ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আরএম দেবনাথ

আমানত, ঋণ ও শেয়ারবাজারের অস্থিতিশীলতা ॥ কে দায়ী?

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৩ মার্চ ২০১৮

আমানত, ঋণ ও শেয়ারবাজারের অস্থিতিশীলতা ॥ কে দায়ী?

গরম আমানতের (ডিপোজিট) বাজার এবং নরম শেয়ারবাজার- দুটোই খারাপ খবর। বিশেষ করে নির্বাচনের বছরে। মিডিয়ার একাংশ প্রায় প্রতিদিন ব্যাংক ও শেয়ারবাজারের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে জনমনে নানা ধরনের শঙ্কা সৃষ্টির চেষ্টা যে চালাচ্ছে তা দৃশ্যমান। তারা তা করতে পারছে এর কারণ আছে। খবরে দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু বেসরকারী ব্যাংক তাদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে অসম্ভব পরিমাণের আমানত টার্গেট দিয়ে চাকরিচ্যুতির হুমকি দিচ্ছে। গত বুধবারই এ ধরনের একটা খবর দেখলাম। এর আগে অন্য একটা ব্যাংকের ওপর একই খবর দেখলাম। এসব খবরের অর্থ একটাইÑ জলদি বাড়ি বাড়ি যাও, আমানত নিয়ে আস, নতুবা শাস্তি করছে অপেক্ষা। লক্ষণীয় এসব কোন সরকারী ব্যাংকেই ঘটছে না। সরকারী ব্যাংক টাকায় ভর্তি। সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ইত্যাদি ব্যাংক বরং বেসরকারী ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দিচ্ছে- কল মানি মার্কেটে এবং আন্তঃব্যাংক আমানতেও। অথচ যে অপপ্রচার সরকারী ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে দুই দিন পরপর এক শ্রেণির মিডিয়ায় হয় তাতে সরকারী ব্যাংকে মানুষের টাকা রাখার কথা নয়। ঘটনা ঠিক উল্টো। টাকা মানুষ সরকারী ব্যাংকেই রাখে। এদের আমানত রীতিমতো সবসময়ই উর্ধমুখী। এখনও তারা আস্থার শীর্ষে যদিও অনেকেই আস্থার সঙ্কট বলে একটা রব তোলার চেষ্টা করে। কেউ বুঝতেই চায় না এই সঙ্কট তৈরি হলে সরকারের বদনাম যা হওয়ার হবে, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমানতকারীরা। এটা আমাদের বোঝের মধ্যে রেখে সবার আলোচনা করা দরকার। অথচ তা হচ্ছে না। যেমন বর্তমান ‘ফান্ড সঙ্কট’- এর প্রকৃতি ও আকৃতি কী? ‘তারল্য সঙ্কট’ নিয়ে যেসব লেখালেখি হচ্ছে তারই বা অর্থ কী? ব্যাংকে তারল্য সঙ্কটের একটা অর্থ আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কত ‘তারল্য’ রাখতে হবে তার একটা সংজ্ঞা দিয়ে দেয়। এর নাম ‘স্টেটুটরি লিক্যুইডিটি রেশিও’। এর ভেতর দুটো জিনিস আছে- ব্যাংকের নিজের কাছে কিছু টাকা রাখতে হবে এবং কিছু নগদ টাকা রাখতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। যতদূর জানি, এটা বর্তমানে আমানতের সাড়ে উনিশ শতাংশ। কোন ব্যাংক যদি তা রাখতে না পারে তবেই তাকে তারল্য সঙ্কট বলা হয়Ñ লিক্যুইডিটি ক্রাইসিস। খবরের কাগজের কোন প্রতিবেদনে দেখছি না এমন তথ্য যাতে মনে হয় কোন ব্যাংক এই ‘লিক্যুইডিটি রেশিও’ রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। এটা কী আমার না জানার কারণে? মনে হয় না। তবে আসল সঙ্কট কী? এর কারণ কী? কারা এর জন্য দায়ী। এসব নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। কারণ ব্যাংকের আমানতের সমস্যা শেষ পর্যন্ত গিয়ে শেয়ারবাজারের ঘাড়ে চেপেছে। ঋণের ওপর সুদের হারও বাড়ছে। একটি সরকারী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের একটি নিবন্ধ পড়লাম গত মঙ্গলবার। এতে দেখা যাচ্ছে, ২০টি বেসরকারী ব্যাংক বর্তমান সঙ্কটের জন্য দায়ী। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ঋণ আমানতের’ অনুপাত অগ্রাহ্য করে নিজেরা বিপদে পড়েছে, ব্যাংকিং খাতকে আলোচনা-সমালোচনার মুখোমুখি করেছে। উল্লেখ্য, ব্যাংক কত টাকা ঋণ দিতে পারবে তার একটা সীমা আছে। আমানতের সব টাকা কোন ব্যাংক ঋণ হিসাবে দিতে পারে না। কিছু টাকা তাদের হাতে রাখতে হয় আমানতকারীদের উত্তোলন চাহিদা মেটানোর জন্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই অনুপাত দৃঢ়তার সঙ্গে রক্ষা করে। তা না হলে ‘মানিটরি ডিসিপ্লিন’ বিঘিœত হয়। আলোচ্য নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে, ২০টি বেসরকারী ব্যাংক অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত ‘এডিআর’ ভঙ্গ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক করেছে তাদের। কিন্তু কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। কী মারাত্মক কথা। কিছুসংখ্যক ব্যাংক সমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ আদেশ অমান্য করে চলেছে আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক চুপ করে বসে আছে। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্বতপ্রমাণ গাফিলতি। তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার বড় নজির। যদি তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে, সময়মতো পালন করত তাহলে আজকের এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমে ওই ব্যাংকগুলোকে অনিয়ম করতে সাহস যুগিয়েছে এবং এখন তাদের ধরেছে দীর্ঘদিন পরে। বলছে ‘এডিআর’ (ঋণ ও আমানতের অনুপাত) সমন্বয়ে করতে হবে। প্রথমে বলেছিল এটা সমন্বয় করতে হবে জুনের মধ্যে। সর্বশেষ বলা হয়েছে ডিসেম্বরের মধ্যে। ইতোমধ্যে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। ব্যাংকের এই সমস্যা শেয়ারবাজারেও ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসাবে ব্যাংকগুলোও শেয়ারবাজারে আছে। যদি ‘এডিআর’ সমন্বয় করতে হয় তাহলে শেয়ারবাজারেও টাকা ঢালা আর সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় শেয়ারবাজারে নেমেছে ধস। প্রতিদিন সূচক নিচের দিকে নামছে। বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদও করছে। বাজার বিশেষজ্ঞরা নানা ধরনের সতর্ক বার্তা দিচ্ছেন। এদিকে যে সমস্ত ব্যাংকের টাকা দরকার ‘এডিআর’ সমন্বয় করার জন্য তারা বাজারে নেমেছে। লিজিং কোম্পানিগুলো তো বাজারে আছেই। এই দুইয়ে মিলে আমানতের বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। অথচ দুইদিন আগেও এই সমস্ত ব্যাংক তথা সমস্ত ব্যাংকিং খাত আমানতকারীদের আপদ মনে করেছে। কোন সুদই দিতে চায়নি তারা। এসব ‘আচার’ ব্যাংকিং ‘খাত’কে দারুণ অস্থিতিশীল করে তুলছে। আমানতকারীরা ভুগছে বিভ্রান্তিতে। অথচ আমাদের দরকার স্থিতিশীল ‘মানি মার্কেট’, আমানতের বাজার। দরকার স্থিতিশীল শেয়ারবাজার। কিন্তু এক শ্রেণীর ‘মার্কিন মার্কা’ ব্যাংকারের কারণে এই খাতটি স্থিতিশীলতার মধ্যে কাজই করতে পারছে না। শোনা যাচ্ছে কিছু কিছু ব্যাংক আবার ১২-১৩ শতাংশ সুদে আমানত নিচ্ছে। তাহলে ঋণের ওপর সুদ হবে কত? ‘আমানত ব্যয়ের’ সঙ্গে কমপক্ষে ৫ শতাংশ প্রশাসনিক ব্যাংকিং মুনাফা যোগ করে পরে ঋণের ওপর সুদের হার ঠিক করতে হবে। এটা না করে ব্যাংকাররা কোত্থেকে আমানতের ওপর সুদ দেবে? তাহলে দেখা যাচ্ছে শুধু আমানতের বাজারই অস্থিতিশীল করা হচ্ছে না, ঋণের বাজারকেও করা হচ্ছে অস্থিতিশীল। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়ন যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। অথচ এসবের কিছুই হতো না যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার মনিটরিংয়ের কাজটা করত। কেন করল না? আমার মনে হয় সকলেরই ‘একাউন্টেবিলিটি’/জবাবদিহিতা আছে, নেই কেবল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। ১৯৯০ সাল থেকে এই পর্যন্ত বহু ব্যাংক পরিচালকের পদচ্যুত হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে কয়েক বছরের জন্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক হতে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। বহু কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরি গেছে। বহু অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকারের অবসর সুবিধাদি নিয়মিত আটকা পড়ছে। বহু ব্যাংকারের বিরুদ্ধে ‘দুদকে’ মামলা আছে। কোন কোন ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেলও খেটেছেন। এই মুহূর্তে কমপক্ষে ২-৩ জন চেয়ারম্যান-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ‘দুদকের’ জেরার মধ্যে আছেন। অথচ এসব খবর প্রচারিত হয় না। বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গাফিলতির কারণে, সুপারভিশনের অভাবে যে অর্থনীতির বিশাল ক্ষতি হচ্ছে তার বিচারের ব্যবস্থা কী? উল্লেখ্য, এসব প্রশ্ন আজ প্রতিবেশী দেশ ভারতে উঠেছে। আমাদের দেশেও ওঠা উচিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী জবাবদিহিতার উর্ধে থাকবে? পাহাড়প্রমাণ খেলাপী ঋণ, পুনর্কাঠামোকৃত ঋণ, পুনর্তফসিল মৃত ঋণÑ এসবের দায়িত্ব কী শুধু স্ব-স্ব ব্যাংকের? হোক তা বেসরকারী ব্যাংক, হোক তা সরকারী ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কর্মকর্তাদের পেটানো হয় তার বিচার নেই। সেখানে অনিয়ম-দুর্নীতি হলে তার বিচার একটা-ইনক্রিমেন্ট বন্ধÑ এসবই তো ঘটনা। অথচ ব্যাংকের সুপারভিশনের নাম করে তারা প্রশিক্ষণের জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে। এমনকি প্রশিক্ষণের টাকা বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকেও আদায় করা হয়। অথচ বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোন টাকা দেয় না। ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তিশালীকরণ’-এর আওতায় প্রকল্প আছে। বহু টাকা ব্যয়ও হয়। তারপরও বাণিজ্যিক ব্যাংক নিরীক্ষণের কাজ সুচারুরূপে হয় না কেন? এসব বিষয় ‘ব্যাংকিং কমিশন’ হলে আলোচনায় আসত। বিশেষ করে জবাবদিহিতার প্রশ্ন। সবার জবাবদিহিতা আছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের থাকবে না কেন? বর্তমান ‘ফান্ড সঙ্কটে’র জন্য কে দায়ী তার ওপর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। নির্বাচনের বছরে অহেতুক একটা সঙ্কট তৈরি হবে। আর দেশবাসী ক্ষতিগ্রস্ত হবে এটা কারও কাম্য নয়। আমি আগেও বলেছি এখনও বলছি বহু কাজ আছে যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করা উচিত নয়। যেমন ক্লিয়ারিংয়ের কাজ। এটি আলাদা একটি সংগঠন করতে পারে। ‘আমানত বীমা’-এর কাজ অন্যত্র হতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘মনিটরি পলিসি প্রণয়ন’ করুক। রাজস্ব, বাণিজ্যিক, মুদ্রা ইত্যাদি নীতির সমন্বয় করুক। সবচেয়ে জোরালোভাবে করা দরকার সুপারভিশনের কাজ। বেশি কিছু নয়। ৫৯টি ব্যাংকের প্রধান প্রধান শাখা ভাল করে ‘অডিট’ করা হোক নিয়মিতভাবে। যত গ-গোল, অনিয়ম, দুর্নীতি সব এসব শাখাতেই হয়। মফস্বলের শাখার অনিয়ম-দুর্নীতি টাকার অঙ্কে সামান্য। কিন্তু যেসব শাখা ‘বৈদেশিক বাণিজ্য’ ফিন্যান্স করে সেসব শাখাতেই যত অনিয়ম, অন্যায় অবিচার সংঘটিত হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত এসব শাখার অডিটে, নিয়মিত ও আচমকা অডিটে মন দেয়া। রুটিন অনেক কাজ থেকে মুক্ত করা দরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে, যাতে তারা জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করতে পারে। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×