ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রবিবারের কার্যতালিকায়

দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার আপীল শুনানি হাইকোর্টে

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৩ মার্চ ২০১৮

দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার আপীল শুনানি হাইকোর্টে

বিকাশ দত্ত ॥ বহুল আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিদের আপীল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। আগামী রবিবার ওই বেঞ্চে কার্যতালিকায় মামলাটি শুনানির জন্য আসবে বলে জানা গেছে। হাইকোর্টের বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে এ মামলার আপীল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। সম্প্রতি তিনটি ভলিউমে ৩ হাজার ৪৩ পৃষ্ঠার এই পেপারবুক প্রস্তুত করে সুপ্রীমকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রাখা হয়েছে। এখন কেবল প্রধান বিচারপতির নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছে শুনানি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল সিইউএফএল ঘাট থেকে আটক করা হয় ১০ ট্রাক ভর্তি অস্ত্রের চালান। এ নিয়ে কর্ণফুলী থানায় ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন ও ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে চোরাচালানের অভিযোগে দুটি মামলা হয়। সিআইডি পুলিশ দুটি মামলা একসঙ্গে তদন্ত করে। দুই মামলায় বিচারিক কাজ শেষে ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এস এম মজিবুর রহমান রায় ঘোষণা করেন। রায়ে একটিতে সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়াসহ ১৪ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-ের আদেশ দেন আদালত। চোরাচালানের মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ৫২ আসামির মধ্যে ১৪ জনকে এই সর্বোচ্চ সাজা দেয়া হয়। একই সঙ্গে তাদের পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানাও করা হয়। অপরদিকে অস্ত্র আইনে করা মামলায় এই ১৪ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয় আদালত। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত ৩৮ আসামিকে বেকসুর খালাস দেন। যাদের বেশিরভাগই চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) ঘাটের শ্রমিক। ফাঁসির দ-াদেশপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন ডিজিএফআই’র সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) মোঃ আবদুর রহিম, পরিচালক উইং কমান্ডার (অব) সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ, উপপরিচালক মেজর (অব) লিয়াকত হোসেন, এনএসআইয়ের মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, সিইউএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন উদ্দিন তালুকদার, মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কে এম এনামুল হক, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব নুরুল আমিন, অস্ত্র বহনকারী ট্রলারের মালিক হাজি সোবহান, চোরাকারবারী হাফিজুর রহমান এবং অস্ত্র খালাসের জন্য শ্রমিক সরবরাহকারী দ্বীন মোহাম্মদ। এ দিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এরই মধ্যে জাময়াত নেতা নিজামীর মৃত্যুদ- কার্যকর করেছে সরকার। নিয়ম অনুযায়ী কোন ফৌজদারি আদালতে কারও ফাঁসি হলে তা অনুমোদনের জন্য হাইকোর্ট বিভাগে পাঠান হয়। আর শুনানি শেষে হাইকোর্টে শুনানি শেষে সংক্ষুব্ধ পক্ষ আপীল বিভাগে আবেদন করার সুযোগ পায়। এর পর আপীল বিভাগে মৃত্যুদ- বহাল থাকলে এবং রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা না করলে কিংবা রাষ্ট্রপতি প্রাণ ভিক্ষা না দিলে সরকার মৃত্যুদ- কার্যকর করে থাকে। এ দিকে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায় করা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ূয়া ও নুরুল আমিনের আপীল শুনানির জন্য সরকারকে আইনজীবী নিয়োগ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ৮ অক্টোবর এ আদেশ দেন। আসামিপক্ষে কোন আইনজীবী না থাকায় বিধি অনুযায়ী রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী নিয়োগের এই নির্দেশ দেয়া হয়। তবে এই মামলার ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য এখনও বেঞ্চ গঠন করা হয়নি। ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এস এম মজিবুর রহমান দুটি মামলার পৃথক রায় ঘোষণা করেন। দুটি মামলার মধ্যে একটিতে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী (যুদ্ধাপরাধ মামলায় মৃত্যুদ- কার্যকর), সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ূয়া এবং দুটি গোয়েন্দা সংস্থার উর্ধতন কর্মকর্তাসহ ১৪ জনকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। এর পর একই বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি চোরাচালান মামলার ২৬০ পৃষ্ঠা এবং অস্ত্র আটক মামলায় ২৫৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। পরে এ মামলার মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিদের আপীল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য হাইকোর্টে আসে। নি¤œ আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের কথা শুনেও নীরব ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের কথা উল্লেখ করে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, এ ঘটনা নিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন। কমিটিতে পাঁচজন সদস্য ছিলেন, যাদের তিনজনই এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তা মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামানও সাক্ষ্য দিয়েছেন। বিচারক রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, সাক্ষীদের জবানবন্দীর ভিত্তিতে এ মামলায় হাওয়া ভবনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। ঘটনাপ্রবাহ ॥ ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল মধ্যরাতে চট্টগ্রামের সিইউএফএল জেটিঘাটে খালাসের সময় পুলিশ সদস্যরা আটক করে ১০ ট্রাক সমপরিমাণ অস্ত্র। ঘটনাস্থল থেকে আটক হন পাঁচজন। ২ এপ্রিল ভোরে পুলিশ প্রহরায় ওই বিপুল অস্ত্র নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইন্সে। সেদিনই অস্ত্র পরিদর্শন করতে আসেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর। ৩ এপ্রিল এ ঘটনায় দুটি মামলা করেন কর্ণফুলী থানার তৎকালীন ওসি আহাদুর রহমান। এর এজাহারে কোন আসামির নাম উল্লেখ ছিল না। ১১ জুন সিআইডির এএসপি কবির উদ্দিন অস্ত্র মামলায় ৪৩ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন আদালতে। ৯ নবেম্বর সিআইডির এএসপি নওশের আলী খান চোরাচালান মামলায় ৪৫ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন। ২০০৫ সালের ৬ জুলাই এ মামলায় বাদি আহাদুর রহমানের সাক্ষ্য দেয়ার মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয়। ২০০৭ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ চলে। তখন পর্যন্ত অস্ত্র মামলায় ৩১ জন এবং চোরাচালান মামলায় সাক্ষ্য দেন ২৮ জন। ৬ জুলাই বাদী আহাদুর রহমানের সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মামলার বিচার কাজ। ২০০৭ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত ৩১ জনের সাক্ষ্য নেয়া শেষ হয়। ২০ নবেম্বর, ২০০৭ অধিকতর তদন্তের আবেদন রাষ্ট্রপক্ষের। এরপর সাতটি পর্যবেক্ষণসহ আদালত অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। ২০০৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সিআইডি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান চৌধুরীর হাতে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। ২০১১ সালের ২৬ জুন ১৩ দফা তদন্তের সময় বাড়ানোর পর তদন্ত কর্মকর্তা মনিরুজ্জামানের দেয়া অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত হন বাবর-নিজামীসহ ১১ নতুন আসামি। মোট আসামি দাঁড়ায় ৫২ জনে। একই বছরের ২৯ নবেম্বর আবার শুরু হয় দুই মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্য নেয়া। ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর, মনিরুজ্জামানের জেরা শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে মামলা দুটিতে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। অস্ত্র মামলায় মোট ৫৬ এবং চোরচালান মামলায় ৫৩ জন সাক্ষ্য দেন। ২০১৩ সালের ২৫ নবেম্বর রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়। সর্বশেষ গত ১৩ জানুয়ারি আট আসামির পক্ষে আইনজীবীরা তাদের যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন। ২০১৪ সালের ১৩ জানুয়ারি আট আসামির পক্ষে তাদের আইনজীবীদের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়। একই বছর ৩০ জানুয়ারি চোরাচালানের ঘটনায় করা বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় ১৪ জনকে ফাঁসিতে ঝোলানোর রায় দেয় আদালত। অস্ত্র আইনের পৃথক দুটি ধারায় ১৪ জনের প্রত্যেককে দেয়া হয় যাবজ্জীবন ও সাতবছর করে দণ্ডাদেশ।
×