়। কাঠমান্ডুর ত্রিভুবনে দুর্ঘটনার দিন ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, ক্যাপ্টেন আবিদ আহত অবস্থায় হাসপাতালে আছেন। কিন্তু পরদিন সকালে তারা আবিদের মৃত্যুর খবর দিলে ভেঙ্গে পড়েন আফসানা। আবিদের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু জানান, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে প্রথম মৃত্যু সংবাদটি শুনে কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ভাবী আফসানা খানম। অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। পরে তিনি বেঁচে আছেন জেনে একটু স্বাভাবিক হন। কিন্তু পরদিন যখন জানতে পারলেন উনি মারা গেছেন। তারপর থেকে তিনি একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছিলেন। আসলে এত বড় শোক সহ্য করতে পারেননি। রবিবার সকালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে উত্তরা একটি ক্লিনিকে নেয়া হয়। নিউরোসায়েন্সে আনার পর আফসানা খানমের মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধায় আলামত খুঁজে পান চিকিৎসকরা। একটি মেডিক্যাল বোর্ডের সিদ্ধান্তে সহযোগী অধ্যাপক সিরাজী শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে ১০ সদস্যসের মেডিক্যাল বোর্ড আফসানা খানমের অস্ত্রোপচার হয় ওই দিনই। কিন্তু অবস্থার অবনতি হলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। ৬ দিন লাইফ সাফর্টে থাকার পর (শুক্রবার) সকালে ভাবী আফসানার মৃত্যু হয়।
×