ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আজ বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস

দেশে বছরে প্রতি লাখে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে ২২১ জন

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ২৪ মার্চ ২০১৮

দেশে বছরে প্রতি লাখে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে ২২১ জন

নিখিল মানখিন ॥ দেশে যক্ষ্মা চিকিৎসার ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য আশাব্যঞ্জক হলেও ডায়াগনসিস সংক্রান্ত জটিলতার কারণে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বা এমডিআর নিয়ন্ত্রণ এখনও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ঝুঁকি মোকাবেলা ও যক্ষ্মামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এই কর্মসূচীর মাধ্যমে রোগনির্ণয়ের হার প্রতি এক লাখ জনসংখ্যায় ৭৭ জন এবং আরোগ্যের হার ৯৫ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল টিবি রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে বছরে প্রতি লাখে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে ২২১ জন, মৃত্যু হচ্ছে ৪০ জনের। বাংলাদেশে এখনও যক্ষ্মা একটি মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ শনিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বে প্রতি সেকেন্ডে একজন যক্ষ্মার জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়। বর্তমানে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ জনগণ যক্ষ্মার জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত। তবে নিয়মিত পূর্ণ মেয়াদের চিকিৎসায় যক্ষ্মা সম্পূর্ণ ভাল হয়। তিন সপ্তাহের বেশি কাশি যক্ষ্মার প্রধান লক্ষণ। অবহেলা না করে কফ পরীক্ষা করাতে হবে। বিশেষজ্ঞরা জানান, যক্ষ্মা একটি সংক্রামক রোগ, যা মাইকোব্যাটেরিয়াম টিউবার-কুলোসিস নামক অতি সুক্ষ জীবাণুর মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। প্রধানত ফুসফুসই যক্ষ্মা জীবাণু দ্বারা সর্বাধক আক্রান্ত হয়। যক্ষ্মা জীবাণু দেহের অন্য অংশকেও আক্রান্ত করে যক্ষ্মা রোগ তৈরি করতে পারে। ফুসফুসের যক্ষ্মায় আক্রান্ত কফে জীবাণুযুক্ত রোগী যদি বিনা চিকিৎসায় থাকে, তবে বছরে প্রায় ১০ থেকে ১৫ জন লোককে যক্ষ্মার জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত করে। জীবাণু দ্বারা সকল সংক্রমিত ব্যক্তিই যক্ষ্মা রোগে ভুগে না। যে সকল ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তারাই প্রধানত যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়। তাই প্রতিটি রোগীর দ্রুত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা শেষ করা জাতীয়, আঞ্চলিক ও বিশ্বের যক্ষ্মা প্রতিরোধের অন্যতম শ্র্রেষ্ঠ উপায়। বিশ্বে প্রতিবছর ৮.৮ মিলিয়নের বেশি লোক যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আর প্রতিবছর ১.৪ মিলিয়ন লোক প্রতিবছর যক্ষ্মায় মারা যায়। ২২টি দেশে বিশ্বের মোট যক্ষ্মা রোগীর শতকরা ৮০ ভাগ বাস করে। মোট যক্ষ্মা রোগীর শতকরা ৪০ ভাগ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে বাস করে। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীর বিশেষজ্ঞরা জানান, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে এ সময়ে প্রধান চ্যালেঞ্জ ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বা এমডিআর যক্ষ্মা। এমডিআর যক্ষ্মার অন্যতম প্রধান কারণ যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীর অনিয়মিত ওষুধ সেবন। এমডিআর যক্ষ্মার ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক বেশি। এর চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী, জটিল ও ব্যয়বহুল। এছাড়া যক্ষ্মা রোগ নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে শিশু যক্ষ্মা শনাক্তকরণে জটিলতা, নগরে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের সমস্যা ও এইচআইভি যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে চ্যালেঞ্জ। শনাক্তকরণে জটিলতা শিশু যক্ষ্মার ক্ষেত্রে এখনও প্রধান চ্যালেঞ্জ। এছাড়া সংক্রমণের ইতিহাস সঠিকভাবে জানা যায় না। অনেক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিকল থাকে এক্সরে মেশিন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যক্ষ্মা শনাক্ত যন্ত্র জিন এক্সপার্টের অভাব রয়েছে। চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা থাকে না। জনসচেতনতারও অনেক অভাব লক্ষ্য করা যায়। এসব কারণে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে শিশু যক্ষ্মা রোগীর শনাক্তের হার অনেক কম। তবে অধিক জনসংখ্যা ও বসতির কারণে ঢাকায় শিশু যক্ষ্মা রোগী তুলনামূলক বেশি। স্বাস্থ্য অধিদফতর ও জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী জানায়, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে অন্যান্য যক্ষ্মারোগীসহ শিশু যক্ষ্মা রোগীর শনাক্তকরণ বেড়েছে। যক্ষ্মা শনাক্তকরণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে এই সংখ্যা বেশি চিহ্নিত হয়েছে। ২০১৫ সালে যেখানে শিশু যক্ষ্মা রোগী ছিল ৮,১০৪ জন, সেখানে ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯,২৯১ জনে। শতকরা হিসেবে ২০১৬ সালে শিশু যক্ষ্মা শনাক্তের হার ৪.৩ শতাংশ। ২০১৫ সালে এই হার ছিল ৪ শতাংশ। শিশুসহ ২০১৬ সালে দেশে শনাক্তকৃত মোট যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা ২,২৩,৯২২ জন। এরমধ্যে ওষুধ প্রতিরোধী বা এমডিআর যক্ষ্মারোগীর সংখ্যা ৯৭০০ জন। ২০১৬ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল টিবি রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রতি লাখে যক্ষ্মার কারণে মৃত্যু হয় ৪৫ জনের। প্রতিবছর প্রতি লাখে নতুন যক্ষ্মারোগী শনাক্ত হচ্ছে ২২৫ জন। কফে জীবাণুযুক্ত ফুসফুসের যক্ষ্মা চিকিৎসার সাফল্যের হার ৯৪ শতাংশ। ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা চিকিৎসার সাফল্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আরও অগ্রগামী। এক্ষেত্রে বিশ্বে যেখানে সাফল্যের হার ৫২ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে সাফল্যের হার ৭০ শতাংশ। এই রোগ নির্মূল করতে ২০৩৫ সালে যক্ষ্মায় মৃত্যুর হার ৯৫ শতাংশ ও প্রকোপের হার ৯০ শতাংশ কমিয়ে আনতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীর সঙ্গে ব্র্যাকসহ ২৭টি বেসরকারী সংস্থা সমন্বিতভাবে কাজ করছে। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীর (এনটিপি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে এনটিপির মাধ্যমে দেশে ২ লাখ ৪৪ হাজার ২০১ জন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে এবং চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু যক্ষ্মারোগী শনাক্ত হয়েছে ১০ হাজার ১৮৯ জন। দেশে এখন চরমভাবে ওষুধ প্রতিরোধী রোগীর সংখ্যা ১২ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে প্রতিবছর প্রতি লাখে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে ২২১ জন, মৃত্যু হচ্ছে ৪০ জনের। অধ্যাপক ডাঃ সামিউল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে যক্ষ্মা নির্ণয় ও নিরাময়ের ক্ষেত্রে যে সাফল্য অর্জন করেছে, তা জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীরই সাফল্য। এই কর্মসূচীর মাধ্যমে রোগ নির্ণয়ের হার প্রতি এক লাখ জনসংখ্যায় ৭৭ জন এবং আরোগ্যের হার ৯৫ শতাংশ। তিনি বলেন, এত সাফল্য সত্ত্বেও বিশ্বে যক্ষ্মার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এ ঝুঁকি মোকাবেলা ও যক্ষ্মামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। ব্র্যাকের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীর কর্মকর্তা ড. মোঃ আকরামুল ইসলাম জানান, দেশে যক্ষ্মা চিকিৎসার ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য আশাব্যঞ্জক হলেও ডায়াগনসিস সংক্রান্ত জটিলতার কারণে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বা এমডিআর নিয়ন্ত্রণ এখনও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। এখনও এ ধরনের রোগীদের আনুমানিক ৮০ শতাংশই শনাক্তের বাইরে থাকছেন। আর সকল ধরনের যক্ষ্মায় চিকিৎসার আওতা বহির্ভূত থাকছেন ৩৩ শতাংশ রোগী। তবে শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে সমস্যা থাকলেও জীবাণুযুক্ত ফুসফুসের যক্ষ্মার চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাফল্যের হার ৯৫ শতাংশ যা সন্তোষজনক।
×