ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা না পাওয়ায় সঙ্কট বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২২ মার্চ ২০১৮

অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা না পাওয়ায় সঙ্কট বাড়ছে

শাহীন রহমান ॥ নদীমাতৃক বাংলাদেশে ৩শ’টির বেশি নদী রয়েছে। যার মধ্যে অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৭টি। ৫৪টি ভারতের এবং ৩টি মিয়ানমারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অথচ ভাঁটির দেশ হিসেবে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় দেশে পানি সঙ্কট ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানি প্রতি বছর কমে যাওয়া এবং নদী হারিয়ে যাওয়ার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিনিয়ত নিচে নেমে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সতর্ক পদক্ষেপ নেয়া না হলে আগামীতে দেশে ভয়াবহ পানির সঙ্কট দেখা দিতে পারে। পানি সঙ্কটের বিষয়টি মাথায় রেখেই বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশে আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস। এ বছরে পানি দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘পানির জন্য প্রকৃতি’। বিশ্বের ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে নিরাপদ পানির সঙ্কট উপলব্ধি করে ১৯৯২ সালে জাতিসংঘ ২২ মার্চকে বিশ্ব পানি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। জাতিসংঘ থেকে নিরাপদ পানি সঙ্কটের কথা উপলব্ধি করা পানি দিবস ঘোষণা করা হলেও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ নিরাপদ পানি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত। বিশেষ করে ঢাকা চার নদী দূষণের কারণে প্রায় নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা এখন কঠিন হয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন পানির গুণগত মান বিবেচনা করলে ঢার চার নদীতে এখন কোন পানি নেই। যা আছে তা তরল বিষাক্ত বর্জ্য। অথচ দেশের নিরাপদ পানির বড় উৎস অসংখ্য নদনদী। যার বেশিরভাগই শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য থাকছে। তাদের মতে, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদী হলে অসংখ্য উপনদী ও শাখানদী রয়েছে। কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা আবর্তিত হচ্ছে নদীকে কেন্দ্র করে। কিন্তু ভাটির দেশ হিসেবে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় দেশে পানি সঙ্কট আরও ঘনীভূত হচ্ছে এবং নৌ চলাচল, সেচ ব্যবস্থা ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। নদীতে পানি কমে যাওয়া বা না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। পলি পড়ে নদীগুলো ক্রমন্বয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও নদীগুলো দখল, ভরাট ও দূষণের শিকার। ফলে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে। নৌ চলাচল বিঘিœত হচ্ছে এবং নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী পড়ছে। জাতিসংঘের সাবেক পরিবেশ ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. এসআই খান উল্লেখ করেন, বর্ষাকালে দেশের সীমানা পেরিয়ে ব্রহ্মপুত্র এবং এর উপনদী দিয়ে পানি আসে শতকরা ৫১ ভাগ। গঙ্গা এবং এর উপনদী দিয়ে আসে ২৮ এবং মেঘনা ও এর উপনদী দিয়ে ১৪ ভাগসহ মোট ৯৩ ভাগ পানি সীমানা পেরিয়ে আসে। শুকনো মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র এবং এর উপনদী দিয়ে পানি আসে ৯০ ভাগ মেঘনা এবং এর উপনদী দিয়ে আসে শতকরা ৯ ভাগ পানি। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের কারণে গঙ্গা নদীর প্রবাহ শুকনো মৌসুমে একেবারেই নেই বললে চলে। তার মতে, ভারতের এক তরফা পানি প্রত্যাহার এবং সমুদ্রের লবণপানি দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ার কারণেও পানি সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও ভূ-গর্ভস্থ স্তরের পানি নেমে যাওয়ার কারণেও এই আশঙ্কা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। উজান থেকে নদীতে পর্যাপ্ত পানি না আসায় প্রতিবছর পাতাল পানিও রিচার্জ হচ্ছে না। পাতাল পানি ৮ মিটারের বেশি নিচে নেমে গেলে নলকূপের পানি উঠবে না। সমুদ্রের লবণ পানি ঠেলে নামানোর জন্য প্রয়োজন ১ হাজার ৩৪৬ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি। কিন্তু নদীতে এই পর্যাপ্ত পানির প্রবাহ না থাকায় প্রতিনিয়ত সমুদ্রের লোনা পানি দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নলকূপের মাধ্যমে পাতাল পানি তুললে পাতাল পানির স্তর প্রতি বছর ১৫ ফুট নিচে নেমে যায়। পাতাল পানির স্তর নলকূপ থেকে ২৬ ফুটের বেশি নেমে গেলে সাধারণ নলকূপের মাধ্যমে পাতাল পানি তোলা সম্ভব হবে না। সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে শুষ্ক মৌসুমে দেশে অধিকাংশ সাধারণ নলকূপের পানি উঠছে না। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বাংলাদেশে আগত নদী থেকে ভারত পানি সরিয়ে নিলে বাংলাদেশ ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তাদের মতে, উজানে পানি প্রত্যাহারের আগে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীতে পানির প্রবাহ ছিল ১ হাজার ৩৪৬ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। বর্তমানে এ নদীগুলোতে পানির প্রবাহ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। উজানে পানি সরিয়ে নেয়ার কারণেই মূলত নদীর প্রবাহ দারুণভাবে কমে গেছে। এতে করে সমুদ্রের লোনা পানিকে বাধা দেয়ার ক্ষমতা কমে গেছে। একই কারণে পাতাল পানিও পর্যাপ্ত রিচার্জ হচ্ছে না। জোয়ারের সময় সমুদ্রের লোনা পানি দিনে ২ বার দেশের ভেতরে প্রবেশ করে। নদীতে প্রবাহ বেশি থাকলে নদীর পানি সমুদ্রের লোনা পানিকে বাধা দেয়। সে কারণে সমুদ্রের পানি বেশি ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু নদীর প্রবাহ কমে গেলে নদীর পানি সমুদ্রের লোনা পানিকে বাধা দেয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, লবণ পানি ঠেকাতে হলে নদীর পানির উচ্চতা ও প্রবাহ এবং জোয়ারের পানির উচ্চতা ও প্রবাহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। তারা বলেন, লবণাক্ত পানি ঠেলে নামানোর জন্য যে পরিমাণ পানি দরকার তা প্রধান নদীগুলো দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে না। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়ছে। আবার ভূগর্ভস্থ স্তরের পানি রিচার্জ করার জন্যও নদীতে পানির প্রবাহ বাড়ানো দরকার। কিন্তু উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণে পর্যাপ্ত পানি আমাদের দেশে আসছে না। এ সমস্যা সমাধানের জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে উজানের পানির প্রাপ্যতাকে নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে আগামীতে ভয়াবহ পানি সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে। তারা বলছেন সীমানা পেরিয়ে আসা ৫৪টি নদীর মধ্যে ২৫টি নদী মেঘনা নদীকে পানি দিয়ে থাকে। ভারত ইতোমধ্যে প্রায় সবগুলো নদীতে বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণ করেছে। অথচ ২০২৫ সাল পর্যন্ত ভারতের বার্ষিক পানির প্রয়োজন ১ হাজার ১৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। তাদের পানির প্রাপ্যতা রয়েছে ৬ হাজার ৩৭৩ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। এর সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে পানি হারভেস্টিং করলে আরও ১৪২ বিসিএম পানি পাওয়া যাবে। ভারতের এই পানির প্রাপ্যতা প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় ৭ গুণ বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতে প্রাপ্য পানির ১৫ ভাগ ব্যবহার করলে নদীতে বাঁধ বা ব্যারাজ দিয়ে উজানে বাংলাদেশের পানি সরানোর কোন প্রয়োজন হয় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি পরিবেশগত বিপর্যয়ের ফলে বিশ্বজুড়ে পানি সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এছাড়াও বিশ্বব্যাপী মানুষের পরিবেশ বিরূপ কর্মকা-ের ফলে বনভূমি, কৃষিভূমি, নদ-নদী ও জলাভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে বন্যা, খরা, পানির স্বল্পতা এবং পানি দূষণ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, জলবায়ুর পরিবর্তন, ইত্যাদির বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশে ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছে। এ কারণে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার আমূল পরিবর্তন ঘটছে। গড় তাপমাত্রা পরিবর্তন হয়েছে যে কোন মৌসুমের ক্ষেত্রে, বৃষ্টিপাতের ধরন ও সময় বদলে গেছে। পরিবেশ সংগঠন পবার সাধারণ সম্পাদক এবং পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা চারদিকে নদী দ্বারা বেষ্টিত। প্রাকৃতিক পরিবেশ সমৃদ্ধ এ ধরনের শহর পৃথিবীতে বিরল। এক গবেষণায় দেখা যায় যে, ঢাকায় জলাশয় ও নিম্নাঞ্চলের পরিমাণ ছিল ১৯৬০ সালে যথাক্রমে ২৯৫২ ও ১৩৫২৮ হেক্টর, ১৯৮৮ সালে যথাক্রমে ২১০৪ ও ১২৭১৮ হেক্টর এবং ২০০৮ সালে যথাক্রমে ১৯৯১ ও ৬৪১৫ হেক্টর। ১৯৬০ হতে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল যথাক্রমে শতকরা ৩২.৫০ ও ৫২.৫০ হ্রাস পেয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৭০% নিম্নাঞ্চল ভরাট করা হয়েছে। সরকারী ও বেসরকারীভাবে পাল্লা দিয়ে চলছে ভরাট কার্যক্রম। ভরাটের এ গতি অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ শতভাগ নিম্নাঞ্চল হারিয়ে যাবে।
×