ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আলী যাকের

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৭:৩৮, ২৩ মার্চ ২০১৮

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

(পূর্ব প্রকাশের পর) বাংলাদেশকে ভালবাসা এবং জীবনানন্দ দাশ এক সময় সমার্থক মনে হতো আমার কাছে। সেই যে : তোমার যেখানে সাধ চলে যাও, কোথাও চলিয়া যাব, অশ্বত্থে সন্ধ্যার হাওয়া, এই জল ভাল লাগে অথবা ভেবে ভেবে ব্যথা পাব এগুলো তো একসময় নিত্যসঙ্গী ছিল আমাদের। রূপসী বাংলা বুকের কাছে ধরে কত দুপুর কাটিয়েছি বাংলার গ্রামগঞ্জে বট, অশ্বত্থ কিংবা পাকুড়গাছের তলায়। এই কথাগুলো লিখতে লিখতে মনে হলো বোধহয় বাঙালী হয়ে জন্ম নেয়ার সবচেয়ে বড় লাভ আবেগের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ হতে পারাটা। এত আপন করে তাকে জানা। এই যে, মনের ব্যাপার স্যাপার এগুলোকে ছেড়ে কোথাও বাঁচতে পারতাম না, বাঁচতে পারব না আমি। আমার কাছে বড় প্রিয় হচ্ছে ঘুরে বেড়ানো। তবে আমি বহির্বিশ্বে ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে নিজের চেনা দেশটার সর্বত্র ঘুরে বেড়ানোতে সবসময় অনেক বেশি আনন্দ পেয়েছি। পাঠক বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, একবার প্রাচুর্যময় নিউইয়র্ক শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফিফ্থ এ্যাভিনিউ দিয়ে হাঁটছি। বাঁয়ে সুদৃশ্য সব অট্টালিকা আর ডানে সেন্ট্রাল পার্ক অথচ আমার মন পড়ে আছে আমার আদি গ্রাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রতনপুরে। এক সময় মনে হলো কি করছি এখানে আমি? মনে পড়ে সেবার দেশে ফিরেই ছুটেছিলাম নিজ গ্রামে। আমি নিতান্তই পূর্ববঙ্গের এক বঙ্গজ সন্তান কিন্তু দক্ষিণ, পশ্চিম এবং উত্তর বাংলাদেশের ভিন্নতা আমার চোখে স্পষ্ট ধরা পড়ে। একটা সময় ছিল যখন এসব আঞ্চলিক বৈচিত্র্য দেখার জন্য বেরিয়ে পড়তাম। ভরা গ্রীষ্মের নিদাঘে দিনাজপুরের পুনর্ভবা নদীর পাড়ে বিস্তীর্ণ বালুকাবেলা এবং ধূলিঝড় আজও আমার মনকে উদ্বেলিত করে তোলে। ঠিক একইভাবে আমাকে আকর্ষণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের শ্যামল সবুজ পাহাড়িয়া অঞ্চল। মন আর্দ্র হয়ে যায় : “আমি যে দেখিতে চাই, Ñ আমি যে বসিতে চাই বাংলার ঘাসে; পৃথিবীর পথে ঘুরে বহুদিন অনেক বেদনা প্রাণে সয়ে।” আমার এই দেশ দেখার তাড়না আমাকে বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র নিয়ে গেছে এখন, তখন। আমার স্মৃতিতে এই ধরনের অনেক ভ্রমণের গল্প গাঁথা রয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আমি নিত্যই ঢাকা থেকে খুলনা সপ্তাহান্তে যাওয়া-আসা করতাম। সেই সময় এই পথ পাড়ি দিতে চারটে ফেরি পার হতে হতো। এগুলো ছিল সাভারে নয়ারহাট, মানিকগঞ্জের তরাঘাট, আরিচা-গোয়ালন্দ এবং ঢাকা-খুলনা সংযোগস্থলে কামারখালী। মনে পড়ে শুক্রবার দিন বিকেলে অফিস শেষ করে বেরিয়ে পড়তাম আমার সেই ফোক্স ওয়াগন গাড়ি নিয়ে। টুক টুক করে পৌঁছে যেতাম খুলনায় আমার বোনের বাসায়। সেই বাল্যকাল থেকেই খুলনার প্রতি আমার এক ধরনের আকর্ষণ ছিল। বাবা দীর্ঘদিন খুলনায় চাকরি করেছেন। সেই সময় মা এবং দিদির হাত ধরে গোটা শহর ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার প্রথম সিনেমা দেখা ওই শহরেই শুরু, নীলা সিনেমা হলে। হলটির নাম এখন হয়েছে পিক্সচার প্যালেস। খুলনায় ‘মাখা’ বলে এক ধরনের সন্দেশ পাওয়া যেত। ওটাই মুঠোবন্দী হয়ে নাম হতো কাঁচাগোল্লা। অসাধারণ স্বাদ! মিষ্টি বর্জিত এই জীবনে সেই স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। রূপসা নদীর ধারে কত সন্ধ্যা কাটিয়েছি তার হিসেব নেই আমার কাছে। এর ওপরে বোনের আদর যতœ তো ছিলই। সাপ্তাহিক ছুটি শেষ করে রোববার সন্ধ্যায় ফের রওনা হতাম ঢাকার পথে। ঢাকায় পৌঁছতে পৌঁছতে অনেক সময় রাত শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু দ্বিগুণ উদ্দীপনা নিয়ে আবার কাজকর্ম শুরু করেছি সোমবার সকালে। ঢাকার কাছাকাছি বন্ধুবান্ধব নিয়ে বেড়ানো হতো প্রায়ই। আরিচাঘাটে একটা ডাক বাংলো ছিল পদ্মার ধারে। সেখানে একাধিক রাত কেটেছে আমাদের। অতি প্রত্যুষে নৌকা নিয়ে পদ্মার চরে পৌঁছে গেছি। সেই দৃশ্য যে কী সুন্দর তা কথায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়! ওই পদ্মা-যমুনার ধারে ধারে হাঁটবার অভিজ্ঞতা হয়েছিল আরও অনেক পরে মুক্তিযুদ্ধ শেষে যখন ঢাকায় ফিরছিলাম তখন। কোন দিন স্বদেশে ফিরব কিনা তার কোন নিশ্চয়তা ছিল না। যুদ্ধ জয়ের পরে সদ্য স্বাধীন দেশে ফেরার যে আনন্দ তা আরও অনেকগুণ স্বাদু হয়ে উঠেছিল বাংলার গ্রামের মধ্য দিয়ে পথ চলায়। বাংলার মুক্ত বাতাস সবুজ ধানের ক্ষেত, পদ্মার জলের বয়ে যাওয়ার শব্দ সবকিছু মিলে মিশে এক ভূস্বর্গ রচনা করেছিল আমাদের জন্য। অনেকটা অতিশয়োক্তির মতো শোনালেও এ কথা অনস্বীকার্য যে আমি যখনই কাজে বা অকাজে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাই, এক নতুন জীবন যেন লাভ করি। ঢাকায় এক নাগাড়ে কয়েক সপ্তাহ কাটালে আমার আবার গ্রামের পথে নেমে পড়তে ইচ্ছে হয়। প্রচুর স্মৃতি রয়েছে আমার এই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণের। একবার সত্তরের নির্বাচনের পর পর বেরিয়ে পড়েছিলাম উত্তরবঙ্গের দিকে। তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কর, খাজনা আদায় বন্ধ ছিল। বন্ধ ছিল সব গণপরিবহন। রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছিল। যুদ্ধ সমাসন্ন টের পাচ্ছিলাম নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে। রবীন্দ্র সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ সন্জীদা খাতুন, আমাদের মিনু আপা, তখন পড়াতেন রংপুরের কারমাইকেল কলেজে। অনেক চেষ্টা করেও তিনি ঢাকা আসতে পারছিলেন না। ওই সময়ে এক সকালে আমরা আমার ভাঙাচোরা গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রংপুরের উদ্দেশে। সেই রাতটা রংপুরেই কাটল। পরের দিন মিনু আপাকে গোছগাছ করতে বলে বেরিয়ে পড়লাম দিনাজপুরের উদ্দেশে। দিনাজপুরে কোন কাজ ছিল না। কিন্তু এত লম্বা রাস্তা গাড়ি চালিয়ে উত্তরবঙ্গে যখন এসেছি তখন এই সুযোগের সদ্বব্যবহার না করে মন চাইছিল না যে ঘরে ফিরি। দিনাজপুরের পথে যাওয়ার সময় একটা গ্রামের চায়ের দোকানে যাত্রা বিরতি দিলাম। এক অশীতিপর বৃদ্ধ একা দোকানটায় বসে ছিলেন। আমরা চা খেতে খেতে তাঁর সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলাম। কথায় কথায় তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি গত নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন কিনা। জবাবে তিনি বলেছিলেন যে তিনি একা নন, তাঁর গ্রামের সকল ভোটারকে যোগাড় যন্ত্র করে নিয়ে এসে নৌকায় ভোট দিয়েছিলেন। স্বভাবতই আমার কৌতূহল হলো। জানতে চাইলাম কেন নৌকায় ভোট দিয়েছেন। তিনি বললেন, “কেন দিব না? আমি এই দোকানে বসেছিলাম আরও অনেক অনেক লোকের সঙ্গে। শেখের বেটা গাড়ি দিয়ে এই পথে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে গাড়ি থামিয়ে এসে আমার দু’হাত ধরে বলল, বাবা আমাকে দোয়া করবেন। এর আগে আমাকে এমন তো কেউ বলেনি?” বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি এবং সাধারণ মানুষের প্রতি বিশ্বাসের কথা এর আগে প্রচুর শুনেছি। এই বৃদ্ধের কথায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল। দিনাজপুরের রামসাগরে আধাবেলা কাটালাম। তারপর পুনর্ভবা নদীর তীরে এক গ্রাম্য চায়ের দোকানে বনরুটি আর কলা দিয়ে দুপুরের লাঞ্চ সারলাম। অতঃপর আবার পড়ন্ত বিকেলে রংপুর হয়ে ঢাকায় ফেরা। (চলবে)
×