ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত উন্নয়নের অগ্রযাত্রা

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৩ মার্চ ২০১৮

আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত উন্নয়নের অগ্রযাত্রা

মনোয়ার হোসেন ॥ পেরিয়েছে স্বাধীনতার ৪৭ বছর। দরিদ্র দেশ থেকে স্বল্পোন্নত দেশের অর্জনটি এসেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে। সেই ১৯৭৫ সালে। এবার ২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ পেল উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি। উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছে স্বদেশ। দ্রুতগামী অগ্রযাত্রায় বেড়েছে মাথাপিছু আয়, প্রবৃদ্ধি ও মানবোন্নয়নের সূচক। সেই সঙ্গে শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা সূচকেও বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বের বিস্ময়। আলোয় আলোয় উদ্যাপিত হলো জাতিসংঘ কর্তৃক উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদাপ্রাপ্তির সেই ঐতিহাসিক সাফল্য। আলোকরশ্মির ঝরণাধারায় ভেসে বেড়ালো জাতির জনকের সোনার বাংলাদেশের স্বপ্নের রূপরেখা। গানের সুরে ও নৃত্যের নান্দনিকতায় উদ্ভাসিত হলো সাফল্যের সুন্দরতম দৃশ্যকাব্য। আর সন্ধ্যার পর প্রধানমন্ত্রীর আগমনে উদ্দীপ্ত হলো অনুষ্ঠানে সমাগত হওয়া অগণন শ্রোতা-দর্শক। এভাবেই বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে রাত অবধি আলোয় আলোয় জ্বলে উঠল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। এখানে অনুষ্ঠিত হলো উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতিপ্রাপ্তির বর্ণিল সাংস্কৃতিক আয়োজন। নৃত্য ও গীতের এই উদ্্যাপনে অংশ নিয়েছেন সংস্কৃতিজনরা। ছিল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় পরিবেশনা। শারীরিক কসরতের খেলায় মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন অ্যাক্রোবেটিক দলের সদস্যরা। সাফল্যের উদ্যাপনে ‘অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। দেশবরেণ্য শিল্পীদের সঙ্গে সাফল্যের অগ্রযাত্রা তুলে ধরা বহুমাত্রিক পরিবেশনায় অংশ নিয়েছে শিল্পকলা একাডেমির এবং শিশু একাডেমীর সঙ্গীত ও নৃত্যদলের একঝাঁক শিল্পী। রকমারি আলো ছড়ানো আতশবাজির ঝলকানিতে আলোকিত হয়ে ওঠে স্টেডিয়ামের চারপাশ। সেখানে উদ্ভাসিত হয়েছে পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রসহ নানা অগ্রযাত্রার সাক্ষ্যবহ নানা উন্নয়ন প্রকল্পের চিত্র। ঘড়ির কাঁটায় যখন সন্ধ্যা সোয়া সাতটা তখন স্টেডিয়ামে প্রবেশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গী ছিলেন তার ছোট বোন শেখ রেহানা ও তার ছেলে রিদওয়ান সিদ্দিক মুজিব, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। প্রধানমন্ত্রী মঞ্চে আসার পর বেজে ওঠে জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’। এরপর লেজার শোর মাধ্যমে তুলে ধরা হয় বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের দৃশ্যকল্প। স্টেডিয়ামের উল্টোদিকের বিডিবিএল ভবনে ছড়ায় লাল-নীল আলোকরশ্মি। তাতে দৃশ্যমান হয় রক্তে পাওয়া লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা, বঙ্গবন্ধুর মুখচ্ছবি, শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে উদাহরণসহ তার আমলের নানা সময়ে উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি। এছাড়া স্টেডিয়ামে স্থাপিত বড় পর্দায় প্রদর্শিত হয় সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা-ের তথ্যচিত্র। এরপর এদিন সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তজার্তিক সম্মেলন কেন্দ্রের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ভাষণের ধারণকৃত অংশ উপস্থাপন করা হয়। সেই ধারণকৃত বক্তব্য শেষ হতেই রাতের আকাশ আলোকিত হয়ে ওঠে আতশবাজির ঝলকানিতে। হর্ষধ্বনিতে মুখরিত হয় ওঠে পুরো প্রাঙ্গণ। বিকেলের বর্ণিল সাংস্কৃতিক আয়োজনের আগে ৫৭টি মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ দপ্তর, অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে বসন্ত দুপুরে বের হয় আনন্দ শোভাযাত্রা। রাজধানীর নয়টি পয়েন্ট থেকে এ শোভাযাত্রা প্রবেশ করে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। দেশের অগ্রযাত্রায় উচ্ছ্বসিত হওয়া নারী-পুরুষের সম্মিলিত সেই আনন্দ মিছিলে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়েছে শহর। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তিকলা মিলনায়তনের সামনে থেকে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শোভাযাত্রা। জাতীয় প্রেসক্লাবের বিপরীত দিকে শোভাযাত্রাটি পৌঁছাতেই বাদ্যযন্ত্রে সুর মূর্ছনা তোলেন বাদ্যকররা। এরপর শোভাযাত্রাটি প্রবেশ করে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। সেখানকার এ্যাথলেটিক্স ট্রাকেও ছিল একই আয়োজন। আনন্দ শোভযাত্রা শেষে স্টেডিয়ামে শুরু হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। বসন্ত বিকেলে শুরু হয় মূল আয়োজন। প্রথমেই বেজে ওঠে উচ্ছ্বাসের শব্দমাখা ঢাক-ঢোলের। শত ঢাকির বাদনে মুখরিত হয় স্টেডিয়ামের চারপাশ। তারা নামতেই বীরত্বগাথার প্রতিচ্ছবি রায়বেঁশে নৃত্য। সামিনা হোসেন প্রেমার পরিচালনায় এ নৃত্য পরিবেশনায় অংশ নেন ভাবনা’র নৃত্যশিল্পীরা। নূপুরের নিক্কনধ্বনি থামতেই অর্ধশত বংশীবাদক বাঁশিতে সুর ওঠে আনন্দের। বাঁশির সুরে যখন শ্রোতার হৃদয়সিক্ত ঠিক তখন মঞ্চে আসেন শিল্পকলা একাডেমির শিশুশিল্পীরা। সম্মেলক কণ্ঠে গীত হয় ‘এ মাটি নয় জঙ্গীবাদের/এ মাটি মানবতার’। হৃদয়ছোঁয়া আয়োজনে এম আর ওয়াসাকের পরিচালনায় নন্দন কলাকেন্দ্রের দুই শতাধিক নৃত্যশিল্পী ‘ধন ধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানের সুরে নাচ করে। শিশু একাডেমির শিশুশিল্পীরা ‘আমরা সবাই বাঙালী’ ও ‘তীরহারা এ ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবো রে’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে। একশত দোতারা শিল্পী গানের সুর তোলেন দুই তারের বাদ্যযন্ত্রে। অনীক বোসের পরিচালনায় স্পন্দনের নৃত্যশিল্পীরা ‘চলো বাংলাদেশ’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন। গেরুয়া বসনের শত বাউলের কণ্ঠে গীত হয়েছে ‘আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে’। ফারহানা চৌধুরী বেবীর পরিচালনায় বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টসের নৃত্যশিল্পীরা বিভিন্ন গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন। শিল্পকলা একাডেমির নৃত্যশিল্পীদের পরিবেশনায় ষড়ঋতুর বাংলাদেশে বর্ষার সৌন্দর্য মেলে ধরে পরিবেশিত হয় ছাতা নৃত্য। পরের পরিবেশনায় শ্রোতা-দর্শককে যেন ফিরিয়ে নিয়ে যায় আবহমান গ্রামবাংলার জীবনের কাছে। নড়াইল থেকে আসা লাঠিয়ালের দল লাঠি খেলার অনবদ্য কসরতে মুগ্ধ করেন স্টেডিয়ামভর্তি দর্শকদের। তামান্না রহমানের পরিচালনায় তার দল নৃত্যছন্দে পরিবেশন করে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ শীর্ষক নাচ। ইস্কাটন গার্ডেন স্কুলের শতাধিক শিক্ষার্থীরা সম্মেলক নৃত্য পরিবেশন করে। মুগ্ধ করে শিল্পকলা একাডেমির এ্যাক্রোবেটিক দলের চমৎকার পরিবেশনা। ছিল অন্তর দেওয়ানের পরিচালনায় চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, রাখাইন, গারো, হাজং, সাঁওতাল, ওরাও, মুরং, তংঞ্চঙ্গা ও চাক সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশনা। ওয়ার্দা রিহাবের পরিচালনায় ধৃতি নৃত্যালয় পরিবেশন করে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ধামাইল নৃত্য। বাউল সঙ্গীত পরিবেশন করে শ্রোতার মন মজিয়েছেন শফি ম-ল ও চিশতী বাউল। চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি দল পরিবেশন করে নানা-নাতির সুর তোলা কথোপকথনের অম্ল­মধুর সম্পর্কের সঙ্গীত গম্ভীরা। ছিল দশ মিনিটের লোকজ যন্ত্রসঙ্গীতের সুর মূর্ছনা। বেহালা, সারিন্দা, সরোদ, সেতার, দোতারা, খোল, তবলা, ঢোলের সঙ্গে ছিল কিবোর্ড, প্যাড, পারকাশনের যুগলবন্দী। অনুষ্ঠানে ব্যান্ড সঙ্গীত পরিবেশন করে নেমেসিস। নানা পরিবেশনা শেষে আয়োজনের মূল আর্কষণ হিসেবে সঙ্গীত পরিবেশন করে শ্রোতাদের উচ্ছ্বাসে ভাসিয়েছেন রুনা লায়লা, মমতাজ ও জেমস।
×