ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

জোয়ারে জলের যৌবন ও করতলে জীবনের জলপান

প্রকাশিত: ০৭:৩১, ২৩ মার্চ ২০১৮

জোয়ারে জলের যৌবন ও করতলে জীবনের জলপান

হারুন উর রশীদের লেখা দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায় ২০১৮ সালের ভাষার মাসে। ‘জোয়ারে জলের যৌবন’ এবং ‘করতলে জীবনের জলপান’ গ্রন্থদ্বয়ের প্রকাশনায় গণ প্রকাশন এবং প্রচ্ছদ এঁকেছেন তাজ মোহাম্মদ। ১৪ লাইনের কাব্যিক অনুভব দিয়ে গোছানো ‘জোয়ারে জলের যৌবন’ বইটিতে কবিতার সংখ্যা ৬৪টি। বইটির শিরোনাম নির্দেশ করে উন্মত্ত যৌবনের এক স্বাপ্নিক আবহে সৃজন দ্যোতনাকে রাঙিয়ে দেয়া। যেখানে প্রেমের নিমগ্নতা থেকে শুরু করে ষড়ঋতুর লীলা বৈচিত্র্য তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়ানো প্রকৃতির কোলে লালিত মানুষের নিত্য জীবন প্রবাহ। ভালবাসার মাদকতায় শরীর ও মনের যে গভীর তাড়না তাও মুগ্ধ কবি চিত্তকে নানামাত্রিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। প্রাত্যহিক জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দে আর বিষাদের হরেক রকম অনুভব সেটাকেও কবিতার অনুষঙ্গ করে পাঠকের কাছে নিয়ে আসার যে শৈল্পিক সুষমায় কবি নিমগ্ন সেখানে তিনি একজন যথার্থ-নির্মাতার জায়গায় অভিষিক্ত হন। কবিতা ব্যক্তিক অনুভূতি, সামাজিক দায়বদ্ধতা, প্রকৃতির অপার সম্ভাবনায় নিজেকে একীভূত করা সব মিলিয়ে এক নিরবচ্ছিন্ন নান্দনিক বোধ। যে ঋদ্ধ চেতনা কবিকে সচেতন করে পারিপার্শ্বিক বলয়ে তার সৃষ্টির মহিমাকে এগিয়ে দেয়। ¯িœগ্ধ, সুশোভিত, নদী¯œাত বাংলাদেশের নৈসর্গিক এবং বৈষয়িক সম্ভার যেমন কবিকে প্রাণিত করে একইভাবে দেশাত্মবোধের আদর্শিক চেতনায়ও কবিতাগুচ্ছ ভিন্ন মাত্রায় পাঠকের কাছে চলে আসে। যা সত্যিই মুগ্ধ বিস্ময়ে অভিভূত হওয়ার মতোই। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট যে নির্মম ঘটনা সারা বাংলাকে শিহরিত করে কবিও সেই রক্তাক্ত অনুভবে আপন সৃষ্টির আলয় গড়ে তোলেন। সহজ বোধ্য, সাবলীল ও সুস্পষ্ট শব্দ চয়নের যে কাব্যিক মহিমা তাতে কবি নির্বিঘেœ পাঠকের কাছে নিজের জায়গা তৈরি করতে সময় নেন না। এই এক অন্যমাত্রার শৌর্য যা কবিতার মূল সারবত্তাকেও স্বচ্ছ-পরিচ্ছন্নভাবে বিধৃত করে। অতি সাধারণ শব্দ শৈলীতে নির্মিত কবিতার পঙ্ক্তিমালা পাঠককে ভাবের মূল চেতনায় আকর্ষিত করতে নির্ণয়কের ভূমিকা পালন করে। হারুন উর রশীদের অন্য কবিতার বই ‘করতলে জীবনের জয়গান’ ভাষা সংগ্রামী, গবেষক আহমেদ রফিককে উৎসর্গ করা। গ্রন্থটির নামের মধ্যেই প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে বিষয়ের মূল বার্তা, গতিনির্ণয় এবং কাব্যিক অনুভবে কবির বিপ্লবী মনস্তত্ত্ব। ২০১৩-১৪ সালে লেখা কবিতাগুলো তৎকালীন সামাজিক অস্থিরতার এক বিক্ষুব্ধ সময়কে পাঠকের কাছে নিয়ে আসে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তুমুল আন্দোলনের বহির্প্রকাশে গণজাগরণ মঞ্চের নব-উত্থান। যা পুরো জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ভয়াল নয় মাসের তিক্ততা নতুনভাবে জাগিয়ে তোলে। মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সঙ্গত কারণে তার কবিতার উপজীব্য হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, বিদ্রোহী চেতনায় তার কাব্যিকবোধও আলোড়িত হয়। মানবিক বোধের অবক্ষয়ে তার সৃজনদ্যোতনা পরিশুদ্ধ হয়। সময়ের নির্ভীক পথিক হিসেবে কবি যে মাত্রায় তার কবিতার নান্দনিকতায় একাত্ম হয়ে যান সেখানেও তার শব্দের গঠনশৈলী পাঠককে নানামাত্রিকে মুগ্ধ করে। প্রতিটি কবিতায় আছে বিদ্রোহ আর বিপ্লবের শাণিত বাণী। সেই বোধে ১ মের শ্রমিক আন্দোলনও কবিচিত্তকে উত্তাল করে দেয়। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে অসহায়, নির্বিত্ত কৃষক ও শ্রমজীবীর যে নিরন্তর ভোগান্তি আর বঞ্চনা সেই বোধও কবিতার মর্মমূলে আঘাত করে। অসাম্য, বৈষম্যপীড়িত আর্থ-সামাজিক বলয়ে নিরীহ, হতদরিদ্র মানুষের যে দৈন্যতার চিত্র তাও কবি হৃদয়কে ক্ষুব্ধ আর প্রতিবাদী করে তোলে। যে প্রতিরোধে ঝঙ্কৃৃত হয় কবিতার অস্থির শব্দমালা, বিষয়ে গেঁথে যায় দ্রোহের গর্জন। কবিতাগুলো বিক্ষুব্ধ বাক্যবাণে উদ্দীপ্ত হয়ে এক অদ্ভুত শৈল্পিক দ্যোতনায় সৃষ্টির মূল আবহকে অম্লান করতে প্রত্যয়ী। এখানেও শব্দ চয়নের কোন বাহুল্য কিংবা আড়ম্বর নেই। সহজ, প্রচলিত এবং সাধারণ শব্দের সমাহারে কবিতাগুলোর আঙ্গিক ও মূল ভাবের কোন বিচ্যুতি ঘটায় না। শুধু তাই নয় কবিসত্তার সাবলীল পথ চলায় কাব্যিক শৌর্য যেভাবে নির্মিত হয় একইভাবে পাঠক সমাজও বৈপ্লবিক বোধে কবিতার অনুগামী হতে সময় নেবে না। কাব্যগ্রন্থ দুটি পাঠককে আনন্দ দেবে এই আশা ব্যক্ত করে বইগুলোর বহুল প্রচার কামনা করছি।
×