ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কাঁকন বিবির চলে যাওয়া

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ২৪ মার্চ ২০১৮

কাঁকন বিবির চলে যাওয়া

সুনামগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবি ২১ মার্চ সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে ১০৩ বছর বয়সে মারা যান। মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী সময়গুলোতে তার ভূমিকা ছিল বিচিত্রমুখী। হানাদার বাহিনী কর্তৃক ধৃত হয়ে অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার হওয়া কাঁকন বিবি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেও স্বাধীনতার যুদ্ধে তার ভূমিকাকে অম্লান করেছেন। শুধু তাই নয়, মুক্তির লড়াইয়ে বীর সেনানীদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামেও নেমেছিলেন তিনি। কাঁকন বিবি, জন্মসূত্রে যার পারিবারিক নাম কাকাত হেনিনচিতা। নামই জানিয়ে দেয় তিনি নির্ভেজাল বাঙালী নন। কোন এক নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের কন্যাসন্তান। আসলে তার পৈত্রিক বাড়ি ভারতের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে এক প্রত্যন্ত গ্রামে। পরে তারা অভিবাসী হয়ে সিলেটের সুনামগঞ্জে বসতি স্থাপন করে। খাসিয়া উপজাতি বংশোদ্ভূত এই কাঁকন বিবি ১৯৭০ সালে দিরাই উপজেলার শহীদ আলীর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। এই সংসারে একটি কন্যা সন্তানের জননী হন তিনি। তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্ব। প্রথম স্বামীর সঙ্গে তার বিচ্ছিন্নতা শুরু হয় কন্যা সন্তানের কারণেই। এরপর এপ্রিল মাসে ইপিআর সৈনিক মজিদ খানের সঙ্গে কাঁকনের বিয়ে হয়। তখন মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে দুঃসময়। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্যাতন আর নিপীড়নের সঙ্গে সারাদেশে যে তা-ব শুরু হয়ে যায় তার প্রত্যক্ষ আঁচ এসে লাগে উপজাতি থেকে বাঙালী জাতিতে প্রবেশ করা এই কাঁকন বিবির গায়ে। কারণ, পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সে বিষয়েই ইঙ্গিত প্রদান করে। এক সময় তার দ্বিতীয় স্বামীও নিরুদ্ধেশ হলে সে তার খোঁজে দোয়ারাবাজার সীমান্ত এলাকায় চলে আসে শিশুকন্যা সখিনাকে নিয়ে। ১৯৭১ সালের জুন মাসে তিনি পাকিস্তানী সামরিক জান্তা দ্বারা আটক হয়ে তাদের কোপানলে পড়েন। কয়েকদিন পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে পরবর্তীতে ছাড়াও পান। রাগে, অপমানে, প্রতিহিংসায় কাঁকন বিবি তখন দিশাহারা । স্বামীর আশা ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার চেতনায় উদ্দীপ্ত হন। সেই বোধে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়েও পড়েন। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন হলে তার ওপর দায়িত্ব পড়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর তথ্য সরবরাহের কাজে। তিনি সময়মতো মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সব ধরনের তথ্য পৌঁছে দিতেন। তার সাহসিক মনোবলে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক গুপ্ত খবর জেনে যেতেন। এর দামও আবার কাঁকন বিবিকে দিতে হয়। তিনি পুনরায় পাকিস্তানী সেনাদের কাছে ধরা পড়েন। এবারও নির্যাতন আর অত্যাচার থেকে রেহাই পাননি তিনি। সেখান থেকেও এক সময় তার মুক্তি মেলে। বাংলাবাজারে এসে অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষিত হন। পরবর্তীতে গুপ্তচরবৃত্তি তো করেনই, যেন সম্মুখ সমরে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে অস্ত্রও ধরতেন। তার শরীরে সেই যুদ্ধের গুলির চিহ্ন শেষদিন অবধি ছিল। ধারণা করা হয়, তিনি প্রায় ২০টি সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তবে তার এই বীরত্বের কাহিনী লোক সম্মুখে আসতে অনেক দেরি হয়ে যায়। স্বাধীনতার প্রায় ২৫ বছর পরে অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে স্থানীয় এক সাংবাদিকের সহযোগিতায় তিনি মুক্তিযোদ্ধার কাতারে মানুষের সামনে হাজির হন। ১৯৯৭ সালে তাকে সেই স্বীকৃতি দেয়া হলেও তিনি জীবদ্দশায় তা ভোগ করে যেতে পারেননি। তার একমাত্র সন্তান সখিনা তিন কন্যা সন্তান নিয়ে অসহায় জীবনযাপন করছে। মৃত মুক্তিযোদ্ধা মায়ের প্রাপ্য অধিকার যদি তার সন্তানকে ফিরিয়ে দেয়া যায়, তাহলে জাতি ঋণমুক্ত হবে।
×