ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ফয়জুরের সহযোগী চমনকে খুঁজছে পুলিশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২২ মার্চ ২০১৮

ফয়জুরের সহযোগী চমনকে খুঁজছে পুলিশ

শংকর কুমার দে ॥ বিশিষ্ট লেখক ও সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় তার ওপর হামলা করার জন্য প্ররোচিত ও উৎসাহিত করেছে আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে এমন কয়েকজনের নাম বলেছে হামলাকারী ফয়জুল হাসান ওরফে ফয়জুর। এই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার হত্যার পেছনে যেসব সংগঠনের নাম পাওয়া গেছে তার মধ্যে রয়েছে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন ‘আনসরুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), আনসার আল ইসলাম, নব্য জেএমবি, শাহাদত-ই-আল হিকমা ও হিযবুত তাহরীর মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নাম। জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় হামলাকারী ফয়জুলকে প্ররোচিত ও উৎসাহিত করার নেপথ্যে এসব নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠনের মদদদাতা বা পৃষ্ঠপোষক আছে কিনা তা খতিয়ে দেখছে তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। হামলাকারী ফয়জুলের সহযোগী চমন ওরফে সুমন নামে এক যুবককে খুঁজছে পুলিশ, যার মাধ্যমে জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় হামলার জন্য প্ররোচিত হতে পারে বলে পুলিশের দাবি। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। জানা গেছে, জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় গত ৩ মার্চে হামলার বছর দুয়েক আগে তাকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলাম নামের যে জঙ্গী সংগঠনটি হত্যার হুমকি দিয়ে মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়েছিল তারাই এ হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত কিনা তাও তদন্তের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। হত্যার হুমকি দিয়ে এসএমএস করা ছাড়াও হিটলিস্টে নামসহ কাফনের কাপড় পাঠানো হয়েছিল তাকে। হামলাকারী ফয়জুলকে নিজে থেকে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ ব্যক্তি হিসেবে স্বপ্রণোদিত হয়ে জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টা করা হলেও তার নেপথ্যে যে মদদদাতা বা পৃষ্ঠপোষক রয়েছে তার প্রমাণ দেয় অতীতে এসএমএস করে হত্যার হুমকি প্রদান, হিটলিস্টে নাম অন্তর্ভুক্ত করে হুঁশিয়ারি প্রদান, কাফনের কাপড় পাঠানোর ঘটনাবলীতেই। যদিও পুলিশের আইজি ড. জাবেদ পাটোয়ারী বলেছেন, হামলাকারী ফয়জুল জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বপ্রণোদিতভাবে হামলা চালিয়েছে। র‌্যাব-৯ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (সিও) আলী হায়দার আজাদ বলেছেন, হামলাকারী ফয়জুলকে গণপিটুনিতে আহত অবস্থায় আটকের পর প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে সে জানিয়েছে- জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী হয়েই জাফর ইকবালের ওপর হামলা চালিয়েছে। জাফর ইকবালের ওপর হামলার আগে যেসব প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষাবিদ ও প্রগতিশীল মুক্তমনা মানুষ হত্যা ও হামলার শিকার হয়েছেন তারা প্রত্যেকেই বিভিন্ন জঙ্গীগোষ্ঠীর হিটলিস্টে বা হুমকির মধ্যে ছিলেন। জঙ্গীগোষ্ঠী ইন্টারনেটে, অনলাইনে, ফেসবুকে, ওয়েবসাইডে বিবৃতি দিয়ে দিয়ে তাদের টার্গেট কিলিং মিশন বাস্তবায়ন করছে বলে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের দাবি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে লেখক ও অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালকে হত্যার পরিকল্পনার বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে হামলাকারী ফয়জুল বলেছে, হত্যার উদ্দেশ্য নিয়েই হামলা চালিয়েছিল। জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়াসহ হামলার পরিকল্পনার খুঁটিনাটি তথ্যও জানিয়েছে ফয়জুল। ল্যাপটপে ইউটিউবে নিয়মিত উগ্রপন্থী ওয়াজ শুনত সে। জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে হত্যার পরিকল্পনা সাজায় কয়েকজনের পরামর্শে। প্রশ্ন উঠেছে, এই কয়েকজন কারা যাকে পরামর্শ দিয়েছে? সিলেট মহানগর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তৃতীয় আদালতের বিচারক হরিদাস কুমারের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টায় আরও কয়েকজন জড়িত বলেও আদালতকে জানিয়েছে সে। প্রশ্ন উঠেছে, শুধু পরামর্শদাতাই নয়, হত্যার চেষ্টার সঙ্গে কয়েকজন যে জড়িত রয়েছে বলেছে, তারা কারা? জবানবন্দীতে ফয়জুল আরও জানায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী সে জাফর ইকবালকে হত্যার উদ্দেশে হামলা করে। পরিকল্পনায় যুক্ত ছিল তারা এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় তার ওপর হামলার ঘটনায় হামলাকারী ফয়জুল হাসান, তার বাবা মাওলানা আতিকুর রহমান, মা মিনারা বেগম, ভাই এনামুল হাসান, মামা ফজলুল হক ও বন্ধু সোহাগকে গ্রেফতার করার পর হামলাকারী ফয়জুল তার বাবা মাওলানা আতিকুর রহমান ও ভাই এনামুল হাসান আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে। হামলাকারী ফয়জুলের সহযোগী বন্ধু সোহাগকে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করার অভিযোগে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে এখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী ফয়জুর রহমান ওরফে ফয়জুলের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে আটক করা হয় সোহাগকে। সোহাগ একজন ফেরিওয়ালা। পাঁচ-সাত বছর আগে থেকেই সে লেখাপড়া বাদ দিয়ে সিলেটে গিয়ে ব্যবসা শুরু করে। সোহাগ মিয়ার বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের উমেদনগর গ্রামে। তার বাবা ছাদিকুর রহমান ওরফে ছও মিয়া। মা-বাবার পাঁচ ছেলে ও পাঁচ মেয়ের মধ্যে সোহাগ মিয়া ষষ্ঠ সন্তান। সে গ্রামের উমেদনগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাস করে। পরে কৃষ্ণনগর পাবলিক হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। গ্রেফতার হওয়ার দুই সপ্তাহ আগে সে একদিনের জন্য বাড়ি গেলেও আবার সেদিনই বাড়ি থেকে সিলেটে চলে আসে। কয়েক বছর ধরেই সে নামাজী হয়ে যায়। বাড়িতে এলে বেশিরভাগ সময় ঘরেই থাকত। কারও সঙ্গে খুব বেশি মিশত না। জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী ফয়জুর রহমান ওরফে ফয়জুলের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে আটক করা হয় সোহাগকে। গত ১৮ মার্চ রাতে সিলেট নগরীর কালীবাড়ি আবাসিক এলাকা থেকে সোহাগকে আটক করা হয়। পরেরদিন ১৯ মার্চ সিলেট মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক সাইফুজ্জামান হিরো পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বর্তমানে জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় তার ওপর হামলার মামলায় হামলকারী ফয়জুলের বন্ধু সোহাগই পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাধীন আছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় তার ওপর হামলাকারী ফয়জুলের দেয়া জবানবন্দীর ভিত্তিতে বন্ধু সোহাগকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধকারী, পরিকল্পনাকারী, মদদদাতা, পৃষ্ঠপোষক কারা আছে তাদের নাম জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ছাড়া হামলাকারী ফয়জুলের জবানবন্দীতে আসা আরেক বন্ধু চমন ওরফে সুজনকে গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছে। এই চমন ওরফে সুমন হামলাকারী ফয়জুলের এতই ঘনিষ্ঠ যে তার এক বোনের সঙ্গে সুমনের বিয়ে দেয়ার কথাবার্তা হয়েছিল।
×