ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একাত্তরের কূটনৈতিক যুদ্ধ ৩

মুজিবনগর সরকার গঠনের আগেই কূটনীতিকদের পক্ষ ত্যাগ শুরু

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২২ মার্চ ২০১৮

মুজিবনগর সরকার গঠনের আগেই কূটনীতিকদের পক্ষ ত্যাগ শুরু

তৌহিদুর রহমান ॥ ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের পরেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের পক্ষে মাঠে নেমে পড়েন। ১৫ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমদ কলকাতার পাকিস্তান মিশনের তৎকালীন ডেপুটি হাইকমিশনার এম হোসেন আলীর সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে স্থির হয় পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনারের নেতৃত্বে সকল বাঙালী কর্মকর্তা-কর্মচারী একযোগে পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবেন। এরপর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। আর তার একদিন পর ১৮ এপ্রিল ডেপুটি হাইকমিশনার এম হোসেন আলীর নেতৃত্বে ৬৫ বাঙালী কর্মকর্তা- কর্মচারী পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেন। পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার এম হোসেন আলীর পক্ষ ত্যাগে তোলপাড় শুরু হয়। তার বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের বিষয়টি মেনে নিতে পারছিল না পাকিস্তান। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২২ এপ্রিল ভারতকে হুমকি দেয় পাকিস্তান। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয়, এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। দিল্লীতে নিযুক্ত পাকিস্তানের তৎকালীন হাইকমিশনার সাজ্জাদ হায়দার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এ কে রায়ের সঙ্গে দেখা করেন। সে সময় তিনি বলেন, এই ঘটনার পরিণতি হবে ভয়াবহ। তবে এ কে রায় বলেন, বিষয়টি পাকিস্তানের একান্তই অভ্যন্তরীণ। এতে ভারতের কোন হস্তক্ষেপ নেই। আর এ বিষয়ে ভারত তার দেশে কাউকেই শক্তি প্রয়োগ করতে দেবে না। এম হোসেন আলী পক্ষ ত্যাগের পরে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কলকাতা মিশনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। তিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করার পরে একটি বিবৃতিও দেন। সেই বিবৃতিতে এম হোসেন আলী বলেন, বর্তমানে পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধিত্ব অব্যাহত রাখা অসম্ভব। কারণ, তারা বাংলাদেশের বাঙালীদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে। পাকিস্তান পরিকল্পিতভাবে বাঙালী জাতিকে দমন করার প্রয়াসে জড়িত। পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করার ঘটনায় পরবর্তীতে এক সাক্ষাতকারে এম হোসেন আলী বলেছিলেন, আমাকে সতর্ক থাকতে হতো। অন্তত আমাদের সিদ্ধান্ত সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার পূর্বেই যেন ফাঁস না হয়ে যায়। উল্লেখ্য, এম হোসেন আলী ১৯৮১ সালের ২ জানুয়ারি কানাডায় মৃত্যুবরণ করেন। এদিকে কলকাতায় পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনে বাঙালী কর্মকর্তাদের পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করার আগেই দিল্লীর পাকিস্তান হাইকমিশনে দুই বাঙালী কর্মকর্তা পক্ষ ত্যাগ করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল দিল্লীর পাকিস্তান হাইকমিশনে কর্মরত সেকেন্ড সেক্রেটারি কে এম শিহাবউদ্দিন ও সহকারী প্রেস অ্যাটাশে আমজাদুল হক বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তারা বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেছেন বলে জানান। একই সঙ্গে ভারত সরকারের আশ্রয় প্রার্থনা করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে তারাই প্রথম পাকিস্তানী কূটনৈতিক হিসেবে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন। এরপর পর্যায়ক্রমে সেখানে আরও ৯ বাঙালী কর্মকর্তা পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেছিলেন। কে এম শিহাবউদ্দিন ২০১৫ সালের ১৫ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। তবে দিল্লীতে সে সময় কে এম শিহাবউদ্দিনের সঙ্গে তার স্ত্রী খালেদা শিহাবউদ্দিনও থাকতেন। কে এম শিহাবউদ্দিনকে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করার জন্য খালেদা শিহাবউদ্দিনও তার স্বামীকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনিও এই পক্ষ ত্যাগের ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে খালেদা শিহাবউদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ১৯৭১ সালের মার্চে ঢাকায় গণহত্যার কথা আমরা জানতে পারি। সেই ঘটনা জানার পর থেকেই পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করার জন্য চিন্তা শুরু করেছিলাম। এরপর ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে কে এম শিহাবউদ্দিন ও আমজাদুল হক পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেন। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ত্যাগ করার পরে এই দুই কর্মকর্তা দিল্লীতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশের মানুষদের ওপর ইসলামাবাদ ইতিহাসের জঘন্যতম নির্যাতন চালাচ্ছে। নিরপরাধ, নিরস্ত্র মানুষদের হত্যা করছে। এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে বিশ্ব। পাকিস্তান একটি ফ্যাসিস্ট, স্বৈরাচারী সেনাবাহিনী পরিচালিত সরকারের হয়ে তারা আর কাজ করবে না। এখন থেকে তারা সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশীর জন্য দ্ব্যর্থহীনভাবে কাজ করে যাবে। কলকাতা ও দিল্লীতে কূটনীতিকরা পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করায় মুক্তিযুদ্ধে নতুন একটি মাত্রা যুক্ত হয়। এই ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে স্বাধীনতা লাভের দিকে এগিয়ে যায়।
×