ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

লন্ডনে বাংলাদেশ মিশন বন্ধে তৎপর ছিল পাকিস্তান

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৩ মার্চ ২০১৮

লন্ডনে বাংলাদেশ মিশন বন্ধে তৎপর ছিল পাকিস্তান

তৌহিদুর রহমান ॥ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর মুজিবনগর সরকার দেশে দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস স্থাপনের লক্ষ্যে কার্যক্রম শুরু করে। মুজিবনগর সরকার সবার প্রথমে কলকাতায় বাংলাদেশের একটি মিশন স্থাপন করে। ভারত সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকায় কলকাতায় মিশন স্থাপনে তেমন কোন সমস্যা হয়নি। কলকাতার পরেই লন্ডনে একটি মিশন চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে লন্ডনে বাংলাদেশ মিশন চালুর আগে থেকেই এর বিরুদ্ধে তৎপরতা চালিয়ে আসছিল পাকিস্তান। শেষ পর্যন্ত লন্ডনে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন হলে তা বন্ধে তৎপরতা শুরু করে পাকিস্তান। তবে তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি। মুজিবনগর সরকার বুঝতে পেরেছিল বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে গেলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কাছে টানতে হবে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতির জন্য বিভিন্ন দেশের সহায়তা নিতে হবে। বিশ্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্যের লন্ডন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সে কারণে লন্ডনে একটি হাইকমিশন খোলার জন্য কার্যক্রম শুরু করে প্রবাসী সরকার। লন্ডনে হাইকমিশন খোলার জন্য বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনিই হাইকমিশন খুলতে যাবতীয় কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৭১ সালের পহেলা আগস্ট লন্ডনের ট্রাফেলগার স্কোয়ারে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য একটি জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। সেই জনসভায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ঘোষণা দিয়েছিলেন লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশন স্থাপন হবে। আর সেই ঘোষণার পর থেকেই পাকিস্তান সরকারের ঘুম হারাম হয়ে যায়। কেননা লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশন স্থাপন হলে, বিশ্বজনমত বাংলাদেশের পক্ষে যেতে থাকবে। এটা বুঝতে পেরেই তারা এই দূতাবাস স্থাপনের বিরুদ্ধে তৎপরতা শুরু করে। লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের জন্য একটি ভাড়াবাড়ি খুঁজতে শুরু করেছিল প্রবাসী সরকার। আবু সাঈদ চৌধুরী এজন্য যুক্তরাজ্যের একাধিক নাগরিকের কাছে সহযোগিতা চেয়ে আসছিলেন। অবশেষে বাংলাদেশের হাইকমিশনের জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিলেন যুক্তরাজ্যের ওয়ার অন ওয়ান্টের চেয়ারম্যান ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন। হাইকমিশন স্থাপনের জন্য লন্ডনের পেমব্রিজ গার্ডেনের একটি বাড়ি তিনিই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেই বাড়িটির তখন নামমাত্র ভাড়া ছিল ১০০ পাউন্ড। ১৯৭১ সালের ২৭ আগস্ট প্রবাসী সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পেমব্রিজ গার্ডেনের বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ হাইকমিশন অফিস উদ্বোধন করেন। তবে এই হাইকমিশন উদ্বোধনে কোন প্রকার ঝামেলা যেন না হয়, সেজন্য আগে থেকেই উদ্যোগ নিয়েছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। উদ্বোধনের দিন বিপুলসংখ্যক ব্রিটিশ পুলিশ বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছে মোতায়েন করা হয়। পাকিস্তানী নাগরিকরা ঝামেলা করতে পারে এমন আশঙ্কা করেছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। তবে কোন প্রকার ঝামেলা ছাড়াই হাইকমিশন উদ্বোধন করা হয়। লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশন অফিস খোলার আগে থেকেই তৎপরতা শুরু করেছিল পাকিস্তান। এমনকি যেদিন মিশন খোলা হবে, সেদিন সকালেও চেষ্টার ত্রুটি করেনি পাকিস্তান। ১৯৭১ সালের ২৭ আগস্ট খুব সকালে বাংলাদেশ হাইকমিশন না খুলতে দেয়ার জন্য লন্ডনে নিযুক্ত পাকিস্তানের তৎকালীন হাইকমিশনার সালমান আলী ব্রিটিশ ফরেন ও কমনওয়েলথ অফিসে যান। তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জোসেফ গডবারের সঙ্গে বৈঠকও করেন। বৈঠকে বাংলাদেশের মিশন বন্ধের জন্য ব্রিটিশ সরকারকে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তবে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হতাশ করেন সালমান আলীকে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তাকে বলেন, বাঙালীরা ব্রিটিশ সরকারের কোন আইন ভঙ্গ করছে না, সে কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার কোন পদক্ষেপ নিতেও পারে না। শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে সেখান থেকে চলে আসেন পাকিস্তানের হাইকমিশনার। লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের খরচ বহনের জন্য শিল্পপতি জহিরুল ইসলাম প্রতি মাসে অর্থ যোগাতেন। তবে সে সময় তিনি তার প্রকৃত নাম গোপন করে সুবিদ আলী নামে এই টাকা দিতেন। ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্য বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পরে আনুষ্ঠানিকভাবে হাইকমিশন কার্যক্রম শুরু করে। সে সময় ২০ জন বাঙালী কর্মকর্তা ও কমচারী লন্ডন হাইকমিশনে যোগ দেয়। এসব কর্মকর্তারা আগেই পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে লন্ডনে পাকিস্তানে হাইকমিশনে সেকেন্ড সেক্রেটারি হিসেবে চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন মহিউদ্দিন আহমেদ। তবে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরেই তিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেন। মহিউদ্দিন আহমেদ পরবর্তীতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময়ের স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশন প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে নানা ধরনের চেষ্টা চালিয়েছিল পাকিস্তান। বিশেষ করে পাকিস্তানের সেই সময়ে লন্ডনে নিযুক্ত হাইকমিশনার সালমান আলী নানা ধরনের চেষ্টা করেন। সালমান আলী তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জোসেফ গডবারের কাছেও গিয়েছিলেন। তবে তার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
×