ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বেড়াতে বেলফাস্টে

প্রকাশিত: ০৭:৩১, ২৩ মার্চ ২০১৮

বেড়াতে বেলফাস্টে

নর্দান আয়ারল্যান্ডের রাজধানী বেলফাস্ট ছোট ছিমছাম গোছান এবং বেশ পরিপাটি নগরী। শহরের প্রাণকেন্দ্র ডোনেগাল স্কয়ারে রয়েছে বেলফাস্ট সিটি হল; যা ঘিরে এই শহরের বাণিজ্যের বিস্তার ঘটেছে। মূলত ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে যখন রানী ভিক্টোরিয়া বেলফাস্টকে নগরের মর্যাদা দিতে রাজি হন তখনই বেলফাস্টে এ রকম একটি ইমারত নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। সেই থেকে এই সিটি হলকে কেন্দ্রবিন্দু করে শহরের বিস্তৃতি ঘটছে। ফেব্রুয়ারির হিমেল এক সন্ধ্যায় বেলফাস্টের আকাশে থাকতেই ভিন্ন রকম এক অভ্যর্থনায় অবতরণ করলাম সেখানে। আবহাওয়া বৈরি হওয়ায় গ্লাসগোর আকাশ থেকে বেলফাস্টে ছুটে যাওয়া বিমান বেশ একচোট ঝাঁকুনির সম্মুখীন হলো। বিমানের বহির্গমন দরজা ডিঙিয়ে বাইরে চোখ মেলতেই দেখি ঝুম বৃষ্টি ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সারা শরীর! বেলফাস্ট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শহরকেন্দ্র থেকে খানিকটা দূরে, তাই বিমানবন্দর থেকে শহরে যেতে নির্ধারিত ৩০০ নম্বর ডাবল ডেকার বাসের উপরিতলে চড়ে কমলা রঙের সড়ক বাতিতে রাতের বেলফাস্টের শহরতলীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে মূল শহরে প্রবেশ করতে বেশি বেগ পেতে হলো না। ইতোমধ্যে নগরে চারিধার কালো করে রাত নেমে আসায় আর শীতের প্রকোপ বাড়ায় সে রাতে আর বেশি না ঘুরে বরং আগে থেকে ঠিক করে রাখা হোটেলে ব্যাগ কোনমতে রেখে পেটপুজো সারতে প্রথমেই ম্যাকডোনাল্ডসের খোঁজে পথে নেমে পড়া। সেখান থেকে ফিরে শহরটাকে ঈষৎ দেখে নিয়ে সোজা নিজেকে বিছানায় চালান করে দেয়া। যুক্তরাজ্যের এই তীব্র শীত উপেক্ষা করে বেলফাস্ট যাত্রা করা হয়েছিল মূলত আমার বৃত্তিপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানটি সেখানকার রাজনৈতিক ম্যুরাল (দেয়াল চিত্র) দেখার ব্যবস্থা করায়। ভ্রমণের পয়লা দিন তাই কাটলো শহর ঘুরে ঘুরে নানা জায়গায় বিভিন্ন রাজনৈতিক বার্তা নিয়ে আঁকা ম্যুরাল দেখে দেখে আর পড়ন্ত বেলায় রানীর নামে তৈরি কুইন্স’স বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে সে সম্পর্কে লেকচার শুনে। বেলফাস্ট শহরে দেখার মতো বেশকিছু স্থান থাকলেও পর্যটকদের মূল আকর্ষণ কিন্তু সেই প্রকৃতিকে ঘিরেই। মূল শহর থেকে প্রায় ঘণ্টা তিনেকের পথ পাড়ি দিয়ে ক্যারিক-এ-রেড রজ্জু ব্রিজ আর দৈত্যাকার বাঁধ (জায়ান্ট কসওয়ে) দেখাতে। যেহেতু শীতের এই সময়টায় স্বল্প দিবালোককে সঙ্গী করে সাগরের নীল আর পাহাড়ের সবুজে হাবুডুবু খেতে শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে যাওয়া লাগবে, তাই সকাল সকাল উঠে সে পানে পর্যটক বাস ধরতে রওনা দিলেও বাস শহরকেন্দ্র থেকে চলা শুরু করল নির্ধারিত সময় মেনে ঘড়ির কাঁটা সকাল দশটার ঘর স্পর্শ করলে তবে। যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই শহর ছেড়ে কিছুটা বেরোতেই যেয়ে হাজির হলাম বেলফাস্ট হ্রদের পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যারিক ফারগুস ক্যাসেলে। শীতের বেলা ক্ষণস্থায়ী হওয়ায় চালক কাম ট্যুর গাইডের কাছ থেকে ক্যাসেলের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি মিললো না; বেঁধে দেয়া সময়ে তাই ক্যাসেলের একপাশ ধরে হেঁটে প্রবেশমুখ দেখে হাল্কা হাঁটাহাঁটি চলল হ্রদের পাড় ধরে। সকালের সোনাঝরা মিষ্টি কোমল রোদ চিকচিক করে হ্রদের নীল শান্ত ঢেউয়ের মিলিয়ে যাচ্ছিল। তবে রোদ থাকলে কী হবে? শীতের হিমেল বাতাসের সঙ্গে দাপটে পাল্লা দিয়ে পেরে উঠছিল না সে! ক্যাসেল আর হ্রদ দেখা শেষে বাস শাঁ শাঁ করে ছুটে চলল দর্শনার্থীদের বেলফাস্টের বিখ্যাত রজ্জু নির্মিত সেতুতে চড়াতে। পুরো ভ্রমণের আসল সৌন্দর্যযে এই যাত্রা পথেই লুকিয়ে আছে, তা কি আর বুঝতে পেরেছি পথ ফুরনোর আগে? যাত্রা পথে মনে হয়েছে অন্যবারের মতো এই বুঝি খানিক পরে আবার ড্রাইভার নামিয়ে দেবে কোনখানে। আগে যদি জানতাম আড়াই ঘণ্টার এ স্বর্গযাত্রা নিরবচ্ছিন্নভাবে চলবে তবে নিশ্চয় উপভোগের মাত্রা ভিন্ন রকম হতো। স্বর্গযাত্রা বলছি এই কারণে যে পথের সে নৈসর্গ কেবল কথামালা দিয়ে বর্ণনা করা যায় না। চলতি পথের একপাশে উত্তর আটলান্টিকের ঢেউ এসে উপচে পড়ছে আর অন্যপাশে সবুজ শৈল অটল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে আমাদের চলার পথ বুঝি সমুদ্র আর পাহাড়ের মাঝখানে সূক্ষ্ম এক বিভেদ রেখা টেনে দিয়েছে। পাহাড়ের সঙ্গে সাগরকন্যার মিলনের বাঁধা হয়ে ঠিক তাদের মাঝ বরাবর যেন ভিলেন হয়ে অসীমে বয়ে চলেছে গাড়ি চলাচলের এই সরু পথখানি। একবার চোখবুজে চিন্তা করুন, আপনি চলেছেন কোন বাসের জানালার পাশের সিটের সওয়ার হয়ে; আপনার হাতের একপাশ দিয়ে এসে আপনাকে ছুঁতে ছুঁতে না ছোঁয়া সফেদ ফেনা তোলা ঢেউয়ের পর ঢেউয়েরা এসে বাড়ি খাচ্ছে সাগর তটে আর ওদিকে অন্যপাশে দৃঢ়-অটলভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে উঁচু-নিচু ঢেউ খেলানো সবুজের সমারোহ মিশানো শৈল! সাগরের নীল জলরাশি যে ওই দূর থেকে ঢেউ তুলে গর্জন তুলে আসতে আসতে তীরে এসে সফেদ ফেনা হয়ে যাচ্ছে, তা দেখেই তো কাটিয়ে দেয়া যায় বাকিটা জীবন! তাই তো মনে হলো শহরে সেই একই বাড়িঘর, দোকান-পাট দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে উঠলেও সাগরের এই অপার সৌন্দর্যে মজে ঢেউ পর অসংখ্য ঢেউ গুনলেও হয়ত একঘেয়েমি আসবে না কখনও। অপার সুন্দরের পসরা সাজানো এমনি চমৎকার রাস্তা ধরে আমাদের বাসের চালক এগিয়ে চলছিল গন্তব্যে আর থেকে থেকে জানিয়ে দিচ্ছিল বিশেষ কিছু স্থানের বিশেষত্ব। সেসবের মধ্যে অন্যতম ছিল গেম অব থরন্সের শূটিং স্পটসমূহ। এরই মধ্যে হঠাৎ করে সবাই লক্ষ্য করল আমাদের সেদিন স্বাগত জানাতে আকাশে বর্ণিল রামধনুরও দেখা মিলেছে! রংধনু থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে চোখে পড়লো ভেড়ার দল সবুজ ঘাসে ভরা মাঠ চরাচ্ছে। আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু পথ ধরে যেতে যেতে আর ঢেউয়ের আকৃতির পাহাড় দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল আমরাও বুঝি ঢেউ খাচ্ছি একই সঙ্গে বাসে বসে। পাহাড়ের কোথাও কোথাও ঘন সবুজ আবার কোথাও ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে এই শীতে। এসব দেখতে দেখতে কিভাবে যেন আড়াই ঘণ্টা পেরিয়ে চলে আসলাম ক্যারিক-এ-রেড রোপ ব্রিজের কাছে। যেখানে বাস পার্ক করল সেখান থেকে ব্রিজে চড়তে কমপক্ষে পনেরো মিনিট হাঁটা লাগবে। তবে বাসে থাকতেই চালক যেহেতু সেতুর ছবি দেখিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল সম্পূর্ণ রজ্জুর তৈরি এই সেতু ঝুলছে দুই পাহাড়ের মদ্দিখানে একেবারে সাগরের উপরে; তাই যথেষ্ট সাহস না থাকলে বাড়তি পাউন্ড খরচ না করে সেতুতে ওঠার টিকিত না কাটতে। তাই বাস থেকে নামার পরপরই কিছুটা উত্তেজিত ছিলাম নিজের প্রবল উচ্চতাভীতি নিয়ে সে সেতু পাড়ি দিতে। সবুজে ছাওয়া উঁচু-নিচু পাহাড় চোখে পড়ছিল দূর থেকেই, পাহাড়ের এক খণ্ড আবার নিচু হয়ে নেমে গেছে উত্তর আটলান্টিকের পেটের ভেতরে। ছোট ছোট ঢেউ মাঝ দরিয়া থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে আছড়ে পড়ছে তীরে। নীল জলরাশির মধ্যে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট কিছু দ্বীপ আর এই তীর থেকে ঠিক পঁচিশ মাইল দূরে বুক চিতিয়ে শুয়ে রয়েছে প্রকাণ্ড দ্বীপ এক। এসব দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেলাম ব্রিজে ওঠার প্রান্তে। দুই পারে দাঁড়িয়ে থাকা দুই রক্ষী নিয়ম করে গুণে গুণে পারাপারের যাত্রী এই দড়ির ব্রিজে ওঠাচ্ছে দেখে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম এই ভেবে যে সাগরে পড়ে গেলেও অন্তত উদ্ধার করার প্রশিক্ষিত লোক পাওয়া যাবে। রোপ ব্রিজ মূলত জেলেরা মাছ ধরার সুবিধার্তে বহু বছর আগে নির্মাণ করলেও এখন তা পরিণত হয়েছে বেলফাস্টের পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর আদল বদলালেও রোমাঞ্চ একই রকম রয়েছে বলেই মনে হল। না হলে মাত্র বিশ মিটার দৈর্ঘ্যরে সেতু পাড়ি দিতে কি আর দুর দুর বুকে ওঠা লাগে। সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে যোগ হয়েছিল হাড় ঠাণ্ডা করে দেয়া বুনো মাতাল বাতাস; ফলে ব্রিজও থেকে থেকে দুলে উঠছিল নিয়ম করে। অবশেষে যাওয়া-আসা মিলিয়ে দুই দু’বার পাড়ি দিয়েই ফেললাম সে রোমাঞ্চকর পথটুকু সাহসে ভর করে। রোপ ব্রিজ ঘুরে-ফিরে বাস চললো মধ্যাহ্নভোজ সেরে জায়ান্ট কসওয়ে দেখাতে। এবারো তাই, বাস যেখানে পার্ক করলো সেখান থেকে আবার বিশ মিনিট হাঁটতে হবে পৃথিবীর এই অষ্টম আশ্চর্য (গাইডের মতে) দেখতে হলে। এবার সাগরের তর্জন-গর্জন আরও প্রখর হলো যেন। দূর থেকেই ভেসে এলো প্রকট সে আওয়াজ। সাগর যেন গজরাতে গজরাতে এসে তার সমস্ত রাগ উগরে দিচ্ছে পাড়ে। হাঁটতে হাঁটতে জায়ান্ট কসওয়ে আর একটু স্পষ্ট হতেই বুঝলাম কেন ব্যাটা ড্রাইভার একে বারবার অষ্টম আশ্চর্য নামে অভিহিত করেছে। রীতিমতো ভিমরি খাওয়ার জোগাড়! থরে থরে বিভিন্ন আকার-আকৃতির পাথর যেন কেউ কায়দা করে সাজিয়ে রেখেছে সাগর তীরের একটা নির্দিষ্ট এলাকাজুড়ে। দেখলে মনে হবে কেউ নিজ হাতে প্রকাণ্ড সব পাথর পাশাপাশি বা কখনও কখনও একটার উপর আর একটা করে সাজিয়ে বুঝি কোন বাঁধ বানিয়ে রেখেছে আর থেকে থেকে সেখানে সাগরের বিশাল সব ঢেউ এসে আঁচড়ে পড়ছে। সত্যিই অভিভূত হওয়ার মতো বিষয়। কিভাবে এমন নিপুণ করে মস্ত সব পাথরের চাই একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে প্রাকৃতিকভাবেই বাঁধ বানিয়ে রেখেছে এখানে? চলবে...
×